২০ কোটি টাকার খাবার বিল: যা বললেন ঢামেক পরিচালক
মেডিভয়েস রিপোর্ট: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনাভাইরাস চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও কর্মীদের জন্য মাসে ২০ কোটি টাকা খরচ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে থেকে শুরু করে এর ব্যাপ্তি ছড়িয়েছে জাতীয় সংসদেও। অধিবেশনে এক মাসের খাবারের বিল কী করে এতো টাকা হয়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে এই খরচের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন।
মঙ্গলবার (৩০ জুন) বিকেলে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে তিনি ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।
ঢামেক পরিচালক বলেন, ‘এখানে খাবারের বিল কেন হবে, খাবারের জন্য তো মাত্র ৫০০ টাকা করে পার্মানেন্ট। একদিনে কোনো হোটেলের ভাড়া দুই হাজার টাকা, কোনো হোটেলের ৫০০ টাকা, কোনো হোটেলের আড়াই হাজার টাকা এবং কোনো হোটেলে পাঁচ হাজার টাকাও আছে। হোটেলের ভাড়াই তো ম্যাক্সিমাম এক্সপেনডিচার, তারপর হচ্ছে তাদের খাবার ও যাতায়াত। আমাদের এখানে যাতায়াতের জন্য প্রায় ১৫টি মিনিবাস, দুটি মাইক্রোবাস ও দুটি বাস রেখেছি। এগুলো দিয়ে প্রতিদিন তিন বেলা (সকাল, দুপুর, রাত) তাদের আনা-নেওয়া করা হচ্ছে। এই সবকিছু মিলিয়ে আমরা আনুমানিক বলেছিলাম যে, দুই মাসে (মে ও জুন)...।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল, এই দুই মাসের জন্য আপনার কি পরিমাণ খরচ হতে পারে? ওই খরচটাই আমরা উল্লেখ করেছি। আমরা হিসেব করে দেখেছি- দুই মাসে আমাদের ২০ কোটি টাকার মতো লাগবে। এখানে রেলওয়ে হাসপাতাল আছে একটি, সেটিও আমরা চালাচ্ছি এবং তার জন্য এক কোটি টাকা ধরেছি। সবমিলিয়ে এক কোটি টাকা লাগতে পারে আবার নাও লাগতে পারে।’
এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘এটা তো একটা বাজেট। বাজেট তো একটু বেশি করেই আমরা চাই সবসময়। তারপর আমাদের যে বিল এসেছে, আমরা স্ক্রুটিনাইজ করে দেখব। যার যতো বিল হবে হোটেলে, আমরা সে অনুযায়ী তাকে বিল পে করব। যেটি থেকে যাবে সেটি আবার সরকারের কোষাগারে জমা চলে যাবে। এটা তো একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া’।
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, আমরা আমাদের এক্সপ্লানেশন দিয়ে দিব- কীভাবে খরচ করছি, কোন খাতে কত ব্যয় হচ্ছে। আমাদের পয়েন্ট হচ্ছে- যে সব ভদ্রলোকেরা বিভিন্ন মিডিয়াতে এ ধরনের মিথ্যাচার করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং করোনা পরিস্থিতিতে আমরা যেভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সবাই কাজ করছি, এই যে এক ধরনের মিথ্যা কথা বলে তাদেরকে অপদস্থ করা হলো- এটি যিনি করেছেন তার বিরুদ্ধে কি করা হবে, সেটি আমরা জানতে চাই?’
নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রমাণ দেব, আমরা যদি অ্যাট ফল্টে থাকি। আমরা তো সরকারি কর্মকর্তা, আমাদের বিষয়ে তো নিশ্চয়ই সেই সিদ্ধান্ত হবে যদি আমরা সঠিকভাবে কাজ না করি। কিন্তু যিনি বা যে প্রতিষ্ঠান বা যে ব্যক্তি এই মন্তব্য করে আমাদের চিকিৎসক সমাজ ও আমাদের এই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানকে অপদস্থ করেছে, আমি তার বিচার চাই।’
ঢামেকে এক মাসে ২০ কোটি টাকার খাবারের বিল ‘অস্বাভাবিক’: প্রধানমন্ত্রী
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এক মাসের খাবারের বিল ২০ কোটি টাকা হওয়াকে অস্বাভাবিক বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন এত টাকা কী করে হয়, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সোমবার (২৯ জুন) জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে এমন মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘২০ কোটি টাকা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এটা আমরা পরীক্ষা করে দেখছি। এত অস্বাভাবিক কেন হবে? যদি কোনো অনিয়ম হয় আমরা ব্যবস্থা নেব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোভিড-১৯ চিকিসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্পূর্ণ সরকারি খরচে হোটেলে থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে থাকা-খাওয়ায় একমাত্র মেডিকেল কলেজের (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) হিসাব অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে বলে বিরোধীদলীয় উপনেতা যেটা বলেছেন, এটা অস্বাভাবিক মনে হয়। আমরা তদন্ত করে দেখছি, এত অস্বাভাবিক কেন হলো? এখানে কোন অনিয়ম হলে আমরা তার ব্যবস্থা নেবো।’
সংসদনেতা বলেন, ‘যন্ত্রপাতি, টেস্ট কিট, সরঞ্জামাদি কেনাসহ চিকিৎসা সুবিধা আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে আমরা দ্রুততম সময়ে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছি। আরও একটি প্রকল্প চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে করোনা মোকাবিলায় আমাদের সামর্থ্য আরও বাড়বে বলে বিশ্বাস করি।’
ঢামেকে খাবার বিলের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি চিকিৎসকদের, প্রচারিত সংবাদের প্রতিবাদ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে চিকিৎসকসহ দুই হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য মাসে ২০ কোটি টাকা খরচের বিষয়ে প্রচারিত খবরের প্রতিবাদ জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলেন, খাওয়া বাবদ এতো টাকা খরচ করা হলে প্রতিবেলায় তাদের বুফে খাওয়া-দাওয়া করা সম্ভব হতো। ভুতুড়ে এ বিলের সঙ্গে চিকিৎসকদের সম্পৃক্ততা নাই উল্লেখ করে এ ব্যাপারে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রকাশের দাবি জানান তারা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ডক্টরস ফাউন্ডেশনের (বিডিএফ) প্রধান সমন্বয়ক ডা. নিরুপম দাশ মেডিভয়েসকে বলেন, ‘এখানে চিকিৎসকদের মাসব্যাপী কি কি খাওয়ানো হয়েছে, তা আমরা দেখেছি। তাদেরকে যে মানের খাবার দেওয়া হয়েছে, তাতে ২০ কোটি টাকা কিভাবে খরচ হলো? এক মাসে এত টাকা খরচ করতে কমপক্ষে ১০ লক্ষ ডাক্তারকে খেতে হবে। এত টাকা খরচ দেখিয়ে মূলত ডাক্তারদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুই হাজার ডাক্তার যদি ২০ কোটি টাকার খাবার খান তাহলে প্রতিজনে ১৬৬৬ করে খরচ হওয়ার কথা। কিন্তু যে মানের খাবার তারা পেলেন তা ৫০০ টাকায় পাওয়া যাবে। এখানে চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা আসা অমূলক। এই মানের খাবার দিয়ে ২০ কোটি টাকা কিভাবে খরচ হলো এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষকে জবাব দিতে হবে। এতো টাকা খরচ হলে তাঁরা প্রতিবেলায় বুফে খেতে পারবেন। আমরা এটা কোনোভাবেই মানতে পারছি না যে, দুই হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর জন্য ২০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এটার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া জরুরি।’
টিম বিডিএফ চেয়ারম্যান ডা. মো. শাহেদ রফি পাভেল এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘গত দুইদিন ধরে একটি খবর ভাইরাল হচ্ছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতাল দুইশ’ চিকিৎসকের জন্য এক মাসে ২০ কোটি টাকা খরচ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘গত ২ মে থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কোভিড-১৯ এর রোগী ভর্তি শুরু করে। বর্তমানে সাত শতাধিক রোগী এ ইউনিটে ভর্তি আছে। দুই হাজার চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী দুই মাসের থাকা, খাওয়া ও যাতায়াতের জন্য হাসপাতাল জুন শেষের বাজেট চেয়েছেন ২০ কোটি টাকা। সরকারি বরাদ্দ একজন চিকিৎসকের তিন বেলা খাবারের জন্য ৫০০ টাকা। তথাকথিত রিপোর্টে বলা হলো, দুইশ’ চিকিৎসক এক মাসে খরচ করেছে ২০ কোটি টাকা। সবাই ট্রল করলো যার যেমন অংকে জ্ঞান আছে সেভাবে। বিচিত্র সব মানুষ জন।’
এই পোস্টের কমেন্ট সেকশনে ডা. মো. হাফিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি অনেক দূর গড়িয়েছে। আজ জাতীয় সংসদে পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে আগেই বিষয়টির প্রতিবাদ করা উচিত ছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। এখন তো পাবলিকের কাছে এ ম্যাসেজ পৌঁছে গেছে এক মাসে করোনাকালে শুধুমাত্র ঢামেকের ডাক্তাররা খাবার বিল বাবদ বিশ কোটি টাকা খরচ করে ফেলেছে। এমনও কথা শুনতে হয়েছে, ভালো হোটেলে ইচ্ছে মতো খেয়ে তারা এমন বিল উঠিয়েছে।’
কমেন্টে ডা. শোয়াইব জাহিদভি বলেন, ‘খুব বাজেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তত্য যাচাই না করে স্বাস্থ্য বিষয়ক এ রকম সংবাদ যাতে উপস্থাপন না করে, এজন্য এখন থেকেই এই বিষয়ক প্যানেল রাখলে ভালো হয়। নিউজগুলো খুবই স্পর্শকাতর হয়।’
একই পোস্টে কমেন্ট করেন হোটেল রিজেন্সিতে অবস্থানরত ডা. তারিক আহাসান। সেখানকার খাবারের মানহীনতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘হোটেল রিজেন্সির খাবার। রং দেখে খাবারের মান বোঝা যাবে না। মান বুঝতে হলে স্বাদ নিতে হবে। খাবার খাওয়াকে তারা অত্যাচারের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কোয়ারেন্টাইন শেষ হলে বাঁচি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুলশানের হোটেল স্ট্রিং হিলে অবস্থানরত একজন চিকিৎসক মেডিভয়েসকে বলেন, খাবার-দাবারের মান একেক হোটেলে একেক রকম। এটা নির্ভর করে আমরা আসলে কোথায় অবস্থান করছি। এখানে দুই লিটার একটি পানির বোতলের দাম রাখা হয় ১২০ টাকা, যা বাইরে মাত্র ত্রিশ টাকা। হোটেলের হিসাবটা আলাদা। আমাদের খাবারের মান মোটামুটি ভালো। খাবার বাবদ যত খরচ দেখানো হয়েছে, এতো আসার কথা না। আমাদের সকালের নাস্তায় দুটি পরটা, একটি ডিম ও সবজি থাকে। এতে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা আসতে পারে। দুপুরে একটি এক প্লেট ভাত, ভর্তা, ডাল আর মাছ অথবা মুরগি দেওয়া হয়। এজন্য সর্বোচ্চ আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকা বিল হতে পারে। এভাবে রাতের খাবারে সম-পরিমাণ খরচ হবে। এ হিসেবে দিনে সর্বোচ্চ ৭-৮শ’ টাকা আসতে পারে। সেখানে দিনে দেড় হাজারের উপরে খরচ দেখানো হয়েছে, এটা অভাবনীয়।’
-
৩১ মার্চ, ২০২৪
-
০১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪
-
০৯ নভেম্বর, ২০২৩
-
১৬ অক্টোবর, ২০২৩
-
২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
-
৩১ অগাস্ট, ২০২৩
-
২২ জুন, ২০২৩
-
০২ জুন, ২০২৩