ডা. শাহজাদা সেলিম 

ডা. শাহজাদা সেলিম 

সহযোগী অধ্যাপক,
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় 


০৩ মার্চ, ২০২২ ১০:১৪ এএম

জীবন-যাপন পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ

জীবন-যাপন পরিবর্তনের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
যতটুকু ওজন কমানো প্রয়োজন, ততটুকু হাঁটতে হবে। ছবি: সংগৃহীত।

প্রচুর পরিমাণে খেলে রক্তে গ্লুকোজ প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়। যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদের বাড়ে এবং যাদের ডায়াবেটিস নাই তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সবাই একটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশেষ করে কম বয়সীরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে, তারা ফাস্টফুড জাতীয় খাবার বেশি খায়। এসব খাবারে প্রচুর ক্যালরি রয়েছে। শুধু ক্যালরি বা শর্করা নয় চর্বিও যুক্ত রয়েছে। 

নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন

অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপনের কারণে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীবন-যাপনের ভুল পদ্ধতি ডায়াবেটিস হতে সহায়তা করছে। তাই জীবন যাপন পদ্ধতিতে শৃঙ্খলা আনতে হবে। খাদ্য ব্যবস্থাপনার শৃঙ্খলা দিয়ে শুরু করতে হবে। যেমন: একবারে অনেক বেশি খাওয়া যাবে না। আবার দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকা যাবে না। খাবারের একটা হিসেব থাকবে। যার ওজন বেশি তার ওজন কমাতে সাহয্য করবে এটি। যার ওজন কম তার ওজন বাড়াতে সহযোগীতা করবে। যার ওজন ঠিক আছে তার ওজন ঠিক রাখবে। এ খাবার পদ্ধতি যদি নিয়মে নিয়ে আসা যায় অর্থাৎ সুষমে খাবার খাওয়া যায়, তাহলে লাইফস্টাইলের মূল ভীত রচিত হয়ে গেল।  

যেভাবে জীবন-যাপন করতে হবে

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যবস্থাপনা হলো খাদ্য ব্যবস্থাপনা। কোনো ওষুধ না দিয়ে শুধু লাইফস্টাইলের মাধ্যমে ডায়াবেটিস চিকিৎসা করা যাবে। ডায়াবেটিস বুঝার জন্য Rbs পরীক্ষা করা হয়। কারো রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৬ দশমিক ৫ শতাংশ থাকলে খুব ভালো। ৭ শতাংশের নিচে থাকতেই হবে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস নতুন আক্রান্তদের শুধু খাদ্য ব্যবস্থাপনা দিয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ২ শতাংশ কমানো সম্ভব। এই দুই শতাংশ গ্লুকোজ মুখে খাওয়ার ওষুধ দিয়ে কমানো সম্ভব নয়, ইনসুলিন দিয়ে সম্ভব। পুরাতন রোগীদের যারা খাদ্য ব্যবস্থাপনা ও শারীরিক পরিশ্রম কিছু কিছু মেনে চলেছেন এবং কিছু কিছু মেনে চলেন না তাদের এক শতাংশ কমানো সম্ভব। একজন রোগী কিছু খাদ্য নিয়ম মেনে চলছেন, কিছু ওষুধ খাচ্ছেন, কিছু ইনজেকশন নিচ্ছেন কিন্তু খুব ভালো মেনে চলছেন না। এ ধরনের রোগী কখনো ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। রক্তের গ্লুকোজ বেশি থাকবে। যেটি রোগীর জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি। 

অতিরিক্ত লবণ খাওয়া বন্ধ করতে হবে

রান্নার তেল খুবই খারাপ। যা মানুষ নিয়মিত খেয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া আমাদের দেশের মানুষের লবণ খাওয়ার প্রবণতা বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশের মানুষের লবণ খাওয়ার প্রবণতা প্রতিদিন ৬ দশমিক ৮ থেকে ১৮ গ্রাম। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হলো-একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ ৫ গ্রাম লবণ খাবেন। দেখা যাচ্ছে, নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে সবাই বেশি লবণ খাচ্ছেন। চিকিৎসকরা অনেক আগ থেকেই বলে আসছেন লবণ উচ্চ রক্তচাপের কারণ। এখন এটি সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। অতিরিক্ত লবণ খেলে ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পায়। 

শারীরিক পরিশ্রমের গুরুত্ব

সকল ডায়াবেটিস রোগীকে অবশ্যই শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। দেশে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। এটিকে অনেকে বলে দ্রুত নগরায়ন। স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করে তারা এটিকে বলে অস্বাস্থ্যকর নগরায়ন। গ্রাম এখন নগরায়ন হয়ে গেছে। মানুষ প্রচুর পরিমাণে যান্ত্রিক সুবিধা পাচ্ছে। ফলে, প্রায় শ্রমহীন একটি জাতীতে পরিণত হচ্ছে আমাদের দেশের মানুষ। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, চাকরিজীবী ও অবসরপ্রাপ্ত  সবাই শ্রমহীন। কারণ, এরা যেসব কাজ করছে, এতে ক্যালরি ব্যয় হয় না। মানুষ যতটুকু খাবার খায় ততটুকু ব্যবহার করে না। ফলে, সকল বয়সের মানুষ দৈহিক স্থূলতা আক্রান্ত হচ্ছে। আজকের দৈহিক স্থূলতা কালকের ডায়াবেটিস রোগী। স্থূলতার কমানোর জন্য কায়িক শ্রম করতে হবে। যার স্ট্রোক হয়ে এক পা, এক হাত অবশ হয়ে গেছে তাকেও শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। একজন ডায়াবেটিস রোগীর হাটতে গেলে কোমরে ব্যথা, তাকেও শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে। গর্ভকালীন অবস্থায়ও শারীরিক ব্যায়াম করতে হবে। 

যেভাবে ব্যায়াম করতে হবে

চিকিৎসকের কাজ হলো রোগীকে শারীরিক ব্যায়ামের কাঠামোতে দাঁড় করানো। যার এক পা, এক হাত অবশ, তাকে যে হাত ভালো আছে তা দিয়ে ব্যায়াম করতে হবে। কারো যদি দুই পা অবশ থাকে তিনি পেট, বুক হাত ও কাঁধের ব্যায়াম করবেন। যার দুই পা, দুই হাত অবশ তিনি ঘাড় ও মাথার ব্যায়াম করবেন। কোনোভাবেই ব্যায়াম থেকে দূরে থাকা যাবে না। গর্ভকালীন মহিলাদের জন্য বিশেষ ধরনের ব্যায়াম আছে। স্ট্রোকের রোগীদের জন্য বিশেষ ধরনের ব্যায়াম আছে। তাহলে সকলেই এই কাঠামোর মধ্যে থাকবেন। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ৯৮ শতাংশ টাইপ-২ এর অধীন। দুইটি কারণে ডায়াবেটিস হয়। যথা-এক. শরীরে ইনসুলিন তৈরি হচ্ছে কম। দুই. ইনসুলিন তৈরি হচ্ছে কিন্তু কাজ করতে পারছে না। ইনসুলিন কাজ করার জন্য রোগীকে অবশ্যই শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। না হলে এ কাজ করতে না পারাটা দিনদিন বাড়বে। ওষুধের পরিমাণ বাড়বে কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। দেশে ৬৮ থেকে ৮০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী মারা যাচ্ছে হৃদরোগ অথবা স্ট্রোকের কারণে। এটির প্রধান কারণ ইনসুলিন রেজিটেন্স। ডায়াবেটিস কমাতে হবে নতুবা এ ধরনের মৃত্যু ঠেকানো অসম্ভব। এজন্য বয়স্ক হোক, মধ্যবয়সী হোক, সকল বয়সীদের শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। মহিলারা যারা কখনো ঘরের বাহিরে যান না, তারা ঘরের মধ্যেই ব্যায়াম করতে হবে। ছাদে সুযোগ থাকলে ছাদে ব্যায়াম করতে হবে। না হলে ব্যায়ামের মেশিন ক্রয় করতে হবে। সাইকেল চালিয়ে ব্যায়াম করা যেতে পারে। রশি লাফ খেলা যায়। বাসা বড় হলে তার মধ্যে ব্যায়াম করতে হবে। প্রতিদিন একই সময় ব্যায়াম করতে পারলে ভালো। 

হাঁটার পরিমাণ

যাদের ডায়াবেটিস হয় তাদের বেশির ভাগ লোকের ওজন বেশি। তাই তাদের ওজন কমাতে হবে। যতটুকু ওজন কমানো প্রয়োজন ততটুকু হাঁটতে হবে। যাদের শারীরিক অবস্থা ভালো তারা সপ্তাহের ৭ দিনই হাত পা ছড়িয়ে ত্রিশ মিনিট করে হাঁটবেন। এটি সবচেয়ে আদর্শ একটি পদ্ধতি। যারা কাজের কারণে সারাদিন হাঁটার সময় পান না, তারা সপ্তাহের ছুটির দিনে একশ পঞ্চাম মিনিট হাঁটবেন। ১০ থেকে ১২ কেজি ওজন কমাতে হলে প্রতিদিন চল্লিশ মিনিটে চার কিলোমিটার হাঁটতে হবে। যাদের ৩০ থেকে ৪০ কেজি ওজন কমাতে হবে তাদের প্রতিদিন ৫০ মিনিটে ৫ কিলোমিটার হাঁটতে হবে। শুরুতে কষ্ট হবে। একজন পর্দাশীন নারী প্রতিদিন বাহিরে যায় না। তাকে বাসায় ব্যায়াম করতে হবে। অনেকের কাজের কারণে দিনের বেলা বাহিরে গিয়ে হাঁটা সম্ভব নয়। যেমন: কেউ ব্যবসা করে। ওনার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই কোনদিন কোন কাজ করবেন। তাকেও নিয়ম করে হাঁটতে হবে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে হাঁটতে হবে এবং শারীরিক পরিশ্রম করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

এএইচ 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত