১১ এপ্রিল, ২০২১ ০১:০৯ পিএম

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় রিয়াদের তৃতীয় হওয়ার গল্প

মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় রিয়াদের তৃতীয় হওয়ার গল্প
রিয়াদ। ছবি: সংগৃহীত

২০২০-২১ সেশনের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় তৃতীয় হয়েছেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজের শিক্ষার্থী মো. মার্জিউল হক রিয়াদ। পঞ্চম, অষ্টম ও এসএসসিতে স্কলারশিপ পাওয়া এ কৃতি শিক্ষার্থী ২০১৮ সালে ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০২০ সালে এইচএসসি সম্পন্ন করেন। ভর্তি পরীক্ষায় চমৎকার ফলাফলে উচ্ছ্বসিত রিয়াদ শোনালেন করোনা মহামারীতে নির্ভয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার লোভনীয় গল্প।

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. মনির উদ্দিন। 

অনুভূতি জানতে চাইলে মো. রিয়াদ বলেন, ‘খুবই ভালো লাগছে। এ পর্যায়ের যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা ছিল। সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশের শীর্ষ একটি পর্যায়ে তৃতীয় হওয়া—অবশ্যই ভালো লাগছে। আল্লাহ তায়াল রহমত করেছেন। সেজন্যই এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি।’ 

তবে অত বড় অর্জনে প্রত্যাশী ছিলেন না জানিয়ে রিয়াদ বলেন, ‘আসলে আমার প্রত্যাশায় ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ। এত ভালো হবে, ভাবিনি। যারা পরীক্ষায় অংশ নেয়, তাদের সবার এ রকম একটি প্রত্যাশা থাকে। কারণ এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাদা ভালো লাগা কাজ করে। ডিএমসি নামটা শুনলেই মনে অন্য রকম একটি অনুভূতি জাগে। সেখানে চান্স পাওয়াটাই বড় ব্যাপার, এর ওপর তৃতীয় হওয়া! এটা আসলে প্রত্যাশা করিনি।’ 

যাদের অবদানে এ অবস্থান

ভালো অবস্থানের আসার পেছনে কাদের অবদান বেশি—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সর্বাগ্রে আমার মায়ের কথা বলবো। কারণ ২০১০ সালের সাত ফেব্রুয়ারি আমার আব্বু সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। আমরা সিএনজির যাত্রী ছিলাম। সেদিন বাসের ধাক্কায় আব্বুকে হারাই। সেদিন আম্মু গুরুতর আহত হন। আমি বেঁচে যাই।’

দুর্ঘটনায় পিতাকে হারানোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জামালপুরের সরিষাবাড়ির সন্তান রিয়াদ বলেন, দুটি জেলা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তার পিতা দিনাজপুর ওয়াকফ এস্টেটের হিসাব নিরীক্ষক ছিলেন। সেই সুবাদে দিনাজপুর জিলা স্কুলে পরীক্ষা দেওয়া। সেখানেও ভর্তি হন তিনি। তবে বাড়ির কাছে হওয়ায় ময়মনসিংহ জিলা স্কুলেও পরীক্ষা দেন এবং ভর্তির সুযোগ পান। পিতার ইচ্ছাতে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি হন। 

এ সময় পিতা ময়মনসিংহে বদলির চেষ্টা করছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, সে লক্ষ্যেই মালপত্র আনতে দিনাজপুরে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার শিকার হন তারা। এতে পিতাকে হারান তিনি। পরে মাকে নিয়ে ময়মনসিংহে আসেন।  

রিয়াদ আরও বলেন, ‘পরিবার থেকে আমাকে আর্থিক সহযোগিতা করেন চাচারা। আমি পঞ্চম, অষ্টম ও এসএসসিতে বোর্ডের স্কলারশিপ পেয়েছি। আমার ভালো ফলাফল তাদের নজর কাড়ে। আমার এক চাচা আনন্দমোহন কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। আমার জেঠা পারিবারিক জমিজমার তত্ত্বাবধান করেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ অবদানের জন্য এ পর্যন্ত আসা সম্ভব হয়েছে।’ 

‘এছাড়া আমার শিক্ষকরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। জিলা স্কুলের শিক্ষকদের এতো ভালোবাসা পেয়েছি, যা অন্যরা প্রত্যাশাও করতে পারে না। এর পর আনন্দমোহন কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকেও যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছি’—বলেন রিয়াদ।  

চিকিৎসা বিজ্ঞানের কোন শাখায় নিজেকে দেখতে পছন্দ করেন—এমন প্রশ্নে সতর্ক ও হিসাবী জবাব রিয়াদের। তিনি বলেন, ‘এগুলো যেহেতু পরের ব্যাপার, আরও পাঁচ বছর পরে…। সে সময় হয় তো আমার মধ্যে আরও পূর্ণতা আসবে। তখন নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে আমার জন্য উপযোগী বিষয় বেছে নেবো। কাছে থেকে না দেখলে বোঝা যাবে না যে আমি মেডিকেলের কোন বিষয়ের জন্য যোগ্য।

যখন পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া কঠিন 

করোনায় পরীক্ষা আয়োজনের বিষয়ে রিয়াদ বলেন, ‘আমি চাচ্ছিলাম, পরীক্ষা হয়ে যাক। দুই বছর পর কিংবা দশ বছর হোক—পরীক্ষা দিতেই হবে। বিষয়টি মোটেও এ রকম না যে ভর্তি পরীক্ষা এড়িয়ে আমি মেডিকেল ভর্তির সুযোগ পাবো। এটা হয়ে যাওয়া মানসিক প্রশান্তির বিষয়। পরীক্ষাটা হওয়ার কথা ছিল আরও ছয় মাস আগে। এত দিন ধরে মানসিক চাপে থাকা…, শারীরিক শ্রমের চেয়ে মানসিক চাপটা বেশি যন্ত্রণাদায়ক। সময়টা প্রলম্বিত হলে নিজেকে পড়াশোনায় মনোযোগী রাখাটা বেশ কঠিন হয়ে যায়। পড়াশোনার গতিতে ভাটা পড়ে। আমাদের পরীক্ষাটা শুরু হয়েছিল, ২০১৮ সালের এপ্রিলে আর পরীক্ষা হলো ২০২১ সালের এপ্রিলে। টানা তিন বছর একই ধরনের পড়া চালিয়ে যাওয়াটা কঠিন। সেজন্য চাচ্ছিলাম, পরীক্ষাটা হয়ে যাক।’

নিজের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ

প্রস্তুতির বিষয়ে রিয়াদ বলেন, ‘মেইন বইটা আমি শতভাগ সম্পন্ন করি। এভাবে অন্যান্য বইও নব্বই ভাগ সম্পন্ন করি। দশ ভাগের জন্য আলাদা বইয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার চেষ্টা করিনি। এই পড়াগুলোই আমি বারবার রিভিশন দিতাম। বিশেষ করে কোশ্চেন সলভ—যত বেশি কোশ্চেন সলভ করা যাবে, তত বেশি ফলপ্রসূ হবে। বারবার পড়ার ফলে তখন একটি নতুন লাইন বা গুরুত্বপূর্ণ লাইন পাওয়া যাবে। একবার পড়লে হয় তো তা চোখে পড়ে না। যত বেশি পড়বো, তত আত্মস্ত হবে। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা এমসিকিউ পদ্ধতি হয়। তাই কোনো প্রশ্নোত্তর একদম মুখস্ত না থাকলেও প্রশ্ন দেখার পর সঠিক উত্তর বের করা সহজ হয়ে যায়। বারবার পড়ার সুবাদে এমন দক্ষতা তৈরি হয়। আর কোশ্চেন সলভের ফলে নিজের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা সহজ হয়ে যায় এবং এ নিয়ে বেশি বেশি কাজ করার সুযোগ তৈরি হয়। সতরাং দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পড়াশোনা নিয়মিতভাবে চালিয়ে যাওয়া, যাতে লাইনচ্যুত না হয়ে যাই। অন্যথায় পড়ালেখায় ফিরে আসা খুবই দুরুহ।’ 

করোনায় নির্ভয়ে চলে পড়াশোনা 

করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্ট অস্থিরতায় পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়েছিল কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘করোনায় মৃত্যু শঙ্কায় সবাই আচ্ছন্ন ছিল। আমরা সৃষ্টিকর্তার প্রতি সব সময় অনুগত থাকার চেষ্টা করি। এই সংকটে যথাসম্ভব আমরা সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করেছি। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসের একটি জায়গা আছে। আইফেল টাওয়ার থেকে পড়ার সময়ও বিশ্বাস করতে হবে, আমি তো এখনও মরিনি। আল্লাহ তায়ালা যত দিন হায়াত রেখেছেন, ততদিনই বাঁচতে পারবো। ভর্তির সুযোগ পেয়েছি, আমি আসলে চালাতে পারবো কিনা, তাও জানি না। কারণ এখনও করোনা পরিস্থিতি খারাপ। আজ আছি, কাল থাকবো কিনা, তাও অজানা। সুতরাং জীবন অনিশ্চয়তার। আমি চেষ্টা করেছি, আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে অবশ্যই সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে হবে। পরিবার খুব বেশি সমৃদ্ধ না, তাই বড় সন্তান হিসেবে দায়িত্বের একটি বিষয় আছে। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। করোনায় খুব বেশি আতঙ্কিত হইনি।’ 

পাঠ্য সূচির বাইরেও বই পড়ার তুমুল আগ্রহের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যথেষ্ট বই পড়ি। রবীন্দ্রনাথের বই আমি খুবই পছন্দ করি।’  

‘এছাড়া লেখাধূলায় আমার সম্পৃক্ততা বেশি। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কার অর্জন করেছি। এর মধ্যে দৌড়, গোলক নিক্ষেপ, উচ্চলম্ফ—এগুলোতে যথেষ্ট আগ্রহ আছে। ক্রিকেট খুব পছন্দ করি। সময় পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে খেলার চেষ্টা করি’, যোগ করেন তিনি।  

নিরিবিলি পরিবেশ পছন্দের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কোলাহলমুখর পরিবেশ আমার খুব একটি পছন্দের না। কারণ পড়াশোনার জন্য এটি খুবই জরুরি।’

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষা
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত