ডা. মুহাম্মাদ সাঈদ এনাম ওয়ালিদ

ডা. মুহাম্মাদ সাঈদ এনাম ওয়ালিদ

চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কলামিস্ট, জনস্বাস্থ্য গবেষক।


০৮ এপ্রিল, ২০২৫ ০২:৪০ পিএম

বিক্ষোভ-ভাঙচুর-লুটপাট: বৈশ্বিক পরিমণ্ডল ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি

বিক্ষোভ-ভাঙচুর-লুটপাট: বৈশ্বিক পরিমণ্ডল ও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি
সম্প্রতি সিলেটে দুটি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। ইনসেটে ব্রিটেনের লন্ডনে বিক্ষোভকালে পুড়িয়ে দেওয়া একটি প্রতিষ্ঠানের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত

এইতো কয়েক বছর আগে আমেরিকার মিনিয়াপলিস শহরে জর্জ ফ্লয়েড নামের একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের পুলিশের পায়ের নীচে নির্মম মৃত্যুতে বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে তরুণ সমাজ। পুলিশের হাঁটুর নীচে ফ্লয়েডের শেষ আকুতি ‘I can’t breathe’ আমেরিকার তরুণ ও যুব সমাজের হৃদয়কে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

এ ঘটনায় প্রতিবাদের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যে। লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সময় অনেক জায়গায় সহিংসতা, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়াসহ নানা শহরে দোকানপাটে আগুন, পুলিশের গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ এবং হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শোরুম, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও সুপারমার্কেট লুট হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে বহু শহরে কারফিউ জারি ও ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করতে হয়।

আশ্চর্যের বিষয় হলো, এত কিছুর পরও আমেরিকার একজন নাগরিকের মুখেও শোনা যায়নি—‘এই দেশ জঙ্গিদের হাতে চলে গেছে’ কিংবা ‘এ দেশে আর থাকা যায় না’—এমন দেশবিরোধী মন্তব্য। কোন সংবাদকর্মী প্রতিবেদনের শিরোনাম করেনি—‘খ্রিস্টান মৌলবাদী জঙ্গিদের দখলে চলে গেলো আমেরিকা’। বরং তারা সবাই মিলে নিজেদের সমস্যাকে স্বীকার করেছে, সমাধানের পথ খুঁজেছে রাষ্ট্র ও নাগরিক—উভয়ের অংশগ্রহণে।

এমন দৃশ্য বহুবার দেখা গিয়েছে যুক্তরাজ্যেও। লন্ডন, বার্মিংহাম, ব্রিস্টল, ম্যানচেস্টারসহ বহু শহরে ঘটেছে বড় ধরনের বিক্ষোভ। এক আন্দোলনের সময় ব্রিস্টলে ১৭ শতকের দাসব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কলস্টনের মূর্তি বিক্ষোভকারীরা টেনে নদীতে ফেলে দেয়। কিশোর-তরুণদের অনেকেই নেমে পড়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও তাণ্ডবে। ২০১১ সালের লন্ডনের এক দাঙ্গায় প্রায় ১৮০০ দোকান লুট হয়, আর্থিক ক্ষতি হয় বিলিয়ন বিলিয়ন পাউন্ডের। এতো কিছুর পরও কোন বৃটিশকে নিজেদের রাষ্ট্র নিয়ে চরম নেতিবাচক মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। কোনো পত্রিকার শিরোনাম হয়নি—‘দেশ খ্রিস্টান জঙ্গিদের দখলে চলে যাচ্ছে।’ বরং তারা সবাই মিলে উদ্ভুত পরিস্থিতিকে ধৈর্য্য, আইন ও ন্যায়-নীতির মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু আমাদের দেশে এরকম কিছু একটা ঘটলেই দেখা যায় এক শ্রেণির দালাল বা দেশদ্রোহী মনের মানুষের উৎপাত। ‘সব শেষ’, ‘সব গেল’, ‘দেশ ছাড়ো’, ‘এই দেশ জঙ্গিদের হাতে চলে গেছে’, ‘এ দেশে আর থাকা যাবে না’—এমন দেশবিরোধী ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব করে। জাতি হিসেবে আমাদের এই আত্মবিশ্বাসহীনতা, নেতিবাচকতা ও দেশবিদ্বেষমূলক মানসিকতাই আমাদের উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। দেশের সমস্যা থাকতেই পারে—কিন্তু সমাধানও আছে। জাতির ক্রান্তিলগ্নে নাগরিকদের সচেতনতা, গঠনমূলক সমালোচনা ও সম্মিলিত প্রয়াস কাম্য; মেকি কান্না, দেশদ্রোহী মন্তব্য আর দেশদ্রোহী অপেশাদার বক্তৃতা-বিবৃতি নয়।

আন্দোলনের নামে ধ্বংস, লুটতরাজ, হানাহানি, সন্ত্রাস কাম্য নয়। তবে মানুষ হিসেবে মানুষের ভুল কখনো কখনো হয়ে যেতে পারে। প্রয়োজন শোধরাবার, প্রয়োজন সুস্থ মন-মানসিকতা নিয়ে সমাধানের, দেশের দুর্নাম রটানো নয়। কেননা, এতে দেশেরই ক্ষতি হয়।

পরিশেষে, আমরা যদি উন্নত বিশ্বের মতো গঠন মূলকভাবে নিজেদের সমস্যা সমাধান  করতে না শিখি, দেশপ্রেমে উজ্জীবিত না হই, ভিনদেশের দালালি করা বন্ধ না করি, ফেইক ছবি বানিয়ে প্রচার-প্রোপাগান্ডা বন্ধ না করি, তাহলে আমাদের এই সোনার দেশ এগোবে কীভাবে? আর কতদিন আমরা ভিনদেশে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ট্যাক্সি-উবার চালিয়ে, রেস্তোরাঁয় খাদেম হয়ে কিংবা গৃহপরিচারিকার কাজ করে দিন কাটাবো?

এনএআর/

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : আন্দোলন
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত