২৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৭:৪১ পিএম

বছরজুড়ে চিকিৎসক নিগ্রহ: নেই যথাযথ পদক্ষেপ

বছরজুড়ে চিকিৎসক নিগ্রহ: নেই যথাযথ পদক্ষেপ
বছর জুড়ে চিকিৎসক নিগ্রহের কিছু ছবি।

সাখাওয়াত হোসাইন: দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বছর জুড়েই ঘটেছে চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা। তবে নিগ্রহ বন্ধে নেওয়া হচ্ছে না যথাযথ পদক্ষেপ। এসব ঘটনার পর্যালোচনা বা সুষ্ঠু তদন্তও হয়নি, হয়নি কোনো বিচার। ফলে অরক্ষিত রয়েছে চিকিৎসকদের কর্মস্থল। নিগ্রহের ঘটনার জন্য কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকেই দুষছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

এসবের মধ্যে পার হতে যাচ্ছে আরেকটি বছর, আসছে নতুন বছর। এভাবে সময়ের চাকা ঘুরলেও নিগ্রহের ঘটনাগুলোর কোনো বিচার না হওয়ায় উদ্বিগ্ন চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যখাত রক্ষায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। তাতে দেশের স্বাস্থ্যখাতের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে বলে অভিমত তাদের।

নিগ্রহ পরবর্তী ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সহকর্মীদের সাময়িক কিছু কর্মসূচি ও প্রতিবাদ কিংবা কর্তৃপক্ষের হুমকি আর হুঁশিয়ারিতে কাজ না হওয়ায় আবারও কাজে ফিরে চিকিৎসকরা। এভাবে নিগ্রহের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে।

চিকিৎসক নিগ্রহ নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ানোর আতঙ্কে থাকার পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবার মনোবলও হারিয়ে ফেলেন চিকিৎসকরা। এজন্য চিকিৎসকদের ওপর আক্রমণ এড়াতে পূর্বের ঘটনাগুলো তদন্ত করে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে। একই সঙ্গে দেশের চিকিৎসাখাতের লোকবল বৃদ্ধিসহ সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

তাঁরা বলছেন, তুচ্ছ ঘটনার পাশাপাশি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল চিকিৎসার অভিযোগে এসব নিগ্রহের ঘটনা ঘটে। কিন্তু পুরো বিষয়টি তদন্ত করে প্রকাশ্যে না আনায় মানুষের মনে কথিত ভুল চিকিৎসার বিষয়টি গেঁথে যায়। এতে এক দিকে যেমন চিকিৎসকরা মনোবল হারান, তেমনি রোগীও হারান স্বাস্থ্যখাতের প্রতি আস্থা।

সারা বছরে চিকিৎসক নিগ্রহের আলোচিত ঘটনা

গত ১২ মার্চ ভোরে জামালপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে মেডিসিন ওয়ার্ডে রোগীর মৃত্যুর পর তিনজন ইন্টার্ন চিকিৎসকের উপর হামলা ও মারধর করে রোগীর স্বজনরা। এর প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা।

এ ঘটনায় হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মাহফুজুর রহমান জামালপুর সদর থানায় একটি অভিযোগ দেন। আহত তিন ইন্টার্ন চিকিৎসক মঞ্জুরুল হাসান, ফাহমিদুল ইসলাম ও তুষার আহমেদকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, ওই দিন রাত ৩টা ৫০ মিনিটে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে জামালপুর সদর উপজেলার রশিদপুর এলাকা থেকে গুল মাহমুদ নামের এক মুমূর্ষু রোগীকে আনা হয়। জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি করে দেন। রোগীকে যখন মেডিসিন ওয়ার্ডে নেওয়া হয়, তখন চিকিৎসকরা নারী ওয়ার্ডে অন্য রোগী দেখছিলেন। ওই রোগীর খবর পেয়ে পরে চিকিৎসকরা পুরুষ ওয়ার্ডে আসেন। এর আগে ইন্টার্ন চিকিৎসকরা ওই রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মৃত দেখতে পান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওই রোগীর স্বজনরা ইন্টার্ন চিকিৎসক মঞ্জুরুল হাসান ও ফাহমিদুল ইসলামের ওপর হামলা করেন। দ্বিতীয় তলায় থাকা আরেক ইন্টার্ন চিকিৎসক তুষার আহমেদ ওই ওয়ার্ডে গেলে তাঁকেও মারধর করা হয়। এ ছাড়া রোগীর স্বজনেরা চিকিৎসকদের একটি কক্ষের কম্পিউটার, প্রিন্টার, টেলিভিশন, রোগী দেখার যন্ত্রপাতি, চেয়ার ও টেবিল ভাঙচুর করেন।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (এডি) মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মুমূর্ষু অবস্থায় ওই রোগীকে জরুরি বিভাগে আনা হয়েছিল। পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে ওই রোগীকে দেখার সুযোগ না দিয়ে চিকিৎসকদের ওপর ন্যক্কারজনকভাবে হামলা করা হয়েছে। এ ঘটনায় থানায় একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।’

চট্টগ্রামে চিকিৎসককে মারধর, গ্রেপ্তার ৬

১৪ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরের বেসরকারি মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রিয়াজ উদ্দিন শিবলুকে বেধড়ক মারধর করা হয়। এ ঘটনায় মামলায় প্রধান সন্দেহভাজনসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

পুলিশ জানায়, নগরীর ওআর নিজাম রোডের মেডিকেল সেন্টার হাসপাতালের এনআইসিইউতে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ সময় তাকে রোগীর স্বজনরা বেধড়ক মারধর করেন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় ডা. রিয়াজ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। এই ঘটনায় শিশুটির বাবার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৮-২০ জনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

জানা গেছে, ১৩ এপ্রিল রাত ১০টায় ব্রঙ্কোনিউমোনিয়া জটিলতা নিয়ে এক শিশু ভর্তি হয় মেডিকেল সেন্টারের এনআইসিইউতে। পরদিন সকাল সাড়ে ৯টায় শিশুটি মারা যায়। এরপরই ডা. রিয়াজের ওপর হামলা চালায় শিশুটির বাবাসহ তাঁর স্বজনরা।

টাঙ্গাইলে চিকিৎসকের উপর হামলা-ভাঙচুর

২৬ মে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (পূর্বের শেখ হাসিনা মেডিকেল) আবাসিক চিকিৎসক (শিশু) ডা. মো. আবু তাহেরের উপর হামলা ও চেম্বার ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় নিন্দা জানায় চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)।

বিএমএ জানায়, গত ২৫ মে দুপুর আড়াইটার দিকে টাঙ্গাইল শহরের পূর্ব আদালত পাড়ায় ডা. আবু তাহেরের বাসার নিচতলায় নিজস্ব ব্যক্তিগত চেম্বারে খিচুনী অবস্থায় এক শিশুকে তাঁর স্বজনরা নিয়ে আসেন। ওই চেম্বারে রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদানের ব্যবস্থা না থাকায় সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকের উপর হামলা চালান এবং চেম্বার ভাঙচুর করেন। এতে তিনি গুরুতর আহত হন।

ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসকদের উপর হামলা

রোগী মৃত্যুর ঘটনায় অবহেলার অভিযোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩১ আগস্ট চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পরে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ পালন করেন দেশের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ঘটনায় জড়িত অভিযোগে সঞ্জয় পাল জয় নামে একজনকে গাইবান্ধা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

চিকিৎসকরা জানান, মোটরসাইকেলে গুরুতর আহত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আহসানুল ইসলামের চিকিৎসায় অবহেলায় মৃত্যুর অভিযোগে চিকিৎসকদের মারধর করা হয়। মারধরের ঘটনায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) প্রকৌশল বিভাগের ওই শিক্ষার্থী বন্ধুকে বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়ে মিরপুরে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় গুরুতর জখম হন। আশপাশের লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি মারা যান। এর কয়েক ঘণ্টা পর রাতে একই হাসপাতালে লোকজন ঢুকে একজন রোগীকে অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে। এ সময় চিকিৎসকদেরও মারধর করা হয়।

হাত-পা বেঁধে হাসপাতাল মালিকের চিকিৎসক নির্যাতন

গত ১৪ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে মুক্তি প্রাইভেট হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পারভেজ আহমেদকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতনের অভিযোগ উঠে হাসপাতালের মালিক মো. হাবিবুর রহমান খন্দকার ও পরিচালক জসিম উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে। পরে হাসপাতালের একটি কক্ষ থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে নবীনগর থানা পুলিশ। মেডিভয়েসকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

মামলার সূত্রে জানা যায়, ডা. পারভেজ আহমেদ ১৪ তাঁরিখ দুপুর দেড়টা পর্যন্ত তাঁর কর্তব্য ডিউটি শেষ করে রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এ অবস্থায় হাসপাতাল মালিক খন্দকার মো. হাবিবুর রহমান ডাকাডাকি করলে ডা. পারভেজ আহমেদ জানান, তাঁর ডিউটি শেষ। এ সময় জরুরি কোনো রোগী ছাড়া বাইরে যেতে অপরাগতা প্রকাশ করেন তিনি। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে খন্দকার হাবিবুর রহমান ও জসিমসহ অজ্ঞাত ৪/৫ জন তাঁর রেস্ট রুমে জোরপূর্বক প্রবেশ করে তাকে  এলোপাতাড়ি পিটিয়ে মারাত্মক জখম ও বিবস্ত্র করে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখে।

হাসপাতালের ম্যানেজার ঝরনা ঘোষ গণমাধ্যমকে জানান, ‘একজন রোগী এলে আমি রিসিট কেটে ডাক্তার সাহেবকে গিয়ে বলি, স্যার একজন রোগী এসেছে, তখন ডাক্তার সাহেব উত্তেজিত হয়ে আমাকে জানান, আমার এখন কোনো ডিউটি নেই, আমি যেতে পারবো না, তোমার মালিককে জানিয়ে দাও। পরে হাসপাতালের মালিক হাবিব স্যার এসেও ডাক্তার সাহেবকে অনুরোধ করেন রোগী দেখার জন্য। কিন্তু ডাক্তার সাহেব কারো কোনো কথাই মানতে নারাজ। এ নিয়ে তাদের মাঝে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় হাবিব স্যারও আহত হয়েছেন।’

জানতে চাইলে ওসি হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে। একজন আসামিকে (পরিচালক জসিম উদ্দিন সরকার) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলাটি আমরা তদন্ত করছি, বাকি ছাড়া ঘটনায় জড়িত ছিল তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হবে। আমাদের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’

কক্সবাজারে মারধরের ঘটনায় গ্রেপ্তার ২

১০ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার সদর হাসপাতালে করোনারী কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) এক রোগীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. সজিব কাজীকে মারধরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দুইজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে মেডিভয়েসকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ।

তিনি বলেন, চিকিৎসককে মারধরে অভিযুক্ত দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বাকি যারা জড়িত, তাদেরকেও গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের দুই নাম্বার ওয়ার্ডের আজিম নামের এক রোগীর মৃত্যু হয়। গুরুতর অসুস্থ হওয়ার পর তিনি হাসপাতালটিতে ভর্তি ছিলেন।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ওই রোগীর মৃত্যুর পর তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা সিসিইউতে প্রবেশ করে প্রথমে ভাঙচুর চালায়। পরে ডা. সজীবকে মারধর করে। এক পর্যায়ে তাঁকে টেন হেঁচড়ে মারতে মারতে চারতলা থেকে নিচে নামিয়ে আনে। সেখানে মারধর করার এক পর্যায়ে অন্য চিকিৎসকরা এগিয়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। পরে রাত ১টার দিকে চিকিৎসকের উপর হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে অভিযুক্তদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারের দাবিতে জরুরি বিভাগসহ কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।

ফরিদপুরে চিকিৎসকের ওপর ছাত্রলীগ কর্মীর হামলা

সম্প্রতি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহীন জোদ্দারের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। হামলায় তাঁর দুটি দাঁত ভেঙে গেছে। গত ২৪ ডিসেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ ঘটনা ঘটে।

জানা গেছে, ছাত্রলীগ কর্মী ও ইন্টার্ন নার্স মো. মোত্তাকিমের নেতৃত্বে ছয় থেকে সাতজন হেলমেট ও মুখোশ পড়ে হকিস্টিক এবং এস এস পাইপ নিয়ে শাহীন জোদ্দারের ওপর হামলা করে। এতে ওই চিকিৎসকের দুটি দাঁত ভেঙে যায়। আহত চিকিৎসক শাহীন জোদ্দারের বাড়ি ফরিদপুর শহরের কোমরপুর এলাকায়।

অন্যদিকে, মারধরের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ ওঠা মোত্তাকিম ফরিদপুরের জেড এম প্রাইভেট নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ও শহরের পশ্চিম খাবাসপুর এলাকার মো. আলমগীরের ছেলে। তিনি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্ন করছেন বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এছাড়া মোত্তাকিম শহর ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী, ছাত্রলীগের বিভিন্ন প্রোগ্রামে তাঁর সরব উপস্থিতির একাধিক তথ্য পাওয়া গেছে। তা মা জোবায়দা গুলশানা হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স।

এ ঘটনার পর উত্তেজিত ইন্টার্ন চিকিৎসক, হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একজনকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে দেয়। ঘটনার বিচারের দাবিতে বিক্ষোভও করেছে হাসপাতালের চিকিৎসকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

হাসপাতাল ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. শাহীন জোদ্দার হাসপাতালটির ট্রমা সেন্টার থেকে নিচে নামছিলেন। এ সময় মোত্তাকিম সিঁড়ি দিয়ে নিচ থেকে উপরে উঠছিলেন। অসাবধানতাবশত শাহীন জোদ্দারের সঙ্গে ধাক্কা লাগে মোত্তাকিমের। এ নিয়ে দুইজনের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়।

পরে বাড়ি ফিরে মুত্তাকিম তাঁর কিছু পরিচিতজনকে নিয়ে চিকিৎসকের কাছে পুনরায় গেলে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে চিকিৎসক শাহীন জোদ্দারকে মারধর করে মুত্তাকিম। এতে চিকিৎসকের দুটি দাঁত ভেঙে যায়।

ফরিদপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দিলরুবা জেবা বলেন, শাহীন জোদ্দার ফরিদপুরের একজন স্বনামধন্য অর্থোপেডিক্স চিকিৎসক। তাঁকে যেভাবে প্রকাশ্যে মারধর করা হয়েছে, তার ভিডিও ফুটেজ আমাদের কাছে আছে। আমরা ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পক্ষ থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেব। এছাড়া আমরা বিষয়টি ফরিদপুরের ডিসি, এসপিসহ স্বাস্থ্য বিভাগকে লিখিত আকারে জানাবো। এ ঘটনার পর থেকে আমাদের চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

কোতয়ালী থানার ওসি মো. আসাদুজ্জামান জানান, এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৩ জনকে আটক করা হয়েছে। মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।

যা বলছেন বিশেজ্ঞরা

জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক মেডিভয়েসকে বলেন, সরকারের দায়িত্ব হলো প্রতিটি নিগ্রহের ঘটনা সঠিকভাবে তদন্ত করা, কী কী কারণে চিকিৎসকরা নিগ্রহের শিকার হন। এর দুটি দিক রয়েছে, একটি চিকিৎসকদের দিক, আরেকটি নিগ্রহকারীদের দিক। সরকারের প্রথম কাজ হবে, নিগ্রহকারীদের আইনের আওতায় আনা। পরবর্তীতে পুরো বিষয়টির তদন্ত করতে হবে।

তদন্তকাজ তৃতীয় পক্ষ দ্বারা করতে হবে বলে মত এই বিশেষজ্ঞের। তিনি বলেন, তদন্তের দায়িত্ব দিতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান (চিকিৎসক) এবং নিগ্রহকারীদের বাইরের কাউকে। তদন্তের পর যারা দায়ী হবেন, তাদেরকে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে। আমরা সাধারণত তদন্ত করি হাসপাতালের পক্ষ থেকে অথবা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগ করি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান (চিকিৎসক) এবং নিগ্রহকারীদের বাইরে রেখে ঘটনাগুলোর তদন্ত হওয়া দরকার। আরেকটি কথা হলো, কোনো পক্ষ থেকে আইন নিজের হাতে তুলে নিবে না।

অধ্যাপক মোজাহেরুল হক বলেন, চিকিৎসকরা জনগণের সেবা দেওয়ার জন্যই থাকেন। তবে নানা কারণে অবহেলা ঘটতে পারে বা হাসপাতালে যে পরিমাণ যন্ত্রপাতি ও লোকবল থাকা দরকার, তা না থাকার কারণেও চিকিৎসক অনেক সময় সঠিক সেবা নাও দিতে পারেন।

তবে রোগীর সাথে চিকিৎসকের আচরণ ভালো হতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অবশ্যই সেই আচরণ হতে হবে, ইম্পেথেটিক, সিম্পেথেটিক না। ইম্পেথেটিক বলতে বুঝাচ্ছি, রোগীকে নিজের আত্মীয় মনে করতে হবে। নিজের বাবা, মা, ভাই, এরকম মনে করতে হবে। রোগীকে সম্মান দেখাতে হবে। ডাক্তার মনে করতে পারবেন না—রোগী এসে তাকে সালাম দিবে। রোগীকে সম্ভাষণ করতে হবে চিকিৎসকের পক্ষ থেকে, যার অভ্যাস ডাক্তারদের মধ্যে নেই। আমি মনে করি, রোগীদেরকে সম্বোধন করা উচিত। তাহলে রোগীরাও ডাক্তারদেরকে সম্মান করবে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আব্দুস সবুর মেডিভয়েসকে বলেন, উভয় পক্ষকেই (চিকিৎসক এবং রোগী) সহনীয় আচরণ করতে হবে। তাহলে আর সমস্যা হয় না। আর যারা চিকিৎসা প্রত্যাশী তাদেরকে মেনে নিতে হবে, সবাই সুস্থ হবেন না। অধিকাংশ সুস্থ হবেন, কিন্তু কেউ কেউ মারাও যেতে পারেন। বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। আর চিকিৎসকদেরকে বিষয়গুলোকে সহানুভূতির সাথে দেখতে হবে। রোগীকেও বুঝতে হবে, চিকিৎসকের সাথে তাঁর (রোগী) সঙ্গে কোনো শক্রতা নেই। আর রোগী চিকিৎসক এবং প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা রেখেই চিকিৎসা নিতে এসেছেন।

তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুযায়ী লোকবলের একটা অনুপাত আছে। একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকতে হবে, পাঁচজন অন্যান্য কর্মী থাকবে। আমাদের দেশে একজন চিকিৎসকের বিপরীতে প্রায় একজন নার্স আছে, আর অন্যান্য কর্মী একজন আছে। সুতরাং চিকিৎসা হচ্ছে একটা টিম ওয়ার্ক। এই টিমের যথেষ্ট ঘাটতি আছে, নার্স নাই এবং অন্যান্য কর্মী নাই। চিকিৎসক তো নার্স আর অন্যান্য কর্মীর কাজ করে দিতে পারবে না। পারে না বলেই প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলাফল আসে না।

চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনাগুলো কেন ঘটছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গ্রামীণের প্রধান উপদেষ্টা (মেডিকেল) অধ্যাপক ডা. লুৎফর রহমান মেডিভয়েসকে বলেন, দুই পক্ষেরই সন্তুষ্টি নাই, সেবাদাতা এবং সেবাগৃহিতা উভয়ের মাঝে। এজন্য উত্তাল থাকে দুই পক্ষই। হাসপাতাল হলো মৃত্যু এবং ভালো হওয়ার জায়গা। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে কোনো ঝামেলা হয় না। কিন্তু যখনই অপচিকিৎসার অভিযোগ আসে, তখনই ঝামেলা হয়। মানদণ্ড অনুযায়ী, চিকিৎসক একজন রোগীকে ১৫ মিনিট সময় দিবেন। এটি বর্হিবিশ্বে দেওয়া হয়। এ ছাড়া আট ঘণ্টায় একজন চিকিৎসক ২৮ জন রোগী দেখবেন এবং কাজের ফাকে বিশ্রাম নিবেন। কিন্তু এটি এখানে (বাংলাদেশে) হয় না। কেউ কেউ বলেন, আজ আউটডোরে ৬০ জন রোগী দেখেছি বা ১০০ জন রোগী দেখেছি। আবার ইনডোরেও রোগী দেখেন। দেখা গেল, কোনো রোগী আসলেন শঙ্কা নিয়ে, অথচ তাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বিদায় করে দিলেন। আরেকটি হলো অপ্রয়োজনী ইনভেস্টিগেশন। যেটি করার দরকার নেই, সেটি করে দিলো। এরপর হচ্ছে উচ্চমূল্য। এখানে প্রচলিত হয়ে গেছে, চিকিৎসকরা ল্যাব এবং ওষুধ কোম্পানি থেকে কমিশন খান। তাছাড়া যে ওষুধটা লিখেন, সেটি কাজ করে না। অথবা অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখে দিলো। এসব অভিযোগ সাধারণত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ওঠে।

তিনি বলেন, আমি একটা উদাহরণ দেই, জাতীয় অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তিন থেকে চারটি ওষুধের বেশি কোনো রোগীকে দিতেন না। এর মধ্যে বলে দিতেন, ‘এই দুটি মূল ওষুধ, আর এই দুটি সার্পোটিভ ওষুধ’। তাঁকে দেখাতে যে টাকা দেওয়া লাগতো, তাঁর অর্ধেক লাগতো ওষুধে। এখন শুধু ওষুধ আর ওষুধ দেওয়া হয়। দেখবেন, এক রোগীর প্রেসক্রিপশনে ১২ থেকে ১৪টা ওষুধ দেওয়া। এটি অপ্রয়োজনীয়। আমরা চিকিৎসকরা হয়তো ঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারি না বা করি না। এটি ঠিক রাখতে হলে কোয়ালিটি মেনে চিকিৎসা দিতে হবে। চিকিৎসার মানদণ্ড নিশ্চিত করে চিকিৎসা দিতে হবে। তাহলে সন্তুষ্টি আসবে। সেইসঙ্গে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাক্টিস নিয়ম চালু করতে হবে। এছাড়া চিকিৎসাখাতে যেসব ঘাটতি রয়েছে, সেগুলো পূরণ করতে হবে। তাহলে রোগী এবং চিকিৎসক সন্তুষ্ট থাকবে।

সুরক্ষায় করণীয়

অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, কার সুরক্ষা চাই? রোগীর নাকি চিকিৎসকের? চিকিৎসকদের সুরক্ষায় অনেকে পুলিশি ব্যবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু ঘটনা যত তাড়াতাড়ি ঘটে যায়, তখন পুলিশ সুরক্ষা দিতে পারবে না। এই সুরক্ষা দিতে পারবেন চিকিৎসকরা নিজেরাই। ডাক্তার যদি রোগীদেরকে সম্মান জানায়, তখন রোগীই চিকিৎসককে সম্মানের চোখে দেখবে। সে অবস্থায় এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটবে না। যে কথা আগেই বলেছি, চিকিৎসকদেরকে ইম্পেথেটিক হতে হবে এবং রোগীদেরকে ভালোভাবে সম্বোধন করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. আব্দুস সবুর বলেন, চিকিৎসকদের সুরক্ষায় করণীয় হচ্ছে দুটি। চিকিৎসক হচ্ছে টিমের নেতা। দলের অন্যান্য সদস্য যারা আছেন, তাদেরকে চিকিৎসকের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হবে বা চিকিৎসককে দলের অন্যান্য সদস্যদের অনুভূতি পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যেখানেই চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে নার্স বা অন্যান্য কর্মীরা এসে চিকিৎসকের পাশে দাঁড়ায়নি। এর মানে, চিকিৎসক নিজ দলের মধ্যেই সকলের সহানুভূতি বা সহযোগিতা পাচ্ছেন না। আরেকটি হচ্ছে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, যারা সেবা নেন, তাদেরকে চিকিৎসকের প্রতি সহানূভূতিশীল হতে হবে।

অধ্যাপক ডা. লুৎফর রহমান বলেন, চিকিৎসককে সুরক্ষা দিতে গেলে একজন চিকিৎসক যতজন রোগী দেখার কথা, ততজন রোগী দেখবেন। যখন চিকিৎসক অতিরিক্ত রোগী দেখবেন, তখন তাঁর মেজাজ ঠিক থাকবে না। সেই সঙ্গে বর্তমানে যে বেতন দেওয়া হয়, তা বাড়াতে হবে। তাঁর সাথে চিকিৎসকের ক্যারিয়ার প্লান ঠিক রাখতে হবে, যখন-তখন বদলি করা যাবে না। এগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে সরকারকে। তাহলে চিকিৎসকরা সুরক্ষা পাবেন।

এনএআর/এমইউ

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : চিকিৎসক নিগ্রহ
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক