টানা দুই ঈদ ভাতাবিহীন বেসরকারি ৯ প্রতিষ্ঠানের রেসিডেন্ট, নন-রেসিডেন্ট চিকিৎসকরা
নবাব আব্দুর রহিম: পাঁচ মাস ধরে ভাতা পাচ্ছেন না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) অধিভুক্ত নয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ১৬৭ রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্ট চিকিৎসক। ফলে বহু শিক্ষার্থীর কাছে এই কোর্স অব্যাহত রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনও।
এসব চিকিৎসকরা বলছেন, প্রাপ্য ভাতা পেতে বিএসএমএমইউ, নিজ প্রতিষ্ঠান প্রধান ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছেন তারা। কিন্তু আশ্বাস দেওয়া হলেও কোনো ফল মিলছে না। তাদের প্রশ্ন, সুযোগ-সুবিধার কথা জেনেই তারা ভর্তি হয়েছিলেন, অধ্যয়নরত অবস্থায় সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হবে কেন?
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএসএমএমইউ অধিভুক্ত ১১ প্রতিষ্ঠানের রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের ভাতা বন্ধ হয় গত জানুয়ারিতে। এর মধ্যে দুটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্নভাবে ভাতার ব্যবস্থা করলেও বাকি নয় প্রতিষ্ঠানে তা সম্ভব হয়নি। এসব প্রতিষ্ঠানের নন-রেসিডেন্টরা (ডিপ্লোমা) গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ভাতা পাচ্ছেন না। আর রেসিডেন্ট চিকিৎসকরা (এমএস/এমডি) পাচ্ছেন না চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। এ ছাড়া কেউই গত বছরের জুলাই থেকে বকেয়া পাননি।
জানা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিএসএমএমইউ অধিভুক্ত বেসরকারি নয় প্রতিষ্ঠানে মোট ১৬৭ জন রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্ট চিকিৎসক রয়েছেন। এর মধ্যে মোট ৩৯ জন রেসিডেন্ট এবং নন-রেসিডেন্ট ১২৮ জন। ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আন্দোলনে নামেন এসব চিকিৎসক। গত মার্চে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রাইভেট ট্রেইনি ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের চার দফার আন্দোলনেও ছিল রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্টদের ভাতা বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি। পরে বিভিন্ন সময়ে বিএসএমএমইউ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এসব চিকিৎসক। স্মারকলিপি দেন বিএসএমএমইউর সার্জারী অনুষদের ডিন বরাবর। যোগাযোগ করেন ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. দীন মো. নূরুল হকের সঙ্গেও। এ ছাড়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করেও বিফল হয়েছেন তারা।
গত ১১ মে ডিন বরাবর দেওয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্টদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত মাসিক পারিতোষিক প্রদান করা হত। কিন্তু পূর্ব নির্ধারিত কোনো বিজ্ঞপ্তি ছাড়া বেশ কয়েক মাস আগে হঠাৎ করে পারিতোষিক প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকদের মাসিক পারিতোষিক প্রদানের ব্যাপারে কোনো যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত বা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। এমতাবস্থায় প্রশিক্ষণরত রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্টদের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা ও প্রশিক্ষণে মনোনিবেশ করা কষ্টসাধ্য ও দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে।’
এ বিষয়ে বেসরকারি নয় প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত রেসিডেন্ট ও নন-রেসিডেন্ট চিকিৎসকদের সমন্বয়ক ও চট্টগ্রামের ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অফথালমোলোজির রেসিডেন্ট চিকিৎসক ডা. মাসুম পারভেজ মেডিভয়েসকে বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছিল ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর জেনারেলদের নিয়ে মিটিং করা হবে। কিন্তু এটা নিয়ে এখনও কোনো মিটিং হয়নি। কেউ আমাদের বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে চায় না। এড়িয়ে চলছে।’
এই চিকিৎসক বলছেন, ‘সরকার থেকে অর্থায়ন করবে না, আবার ইনস্টিটিউট থেকেও দিচ্ছে না। তাহলে কে দেখবে আমাদের? এভাবে তো আমরা চলতে পারব না। পাঁচটা বছর কিভাবে চলব? সামনে ঈদ আছে। আমরা চাই এটা নিয়ে যাতে কথা বলে, সমাধান হয়।’
রাজধানীর লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেসিডেন্ট চিকিৎসক ডা. মুনতাহা জারীন আফরোজ বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা দিয়েছি বা ভর্তি হয়েছি, তখন কিন্তু আমাদের বলা হয়নি যে আমরা ভাতা পাব না। পরে শুনতে পেলাম আমাদের ভাতা বন্ধ। এরকম কোনো নিয়ম হলে পরের সেশন থেকে চালু হওয়া উচিত। এখন আমার সাপোর্ট নাই, পাঁচ বছরের দীর্ঘ কোর্স; আমার তো কোর্স কন্টিনিউ করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘বলা হচ্ছে, ইনস্টিটিউট ভাতা দিবে। অথচ কোর্স কন্ডাক্ট করছে বিএসএমএমইউ। ভর্তি হতে বা পরীক্ষা দিতে যে ফিস লাগে তা কিন্তু আমি বিএসএমএমইউতে দিচ্ছি। আমার পরীক্ষা নিচ্ছে বিএসএমএমইউ। আমি ভর্তি হয়েছি বিএসএমএমইউর অধীনে। কোনো ইনস্টিটিউট দেখে তো ভর্তি হইনি। এখন ইনস্টিটিউটকেই যদি ভাতা দিতে হয়, তাহলে ইনস্টিটিউটকে তো বিএসএমএমইউ থেকে এ সংক্রান্ত লিখিত অর্ডার দিতে হবে। এরকম কিছুই করা হয়নি। আমরা এই যে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি স্যারদের কাছে, স্যারদের পিএসদের কাছে, কিন্তু কোনো দিকেই ফলপ্রসূ কিছু হচ্ছে না। তাহলে আমাদের দায়িত্বটা কে নিল?’
তবে বিএসএমএমইউ সূত্র বলছে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণার্থীদের দায়িত্ব মন্ত্রণালয় নিতে চাচ্ছে না। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই বিএসএমএমইউর কিছু করার নেই।
এ বিষয়ে কথা হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এবিএম আব্দুল হান্নান মেডিভয়েসকে বলেন, ‘এটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিষয়। তবে তাদের সুব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে কী করা যায়।’
এর আগে, চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান স্বাক্ষরিত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ বা পরিচালকের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এই ভাতা বন্ধের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ইনস্টিটিউটসমূহে নন-রেসিডেন্সি এমফিল/এমমেড/এমপিএইচ/ডিপ্লোমা প্রভৃতি কোর্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীগণের মাসিক পারিতোষিক/বৃত্তি প্রদান করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আপত্তি নেই। তবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি বিধায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রেসিডেন্ট/নন-রেসিডেন্টগণের পারিতোষিক/বৃত্তি প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট রেসিডেন্টগণের পারিতোষিক/বৃত্তি প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে।’
এতে আরও বলা হয়েছে, ‘মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট রেসিডেন্ট/নন-রেসিডেন্টগণের উক্ত পারিতোষিক/বৃত্তি প্রদান করা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তাদের রেসিডেন্টদের পারিতোষিক/বৃত্তি প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দের অনুমোদন নিয়েছেন। এভাবে অন্যান্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজ/ইনস্টিটিউট ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ বরাদ্দের অনুমোদন নিতে পারে। বিষয়টি আপনার অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হলো।’
উল্লেখ্য, বিএসএমএমইউর অধিভুক্ত বেসরকারি নয় প্রতিষ্ঠানে ১২৮ জন নন-রেসিডেন্টে মধ্যে ঢাকার ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১৯, লায়ন্স চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ১২, ডা. এমআর খান শিশু হাসপাতালে ১৭, আদ দ্বীন মহিলা মেডিকেল কলেজে ১৩ ও ইন্সটিটিউট অব উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড হেলথে রয়েছেন নয়জন। ঢাকার বাইরে বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজে ১৯, যশোরের আদ দ্বীন সকিনা মহিলা মেডিকেল কলেজে ১৫, চট্টগ্রামের ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অফথালমোলোজিতে ১৬ এবং আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালে রয়েছেন আটজন নন-রেসিডেন্ট।
এ ছাড়া ইস্পাহানীতে ১০, লায়ন্সে ছয়, এমআর খান শিশু হাসপাতালে তিন ও ইনস্টিটিউট অব কমিউনিটি অফথালমোলোজিতে ২০ জন রেসিডেন্ট রয়েছেন।
এনএআর/
-
০৪ জুলাই, ২০২৪
-
২০ এপ্রিল, ২০২৪
-
০৯ এপ্রিল, ২০২৪
-
০৭ এপ্রিল, ২০২৪
ভাতা ছাড়া দশ মাস
সহস্রাধিক প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকের বিবর্ণ ঈদ
-
০৪ এপ্রিল, ২০২৪
-
২৮ মার্চ, ২০২৪
ঈদের আগে বকেয়া ভাতা প্রদানের আশ্বাস
প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের কর্মবিরতি স্থগিত
-
২৭ মার্চ, ২০২৪