১৭ মার্চ, ২০২২ ০৬:৪৬ পিএম

সম্মাননায় দায়িত্ব বেড়ে গেছে: ডা. কামরুল

সম্মাননায় দায়িত্ব বেড়ে গেছে: ডা. কামরুল
অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম।

বাবাকে হারানোর পর মো. কামরুল ইসলামের ছোটবেলা ও শিক্ষাজীবন কেটেছিল সীমাহীন কষ্টে। তুখোড় মেধাবী এ শিক্ষার্থী এমবিবিএস ফাইনাল প্রফেশনাল পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে ১৯৮৯ সালে চিকিৎসক হন। এরপর থেকে স্বাস্থ্যসেবায় অকুতোভয় ও নিবেদিতপ্রাণ তিনি। কর্মজীবনে বেশ কিছু দিন কাজ করেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (নিকদু) ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

কিডনি প্রতিস্থাপন সেবাকে বেগবান করতে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল। রাজধানীর শ্যামলীর ওই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে করোনা মহামারীর থমকে যাওয়া সময়ে ৩০০ কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন মানবিক এই চিকিৎসক। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বাবার সম্মানে বিনা পারিশ্রমিকে সব মিলিয়ে এরই মধ্যে করেছেন ১০৭৩ কিডনি প্রতিস্থাপন। 

চিকিৎসা বিদ্যায় অবিস্মরণীয় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গত ১৫ মার্চ অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলামকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার। বুধবার (১৬ মার্চ) ব্যস্ততম মধ্যাহ্নে মেডিভয়েস মুখোমুখি হয় এই আরোগী শিল্পীর। সযত্ন পরিচর্যায় তুলে আনা হয় তাঁর সংগ্রামমুখর পথচলা, সাফল্যের অপ্রকাশিত অধ্যায় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: সাখাওয়াত হোসাইন। 

মেডিভয়েস: আপনার শৈশব ও কৈশোর সম্পর্কে জানতে চাই?

অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্ভবত আমাকে তৃতীয় শ্রেণিতে বাবা ভর্তি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সবই বন্ধ হয়ে গেল। আমার বাবাকে মুক্তিযুদ্ধে হারালাম। সেই স্মৃতি আসলে খুবই কষ্টের, মাঝে মাঝে মনে হয় যেন বুকে পাথর জমেছিল। যাই হোক, যত দিন যায়, ধীরে ধীরে সব ভুলে যেতে হয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো। আমরা চার ভাই, তার মধ্যে বড় ভাই কিছুটা মানসিক প্রতিবন্ধী ছিলেন আর আমি মেঝো। আমার ছোটজন সবেমাত্র স্কুলে যায়। আর সবার ছোটজন বাবা মারা যাওয়ার সময় বয়স ছিল পাঁচ দিন। চার ভাই আর আমার মা মনে হয় যুদ্ধে সাগরে পড়ার মত অবস্থা। আমরা পাবনা ইশ্বরদীর পাকশিতে নানি বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছি।

নানি বাড়িতে তিন ভাই আমরা, আর আমার চাচা তখন ঢাকাতে থাকতেন। উনি হোমিওপ্যাথি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। আমার চাচাতো ভাইরা আমার সমবয়সী ছিলেন, ফলে আমাকে চাচাদের সঙ্গে থাকার জন্য ঠিক করা হলো। সেই সুবাদে চাচাতো ভাইদের সঙ্গে ভালো স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়ে গেল। আমি কিছুদিন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পড়েছি, তারপর ধানমন্ডি ভয়েস স্কুলে। বিভিন্ন কারণে আমাকে আবার নানি বাড়িতে যেতে হলো। পাকশির চন্দ্রাপুর বিদ্যাপীঠ থেকে আমার এসএসসি পাস। সেই সময় অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। সে জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই। স্মৃতিগুলো খুবই সুন্দর মনে হয়েছে আমার কাছে।

বাসায় কোনো ঘড়ি ছিল না। সূর্যকে ঘড়ি বানিয়ে নিয়েছিলাম। আমার ওইখানে একটি পেপার মিল ছিল, সকাল পাঁচটা, আটটা ও বিকালে সাইরেন দিত। সাইরেন শুনে সময় নির্ধারণ করতাম। বাজারের পাশে আমার বাসা ছিল। যখন সময় জানার দরকার হত, তখন গেট খুলে পথযাত্রীদের কাছ থেকে সময়টা শুনে নিতাম। এ রকম একটা পরিবেশ থেকে আমাদের ওঠে আসা। কাগজ কেনার পয়সার খুব অভাব ছিল। আমার এক বন্ধু ছিল, সে অংকে খুব কাঁচা। ওর থেকে খাতা নিয়ে সমস্ত অংকগুলো করে দিতাম নোট বইয়ের মতো করে। সফলতা এই ছিল যে আমার কাজটা হয়ে যেত।

ইচ্ছা ও লক্ষ্য স্থির থাকে, সঙ্গে থাকে মেধা; এর সমন্বয়ে পরিশ্রম করলে আর্থিক অস্বচ্ছলতার বাধা দূর করা সম্ভব। এরপর এসএসসি পরীক্ষায় সম্ভবত আমি রাজশাহী বোর্ডে ১৫তম স্থান অধিকার করেছি। এটা আমার কাছে স্বপ্নের মত মনে হয়েছে। এরপর আমি ঢাকাতে আসলাম মামার বাসায়। আমার মামা তখন তৎকালীন পিজি হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন। একটা রুমে আমি আর আম্মা, মামা আর আমার এক ভাই একসাথে থাকতাম। পড়াশোনার জায়গাই ছিল না ধরা যায়।  তারপরও সেখানে বসে পড়াশোনা করতাম। আমার মা কি যে পরিশ্রম করেছেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার আব্বা যখন শহীদ হন, তখন মাত্র মেট্রিক পাস। মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি নানা বাড়িতে ইন্টারমিডিয়েট করলেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। সমাজকল্যাণে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন তিনি।

আমার মা থেকে অনেক শিক্ষনীয় জিনিস পেয়েছি। তিনি অত্যন্ত দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন। তিনি কারও কাছে হাত পাততেন না। আমাদেরতে শিখিয়েছেন দেওয়ার হাত, নেওয়া শিখাননি। এরপর যখন ঢাকায় আসলেন। আম্মা ১৯৭৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজকল্যাণে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। ঢাকায় এসে লালমাটিয়া মহিলা কলেজে অধ্যাপনার সুযোগ পেলেন। আম্মা সকাল আটটায় বের হয়ে যেতেন। রাত আটটায় বাসায় ফিরতেন। কলেজের অধ্যাপনার শেষ করে কয়েকটা টিউশনি করে বাসায় আসতেন। আমরা তিন ভাই, পড়াশোনা করে তাদের খরচ-সবকিছু আম্মা বহন করতেন। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে ঢাকা বোর্ডে সম্ভবত দশম স্থান অর্জন করেছি। এরপর ঢাকা মেডিকেলেও ভালো ফলাফল নিয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ হয়েছে, ১৯৮৯ সালে এমবিবিএস পাস করি। ৯০ এর দশকে আমরা ইর্ন্টানি করেছি। ফাইনাল এমবিবিএস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেছি। অনেকগুলো গোল্ড মেডেল পাওয়া হয়েছে।

আমার লেখাপড়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুঃখী মাকে শান্তি দেওয়া। কারণ আমি খুব ভালো করে জানতাম, আম্মা ভালো ফলাফল ছাড়া আর কোনো কিছুতেই খুশি হন না। এমবিবিএস পাস করেছি, উনি কখনও আমাকে ক্লিনিকে কাজ করতে দেননি। বলেছেন, আরও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নাও। এফসিপিএস কর। আমি প্র্যাকটিস শুরু করি এফসিপিএস করার পরে। এমবিবিএস করে হয়তো কারও অনুপস্থিতিতে একটা বা দুইটা ডিউটি করেছি। কিন্তু আম্মা কাজ করতে দেননি। বলতেন, আগে পড়াশোনা শেষ কর। আর আমি যখন প্র্যাকটিস শুরু করি আস্তে আস্তে আমাদের স্বচ্ছলতা দেখা দিলো, আমার ছোট ভাইও ইঞ্জিনিয়ার। তার আবার ক্যানসার ধরা পড়লো। তাকে চিকিৎসা করানো হলো, এক পর্যায়ে মারা গেল সে। আমার আম্মা এখনও বেঁচে আছেন। সেটাই আমার সবচেয়ে বড় সম্পদ। আল্লাহ উনাকে নেক হায়াত দান করুক। আমার সবচেয়ে অনুপ্রেরণা আমার মা।

মেডিভয়েস: রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই?

অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম: আমার তিনটা প্রতিক্রিয়া বলতে পারেন। আমার, জনগণ ও সরকারের প্রতিক্রিয়া? আমি প্রথমেই সরকারকে সাধুবাদ জানাই। সরকার খুঁজে খুঁজে এ রকম একটা বড় পুরস্কার আমার মতো নগণ্য ব্যক্তিকে দিয়েছে। আমার উপর দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। তার বড় কিছু হলো অনুপ্রেরণা। আর যারা ভালো কাজ করছেন, তারা যে কি অনুপ্রাণিত হবেন বলে বোঝানো যাবে না। আমার মতো এ রকম মানুষকে সরকার খুঁজে খুঁজে পুরস্কার দেয়, তাহলে অনেকেই অনুপ্রাণিত হবেন। তারা ভালো কাজ করতে থাকবেন, আমাদের দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।

মেডিভয়েস: আপনার জীবনে সাফল্যের নেপথ্য কী?

অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম: পরিশ্রম আর মেধার বিকল্প নেই। সাফল্যের জন্য আপনাকে পরিশ্রম করতেই হবে। আল্লাহ প্রদত্ত কিছু মেধা থাকে, কিন্তু আপনাকে শান দিতে হয়। শান দিলে এটা প্রখর হয়। শান দেওয়ার উপায় হচ্ছে বই পড়া। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নেওয়া। দেখা কাজটা করা। পড়ার সময় যেসব কমপ্লিকেশন হয়, সেসবের আউটকাম ভালো করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখা। প্রতিনিয়ত কাজের ধরন পরিবর্তন করতে হবে, যাতে ভালো আউটকাম দেওয়া যায়। পরিশ্রম করতেই হবে। আমি যদি শুধু বসে বসে চিন্তা করি, তাতে কিন্তু কখনই ভালো আউটকাম আসবে না।

মেধা ও শিক্ষা অর্জন করতে হবে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম খরচে ভালো পাওয়া যায়, সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র শিক্ষা। শিক্ষার দ্বারা যেটা অর্জন করা সম্ভব, অন্য কিছুতেই সেটা অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের এক সময় কিছুই ছিল না। মেধা, শিক্ষা আর কাজ করতে করতে এ জায়গায় আসা। এ সাফল্যের পেছনে কাজ করেছে শিক্ষা, পরিশ্রম আর মেধা।

মেডিভয়েস: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই?

অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম: আমাদের দেশের গরিব রোগীদের আরও বেশি করে সেবা দেওয়া যায়, আরও বড় পরিসরে অনেক মানুষকে যাতে সেবা দিতে পারি—এটাই আমার মূল পরিকল্পনা। আমাদের সেবার গুণমান আরও বাড়ানো যায়, সেদিকে আরও বেশি মনোযোগ দিব। আমরা বাণিজ্যিকভাবে অতিরিক্ত খরচ চাই না, সেবার মানটা ঠিক রাখতে। সেটা আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে হচ্ছে। সে জিনিসটাই যেন, আমাদের দেশেও হতে পারে সেদিকে মনোযোগী হতে চাই।

মেডিভয়েস: এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই, দেশের তরুণ চিকিৎসকরা অনেক সময় বেতন-ভাতায় স্বল্পতার কারণে হতাশ হয়ে পড়ছেন এবং প্রফেশনও পাল্টাচ্ছেন। তাদের জন্য আপনার পরামর্শ?

অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম: অর্থনৈতিক বাধা বড় বাধা নয়, এখনকার সমাজে বাধাটা আরও কমে আসছে। আমরা যখন ইন্টার্নি করি, তখন আমাদেরকে ২ হাজার ৫০০ টাকা দিত। আমি আড়াই হাজার টাকা থেকে এক হাজার টাকা খরচ করতাম। আরও দেড় হাজার টাকা বাঁচিয়ে রাখতাম। পরবর্তী এক বছরের এফসিপিএস কোর্সের জন্য। সেই সময় আমি কোনো জায়গায় কাজ করতে চাইতাম না, যাতে আমি পুরো সময়টা পড়াশোনায় ব্যয় করতে পারি।

শিক্ষাজীবনে আমরা অর্থনৈতিক ইনকামের দিকে না যাই। যেটুকু প্রয়োজন, থাকা-খাওয়া আর বইপত্র কেনার জন্য, সেটুকু কাজ করতে হবে। আর বাকি সময়টা লেখাপড়া, লেখাপড়া আর লেখাপড়া। এ সময় যদি লেখাপড়া না করি। বাকি জীবনে সেই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়। লেখাপড়ার সময় লেখাপড়া আর প্রশিক্ষণের সময় প্রশিক্ষণ এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এমন কিছু শিক্ষার্থীকেও দেখেছি, ভালো ফলাফল করে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে। সে আবার টিউশনি করছে। টিউশন যদি প্রয়োজন হয় তাহলে করবা। কিন্তু প্রয়োজন না হলে করার দরকার নেই। এখন টাকা ইনকামের সময় নয়। এখন সবচেয়ে সময় পড়াশোনা আর প্রশিক্ষণের। যত বেশি পারা যায়, শিক্ষা অর্জন করার এবং এটাই আমার বড় উপদেশ। যত দিন পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ না হবে, ততদিন পর্যন্ত অতিরিক্ত ইনকামের পেছনে না দৌড়ানো উচিত।

টাকার পেছনে না ছুটে কাজের পেছনে ছুটতে হবে। তাতে ফলাফল ভালো আসবে। ভালোভাবে তৈরি হতে পারলে রোগী আপনার পেছনে লাইন ধরবে। আমাদের যে বড় দেশ, রোগীর অভাব হবে না, লাইন ধরে থাকবে। পরিশ্রমী হতে হবে। আমরা যদি দুইটা রোগাী দেখি। এক হাজার টাকা ভিজিট না নিয়ে পাঁচশত টাকা নিয়ে দুইটা রোগী দেখলেই হয়। আমি এক হাজার টাকা ভিজিট না নেই। তা তো খুব বেশি কষ্ট বাড়বে বলে মনে হয় না, অল্প একটু কষ্ট বাড়বে। এ দেশের জন্য একটু কষ্ট করলে আপনি মনে তৃপ্তি পাবেন।

যে গরিব রোগীটা আপনার কাছে আসছে, সেও অনেক তৃপ্তি পাবে। কাজেই আমি দুইটা অপারেশন করি। একটা অপারেশনে অতিরিক্ত টাকা না নিয়ে। দুই অপারেশেনে অর্ধেক করে টাকা নেই। তাতেই অনেক উপকার হয়। আমার এটাই উপদেশ টাকার পেছনে না ছুটে ফলের পেছনে ছুটেন। আপনি যে কাজ করছেন, সে কাজের আউটকামটা যেন ভালো হয়। ভালো আউটকাম দেওয়ার পেছনে ছোটা উচিত।

ভালো করার জন্য যত পরিশ্রম করা দরকার, সব করতে হবে এবং কোনো রোগীর যদি কোনো কারণে ক্ষতি হয়, সেক্ষেত্রে সহানুভূতির দৃষ্টি রাখা উচিত। সে রোগীটার যাতে কষ্ট লাঘব হয়, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখা উচিত। কাজেই, কাজের দিকে না ছুটে ফলের দিকে ছুটলে এমনিতেই টাকা আসবে।

মেডিভয়েস: দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে আপনার পরামর্শ জানতে চাই? 

অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম: নীতি নির্ধারক পর্যায়ে যারা আছেন, তারা ভালো বলতে পারবেন। সার্বিকভাবে, স্বাস্থ্য সেবা খাতে আমরা যারা অংশীদার চিকিৎসক। আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ রোগী গরিব। আমরা যদি গরিব রোগীর চিন্তা মাথায় রাখি। তাহলে কখনও রোগীর অভাব হবে না। আমরা যদি ভালো সেবা ও আউটকামের চিন্তা মাথায় রাখি, তাহলে রোগী দেখে কূল পাওয়া যাবে না।

মেডিভয়েস: উপজেলা পর্যায়ে এখনও কিডনি বিশেষজ্ঞ নেই, এ বিষয়ে আপনার মতামত?

অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম: এ ব্যাপারে সরকার ব্যাপক চিন্তা ভাবনা করছে। কিডনির ব্যাপারে সরকার অনেক আন্তরিক। অনেক ডায়ালাইসিস সেন্টার করার পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় যাতে ট্রান্সপ্যালান্ট হয়, সে ব্যাপারে আমাকেও মন্ত্রণালয় ডেকে ছিল। সরকারের আন্তরিকতা রয়েছে এবং চেষ্টা করছে। আমরা ধারণা এটা আরও বিস্তৃতি লাভ করবে। অনেক দিন জাতীয় কিডনি হাসপাতালে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট বন্ধ ছিল। সেখানে আমিও গিয়ে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে দিয়ে আসছি। ঢাকা মেডিকেলে রোযার আগে হয়তো কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার পরিকল্পনা রয়েছে। সিএমএইচে করে দিয়ে এসেছি। আবার খবর এসেছে, সেখানে তারা রোগী রেডি করছে।

ঢাকার বাহিরে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয় না। যেসব রোগী ঢাকার ভিতরে বিভিন্ন সেন্টারে বিশেষ করে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানে হওয়া প্রয়োজন, তাদের চিকিৎসক নার্সরা এসে আমাদের এখানে ট্রেনিং করছে।

আমি চাই, আমাদের সেবাটা সরকারি হাসপাতালে বিস্তৃতি লাভ করুক। সেদিকে কাজ করছি। অনেক চিকিৎসক আসছেন, যারা ট্রান্সপ্ল্যান্টের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আর আমার সাথে যারা করেছেন, তাদের অনেকেই ভালো সার্জারি করতে পারেন। অধ্যাপক তপন, অধ্যাপক তানভীরসহ আরও অনেক চিকিৎসক রয়েছেন, যারা আমাদের সাথে কাজ করেছেন এবং বেশ ভালো সামর্থবান। কাজেই তাদেরকে যদি সুযোগ দেওয়া হয়, তারাও কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট সেবা অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।

মেডিভয়েস: আগামী দিনে যারা মেডিকেল শিক্ষায় আসতে চায়, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ জানতে চাই?

অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল ইসলাম: শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেডিকেল সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা রয়েছে। অনেক পড়াশোনা করতে হয়। অনেক মুখস্ত করতে হয়। এ রকম একটি ধারণা রয়েছে। এটা ঠিক নয়। আসলে মোটা মোটা বই বটে, চিন্তা করে পড়লে বেশি সময় ধরে পড়া লাগে না।

মেডিকেল অঙ্গনে অনেক সময় শুনে শুনে পড়াশোনা করলেও আপনি পাস করে যাবেন। এতো বেশি কঠিন নয়, সামনেই আপনার যন্ত্র পড়ে আছে। মানুষই হলো আপনার যন্ত্র। এ যন্ত্রের মধ্যে নরমাল কি হচ্ছে, ফিজিক্যাল কি হচ্ছে, প্যাথলজিক্যাল কি হচ্ছে--এগুলো আপনার সামনে বসে বসে রোগীর দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু চিন্তা করতে পারবেন। শুধু চিন্তা করলেই প্রায় ৫০ শতাংশ পড়া হয়ে যায়। শিক্ষকরা যখন পড়াবেন, তখন মনোযোগ সহকারে পড়বেন। প্রতিদিন পড়বেন।

একজন চিকিৎসক যে সার্ভিসটা দিতে পারবেন, তা অন্য সার্ভিস থেকে অনেক বেশি। ধরেন, একজন চিকিৎসক, তার একজন আত্মীয়-স্বজনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার খোঁজ-খবর নিলেন। সে যে কতটা খুশি হবে..! অন্য প্রফেশনে এ রকমটা করার সুযোগ নেই। বাসায় কেউ অসুস্থ হলে তাঁর জন্য যে সেবাটা দিতে পারবেন। অন্য কোনো সার্ভিস হলে সেটা দিতে পারবেন না।

মেডিকেল শিক্ষাটা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। এত মানুষকে উপকার করা সম্ভব, আত্মীয়-স্বজন হোক, বন্ধু-বান্ধব হোক। আর আমার কাছে কত বন্ধু-বান্ধব আসে, যারা এত আমাকে ভালোবাসে, জানি না কেন ভালোবাসে? আমার করতে কোনো কষ্ট হয় না। একটু পরামর্শ দেওয়া, একটু ওষুধ লিখে দেওয়া, একটু পরীক্ষা করা, এটুকুই। আমার কোনো কায়িক পরিশ্রম লাগে না। আর তারা অনেক খুশি হয়। যা অন্য প্রফেশন দিয়ে কখনই করা সম্ভব নয়। মেডিকেল প্রফেশনে পড়লে আমার ধারণা, সামাজিক সক্ষমতা অনেক বাড়ে। অন্য প্রফেশনে সেই সক্ষমতাটা বাড়ানো কষ্টকর। একজন শিক্ষক ও ইঞ্জিনিয়র চাইলেই এটা পারবে না। মেডিকেলের একজন চিকিৎসক চাইলেই করতে পারে।

 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক