ইন্টার্ন চিকিৎসকের ওপর পাশবিক নির্যাতন, ৪ দিনেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা
সাখাওয়াত হোসাইন: যশোর মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে জাকির হোসেন নামের এক ইন্টার্ন চিকিৎসককে পিটিয়ে দুই পা, এক হাত ও পাঁজরের হাড় ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মেডিকেলের শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের বিরুদ্ধে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন ডা. জাকির। ঘটনার চারদিন পার হলেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা।
গুরুতর আহত ডা. জাকির মেডিভয়েসকে বলেন, ‘গত ৩১ জানুয়ারি রাতে টানা আড়াই ঘণ্টা ধরে তাকে হকিস্টিক দিয়ে মারধর করেন একই হাসপাতালের ইন্টার্ন মেহেদী হাসান লিয়ন, সাবেক ইন্টার্ন চিকিৎসক শামীম হাসান, আব্দুর রহমান আকাশ ও চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান তানিম।’
হামলার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘ঘটনার দিন রাতে আমি টিউবওয়েল থেকে পানি আনতে যাই। এসময় ১০২ নাম্বার রুম থেকে ডা. আব্দুর রহমান আকাশ নামে একজন বের হয়ে আমার পিছনে পিছনে আসে। এরপর ডা. শামীম হকিস্টিক নিয়ে আমার রুমে আসে। আমি হেসে বললাম, কিরে তুই এসব নিয়ে আসলি কেন? আমাকে মারবি নাকি? এরপর ডা. শামীম আমার পিছন থেকে হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করে, সঙ্গে সঙ্গে আমি নিচে পড়ে যাই। পরে আমাকে ডা. শামীম, আকাশ, লিয়ন, তানিম আমাকে এলোপাতাড়ি মারতে থাকে।’
হাসপাতালের বেডে শুয়ে জাকির আরও বলেন, ‘মার সহ্য করতে না পেরে তাদের হাত-পা ধরেছি, তারপরও তাদের দয়া হয়নি। মারার কিছুক্ষণ পর আমাকে বলে তোর বাইকের চাবি কোথায়? এরপর হাত দিয়ে ইশারায় চাবি দেখিয়ে দিলাম। চাবি এবং বাইকের কাগজপত্রও নিয়ে নেয়। এরপর আবার মারা শুরু করে। মারতে মারতে রুমের এককোনায় নিয়ে যায়। পৌনে নয়টা থেকে শুরু করে রাত ১১টা দিকে পর্যন্ত আমার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। আমার গলা শুকিয়ে যায়, তাদের কাছে পানি চাই, একটু পানি খেতে দিয়ে আবার পিটানো শুরু করেন। হকিস্টিক দিয়ে মাথা বাদে পুরো শরীরে পিটিয়ে ক্ষত করে দিয়েছে তারা। এক পর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই, জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। পরে শুনেছি, সহকারী হল সুপার আমাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।
এ ইন্টার্ন চিকিৎসক বলেন, ‘আমার ইন্টার্ন শেষ হতে আর ১৪ দিন বাকি আছে। ছাত্রাবাসে আমার রুম নাম্বার ১০৫। ১০৪ নাম্বার রুমে চার-পাঁচ বছর ধরে মাদকের আড্ডা হয়। এ রুম সম্পর্কে যশোর শহরের সবাই জানে এটা নেশার আখড়া। ঘটনার দিন তারা ১০৪ নাম্বার রুমে না বসে ১০২ নাম্বার রুমে বসছে। ১০৪ নম্বর রুমে সবসময় গাঁজা, মদ সেবনের আড্ডা হয়। সকালে এক গ্রুপ আসে, বিকেলে এক গ্রুপ ও সন্ধ্যায় অন্য গ্রুপ এসে মাদক সেবন করে। এসবের সহায়তাকারী ও নেতৃত্বদানকারী হলেন ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন রাসেল। তিনিই আমাকে মারধরের ঘটনায় প্রধান ইন্ধনদাতা।’
ডা. জাকির বলেন, ‘আমি মাঝে মাঝে বলতাম, যদি কখনও সুযোগ আসে, তাহলে আমি মেডিকেলের হোস্টেলে এসব করতে দিব না। তাদের বিরুদ্ধে নালিশও দিয়েছিলাম। কয়েকবার বলেছি, তোমরা যা করো দরজা বন্ধ করে কর, ধোঁয়া যাতে আমার রুমে না আসে। এসব বলাতে দীর্ঘদিন থেকে আমার উপর তাদের একটা ক্ষোভ ছিল।’
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) যশোর কোতোয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেছেন ডা. জাকিরের বড় ভাই। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. শাহাদাত হোসেন রাসেল মেডিভয়েসকে বলেন, ‘কলেজ কর্তৃক একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। বিষয়টা যেহেতু তদন্তধীন, তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক কিছু থাকে বলা যায় না, এটা আপনিও (প্রতিবেদক) বুঝেন। আপনারা খোঁজ-খবর নেন, আমার পক্ষ থেকে নো কমেন্টে থাকতে চাচ্ছি।’
জানতে চাইলে যশোর মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ডা. শাহাজাদ জাহান দিহান মেডিভয়েসকে বলেন, ‘খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, তাকে (ডা. জাকির) পিটিয়ে আহত করা হয়েছে। তাঁর হাত, পা এবং পাঁজরের হাড় ভেঙে গেছে। যাদের নাম আসছে তারাই পিটিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কলেজের কিছু শিক্ষার্থী, ইন্টার্ন চিকিৎসক এবং বাহির থেকে ডাক্তাররা এসে ছাত্রাবাসে মাদকের আসর চালায়। আমরা কলেজের অধ্যক্ষকে জানিয়েছি এবং তিনিও মাঝে মাঝে পদক্ষেপ নিয়েছেন। তারপরও এসব বন্ধ হয় নাই।’
কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তাজুল ইসলাম মেডিভয়েসকে বলেন, ‘কলেজের তদন্ত কমিটির এখনও তদন্ত শেষ হয়নি। তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলে তার উপর ভিত্তি করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কলেজের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আমরা কিছু করতে পারি না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যশোর মেডিকেলের ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের একজন সাবেক নেতা মেডিভয়েসকে বলেন, ‘ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের কাজ হলো ইন্টার্ন স্বার্থ নিয়ে কাজ করা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। আর একজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে এভাবে পিটিয়ে মারধর হলো একটা মানববন্ধনও করলো না বা দাবিও জানাতে দেখলাম না। আমি অবাক হয়েছি, ইন্টার্ন চিকিৎসক পরিষদের কর্মকণ্ড দেখে।’
পুরো বিষয়টি নিয়ে শুক্রবার (৩ ফ্রেবুয়ারি) যশোর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মহিদুর রহমান মেডিভয়েসকে বলেন, ‘হামলায় আহত এবং হামলাকারীরা সবাই বন্ধু, গলায় গলায় খাতির ছিল, কোনো কারণে হয়তো দ্বন্দ হয়েছে।’ মারামারি কেন হয়েছে আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝতে পারছি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে সবার সাথে কথা বলে প্রতিবেদন দিতে বলেছি, সময় আরেকটু বেশিও লাগতে পারে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’
এএইচ
-
২৭ জুন, ২০২৪
-
২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
-
০৫ মার্চ, ২০২২
-
১৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২