২৩ মার্চ, ২০২৩ ০৫:৩৭ পিএম

বর্ণান্ধে স্বপ্ন ভঙ্গ বহু তরুণের 

বর্ণান্ধে স্বপ্ন ভঙ্গ বহু তরুণের 
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাবিশ্বে এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। এটা জন্মগত বা বংশগত রোগ।

মো. তাওহিদুল ইসলাম: মো. হাসান রাকিব, রাজধানীর একটি কলেজ থেকে সদ্য স্নাতক শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু দেশের চাকরির বাজারের কঠিন লড়াইয়ের কথা ভেবে ক্যারিয়ার গড়তে সাজান নতুন পরিকল্পনা। কিন্তু হঠাৎ তার পরিকল্পনা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। বিবর্ণ হয়ে আসে তার নতুন স্বপ্ন। রাকিব চেয়েছিল ভাষা শিখে সরকারিভাবে দক্ষিণ কোরিয়া যেতে। কিন্তু এ পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় তার কালার ব্লাইন্ড বা বর্ণান্ধতা। কারণ এ সমস্যায় আক্রান্তদের কোরিয়া নেওয়া হয় না। উন্নত বিশ্বে তো বটেই, বরং বাংলাদেশেও কিছু কিছু পেশায় বর্ণান্ধদের কাজে যুক্ত হওয়া সম্ভব হয় না।

কালার ব্লাইন্ডনেস বা বর্ণান্ধতা হলো নির্দিষ্ট রং চেনা বা চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে অক্ষমতা। সাধারণত চোখের কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ না করলে এই সমস্যা হয়। বর্ণান্ধতা হলো চোখের দৃষ্টিশক্তির এমন একটি অবস্থা, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক আলোয় বিশেষ কিছু রঙের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পান না। নীল, সবুজ, হলুদ বা লাল রং আলাদা করে চেনা কিংবা এসব রঙের সংমিশ্রণ দেখে বুঝতে পারা তাদের জন্য কষ্টকর। মূল রংটি আসলে কী, সেটি বুঝতে তাদের হিমশিম খেতে হয়। আবার তারা যে ভুল রং দেখছেন, কেউ বলে দিলেও তা ধরতে পারেন না।

মানুষের চোখের ভেতরে রেটিনায় দুই ধরনের আলোকসংবেদী কোষ (photoreceptor) আছে। তা হলো, রডকোষ (rod) এবং কোন্‌কোষ (cone)। কোনকোষ থাকার জন্য আমরা বিভিন্ন রং চিনতে পারি এবং বর্ণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। অর্থাৎ আমাদের রঙিন বস্তু দর্শনে কোন্‌কোষগুলো সহায়ক। কিন্তু রডকোষ কোনো ধরনের রং চিনতে সাহায্য করে না, বরং শুধু দর্শনের অনুভূতি জাগায়।

কোন্কোষ আবার তিন ধরনের। তা হলো কোন্ লাল, সবুজ ও নীল। এই তিনটি মৌলিক রং শনাক্ত করতে পারে। চোখের রেটিনায় এই তিন প্রকারের কোন্ (cone)-এর যেকোন একটি, দুটি বা সবগুলোর অনুপস্থিতি অথবা ত্রুটিই হলো বর্ণান্ধতার মূল কারণ।

রাকিব মেডিভয়েসকে বলেন, আগে জানতেন না, তিনি বর্ণান্ধ। কোরিয়ান ভাষা শিখতে কোচিংয়ে ভর্তি হতে যাবেন, এমন সময় শুনেন কালার ব্লাইন্ড হলে দেশটিতে যাওয়া যায় না। এরপর গুগল থেকে নিজের কালার ব্লাইন্ড পরীক্ষা করে দেখেন তিনি বর্ণান্ধ।

তিনি আরও বলেন, ‘বর্ণান্ধ বিষয়ক তেমন কোনো চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি। ডাক্তার দেখিয়ে ভালো হবো, সে সুযোগও নেই। এরপর থেকে কোরিয়া যাওয়ার আশা বাদ দিয়েছি।’

দক্ষিণ কোরিয়ার শিল্প খাতে প্রতিবছর কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মী সরকারিভাবে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মীদের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। শুধু কোরিয়ান ভাষা শিখলে নামমাত্র খরচে মাসে দেড় লাখ টাকার বেশি বেতনে চাকরি নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়া যায়।

দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ২০০৭ সালে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি হয়। এই চুক্তির ভিত্তিতে ২০০৮ সাল থেকে দেশটিতে দক্ষ কর্মী পাঠানো শুরু করে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) ও দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস অব কোরিয়া (এইচআরডি কোরিয়া) কর্মী পাঠানোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। ২০২৩ সালে সাড়ে সাত হাজার কর্মী নেওয়ার কথা রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার।

দক্ষিণ কোরিয়া যেতে প্রার্থীর ভাষা পরীক্ষা, কালার ব্লাইন্ড (বর্ণান্ধতা) কি না, সেটি পরীক্ষা করা হয়। এরপর প্রার্থীর নিজ নিজ জেলায় সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিতে হয়। সেখানে রক্ত পরীক্ষা, যক্ষ্মা ও হেপাটাইটিস ‘বি’ পরীক্ষা করা হয়। এসব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে একজন প্রার্থী দক্ষিণ কোরিয়া যেতে পারেন।

রাকিবের মতো মো. হাসিবুর রহমানও বর্ণান্ধ। তার স্বপ্ন ছিল সেনাবাহিনীর অফিসার হওয়ার। সে অনুযায়ী তিনি ২০১৬ সালে এইচএসসি পাস করার পর সেনাবাহিনীর অফিসার পদে আবেদন করেন। কিন্তু বর্ণান্ধ হওয়ার কারণে প্রাথমিক বাছাই পর্ব থেকেই তার স্বপ্নও মাটি হয়ে যায়। শুধু বর্ণান্ধত্বের জন্য হাসিব-রাকিবের মতো হাজারো যুবকের স্বপ্ন অধরাই থেকেই যায়।

হাসিব মেডিভয়েসকে বলেন, ‘ইন্টার পাস করার পর আমি সেনাবাহিনীতে আবেদন করি। কিন্তু আমার এক চোখে সমস্যার কারণে আমাকের নেওয়া হয়নি। আমার চোখের পাওয়ারের সমস্যা ছিল, আর বর্ণান্ধর সমস্যাও আছে। মূলত যাদের এমন সমস্যা আছে তাদের সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয় না।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারাবিশ্বে এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। এটা জন্মগত বা বংশগত রোগ। তবে কোনো ব্যক্তি বর্ণান্ধ হলে মারাত্মক কোনো ক্ষতি নেই। শুধু সামরিক বাহিনীসহ কিছু ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা। এ ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা নেই। আর বর্ণান্ধত্বের সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশে নেই।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চক্ষুবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আব্দুল ওয়াদুদ মেডিভয়েসকে বলেন, বর্ণান্ধতা প্রধানত জন্মগত হয়। বিভিন্ন পেশায় যোগদানের সময় আই টেস্টের মাধ্যমে এ সমস্যা চিহ্নিত হয়। শুধু বাংলাদেশেই না, এখন পর্যন্ত বিশ্বের কোথাও এই রোগের চিকিৎসা নেই।

তিনি বলেন, এই রোগ বংশগতই হয়। তবে এ ছাড়াও কিছু কিছু রোগের কারণেও হতে পারে। তবে এটা বিরল, বেশিরভাগই হয় বংশগত। জন্মগত ছাড়া অন্য কোনো কারণে বর্ণান্ধ হলে সেটা ভালো হয়। কিন্তু জন্মগত হলে আর ভালো হয় না।

জানতে চাইলে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. সৈয়দ মুহাম্মদ আসিফুর রহমান মেডিভয়েসকে বলেন, বর্ণান্ধ বা কালার ব্লাইন্ড জন্মগত বা বংশগত রোগ। এর কোনো চিকিৎসা এখনও পর্যন্ত বিশ্বে আবিষ্কার হয়নি। তবে এতে কোনো মারাত্মক ক্ষতি নেই। শুধু সামরিক বাহিনী, আনসারসহ এমনকি মেরিনাদের ফিটনেস টেস্টের মধ্যে কালার ব্লাইন্ড টেস্ট আছে। এখানে কেউ যদি বর্ণান্ধ হয়, তাহলে সে এসব বাহিনীতে চাকরি করতে পারবেন না।

তিনি বলেন, ‘আমাদের চেম্বারে অনেকে আসেন। যারা দেশের বিভিন্ন বাহিনীতে চাকরি করতে ইচ্ছুক। তারা বর্ণান্ধ কি-না এ ব্যাপারে চিকিৎসক হিসেবে আমরা তাদের সার্টিফিকেট দেই । ইশিহারা চার্টের মাধ্যমে তাদের বর্ণান্ধের অবস্থা লিখে দিতে হয়। এই সার্টিফিকেট যে বাহিনীতে যেতে ইচ্ছুক সেখানে সাবমিট করতে হয়। এখানে যারা বর্ণান্ধ তারা বাদ পড়েন।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে বর্ণান্ধ হওয়ার পরও জোর করেন, যাতে তাকে সমস্যামুক্ত হিসেবে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। কিন্ত একজন চিকিৎসক হয়ে তো আমরা এটা করতে পারি না।’

বর্ণান্ধের পরিসংখ্যান নিয়ে ডা. সৈয়দ মুহাম্মদ আসিফুর রহমান বলেন, পুরো বিশ্বে এর কোনো চিকিৎসা নেই। আর বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বর্ণান্ধ হাজারো তরুণের স্বপ্ন পূরণে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

তিনি বলেন, পৃথিবীতে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি কালার ব্লাইন্ড। এতে শুধু কিছু কিছু চাকরিতে প্রবেশে সমস্যা হয়। বিভিন্ন বাহিনীতে আর রোগী যদি নিজেই ডাক্তার হন, তাহলে তাকে এই সম্পর্কিত সাবজেক্ট না নেওয়ার জন্য বলা হয়।

 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত