
ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দীন
নার্স ও পুষ্টিবিদ,
বিএসসি ইন নার্সিং (চবি), এমপিএইচ ইন নিউট্রিশন (ইবি)।
০৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০১:১৮ পিএম
আলমা আতা ঘোষণা, সবার জন্য স্বাস্থ্য ও নার্সিং পেশা

বর্তমান সরকারের লক্ষ্য জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া। দেশের স্বাস্থ্য সেবাকে গ্রামের মানুষের জন্য সহজলভ্য করতে জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে স্বাস্থ্য সেবার মান ও সুবিধা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য সেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হচ্ছে নার্স। নার্সিং একটি মানবিক পেশা। বর্তমানে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কারণ এ পেশার মাধ্যমে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে। তাছাড়া তরুণদের কাছে জনপ্রিয়তার কারণ এই পেশায় খুবই দ্রুত অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতাও পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবায় যুগ যুগ ধরে নার্সিং খাত অবদান রেখে চলেছে। স্বাস্থ্য বিভাগের অনন্য অর্জন; যেমন—মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমানো, ভ্যাকসিন হিরো পুরস্কারসহ সর্বশেষ করোনা মোকাবিলায় নার্সদের আত্মত্যাগ ও নিবেদিত প্রাণ কর্মতৎপরতা দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের যে দায়িত্ববোধ তাই প্রমাণ করে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪৭ হাজার নার্স সরকারিভাবে কর্মরত।
বিশ্বব্যাপী সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় স্বাস্থ্যখাতে। ১৯৭৮ সালের আলমা আতা ঘোষণার (যা ‘প্রাইমারি হেলথ কেয়ার’ তথা ২০০০ সাল নাগাদ ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ নামে পরিচিতি পেয়েছিল) আগ পর্যন্ত স্বাস্থ্য ছিল মূলত পয়সাওয়ালা মানুষদের ক্রয়যোগ্য পণ্যের মতো, ঠিক ‘অধিকার’ নয়। সেখানে সামাজিক ন্যায়বিচার ধারণার প্রবর্তনের ফলে স্বাস্থ্য পেল গণমানুষের অধিকারের মর্যাদা। গৌরবের বিষয়, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বকালীন বাংলাদেশ ছিল আলমা আতা ঘোষণার অন্যতম স্বাক্ষরকারী এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য অধিকার প্রতিষ্ঠার একটি উজ্জ্বল মডেল। সেই আলমা আতা ঘোষণার সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত কল্পে নার্সিং পেশা সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। একই সাথে একজন নার্স সামগ্রিক সেবার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে অর্থনীতিতেও।
নার্সিং পেশার কয়েকটি দিক
কমিউনিটি নার্সিংয়ে জনগণের অর্থ ও সময় বাঁচবে: কমিউনিটি নার্সিং কেয়ারের মাধ্যমে হাসপাতালে রোগী ভর্তি হার কমাতে অবদান রাখেন নার্সরা। এর মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি একসাথে বিশাল জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবায় সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এতে জনগণের অর্থ ও সময় দুটো সাশ্রয় হচ্ছে। সঠিকভাবে কমিউনিটি নার্সিং কেয়ার প্রদান করলে রোগের প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্য হারে কমবে। করোনাকালীন সময়ে কমিউনিটি নার্সিং জনগণের দোরগোড়ায় যে সেবা পৌঁছে দিয়েছিল, এতে রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থনৈতিক সাশ্রয় হয়েছে। এই সেবা পদ্ধতি কানাডাসহ অন্যন্য দেশে খুবই জনপ্রিয়।
প্রতিরোধমূলক নার্সিং সেবা কমাবে ব্যাধি: প্রিভেন্টিভ নার্সিং কেয়ার বা প্রতিরোধমূলক নার্সিং সেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। জনসচেতনতা বাড়লে সংক্রামক বা অসংক্রামক ব্যাধিগুলো সংক্রমণের হার কমে যায়। ফলে হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি হার কমে। জাতীয় অর্থনীতিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
অল্প সময়ে রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে: নার্সরা সংক্রমণ বিধি মেনে সঠিকভাবে সেবা প্রদানের ফলে অল্প সময়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে রোগী বাড়ি ফিরে যায়। এতে দ্রুত স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করা সম্ভব হয়। কিন্তু সংক্রমণ বিধিমালা না মেনে সেবা দেওয়া হলে Hospital Acquired Infection (HAI) বা স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত সংক্রমণ হার বেড়ে যায়। এতে হাসপাতালে রোগীর অবস্থান কাল দীর্ঘ হয়। ফলে অতিরিক্ত অর্থ, সময় ও বাড়তি জনশক্তি দরকার হয়, যার বিরূপ প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে।
বৈদেশিক মূদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি সচল রাখছে নার্সরা: বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি প্রায় পাঁচ শতাধিক নার্স কর্মরত। বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (BOESL) মাধ্যমে আরও কিছু দেশে নার্স রপ্তানির কাজ চলমান। এটি আমাদের রিজার্ভ সংকট কমাতে সহায়ক হচ্ছে। তাই আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নার্সিং শিক্ষার কারিকুলাম ও বিদেশ গমন সহজতর করা জরুরি।
বয়স্ক চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র চালু করলে সাশ্রয়ী মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে: জেরিয়াট্রিক সেবা কেন্দ্র চালু করলে বয়োজ্যেষ্ঠদের আপদকালীন সময়ে চিকিৎসা ব্যয় কমবে। একই সাথে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর হার কমানোও সম্ভব হবে। ফলে দেশেই অল্প খরচে ভালোমানের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে দুই লাখ ৫০ হাজার নার্সের প্রয়োজন হবে। কারণ তখন আমাদের ষাটোর্ধ মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য জেরিয়াট্রিক সেবা কেন্দ্র দরকার।
নার্সিং পেশাকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি
এখন সময় এসেছে নার্সিং পেশার উপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করার। এখন এটি সুস্পষ্ট যে, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে নার্সিং পেশার মান্নোয়ন প্রয়োজন। বলা হয়, একটি দেশের স্বাস্থ্য সেবার মানদণ্ড ৮০ শতাংশ নার্সিং সেবার মানের উপর নির্ভরশীল। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কানাডা, ইংল্যান্ড-আমেরিকাসহ যেসব দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত, ওইসব দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধির পেছনে নার্সদের সেবা প্রদানের ভূমিকা রয়েছে। পাশের দেশ ভারত ও মিয়ানমারও তাদের স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন করেছে। নার্সিং পেশাকে উন্নতি করেই এটি সম্ভব করেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর ৩১ দফায় নার্সদের উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেওয়ার জন্য গুরুত্বারোপ করেছিলেন।
যদি নার্সদের পদবিন্যাস সৃজন করা যায়, তাহলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সহজতর হবে এবং আমরা আরও একধাপ এগিয়ে যাবো। এ ছাড়া সেবার মান বেড়েছে যেভাবে, সে অনুপাতে নার্সিং খাতে বেড়েছে জনবল। তাই এ বিশাল জনবলকে সুষ্ঠুভাবে মনিটরিং দরকার। নার্সিং খাতের আরেকটি সহযোগী খাত হচ্ছে মিডওয়াইফারি। নার্সিংয়ের বিদ্যমান প্রশাসনিক জনবল কাঠামো দিয়ে মিডওয়াইফারিকে দেখভাল করা হচ্ছে। বর্তমানে মিডওয়াইফ ও এ সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। ফলে এটিও বর্তমান নার্সিং প্রশাসনিক কাঠামোর উপর নতুন করে চাপ তৈরি করছে। এজন্য নতুন প্রস্তাবিত পদবিন্যাস বহুলাংশে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবোলায় ও সেবা সহজিকরণে নার্সিং খাতে পদবিন্যাস জরুরি
সেবা সহজীকরণে অবাধ তথ্য প্রবাহ বর্তমান সরকারের একটি যুগপৎ সিদ্ধান্ত, নার্সিং পেশায়ও এর ধারাবাহিকতা প্রয়োজন। এজন্য জেলার সেবাগুলো সদর হাসপাতালে সম্পন্ন হতে একটা সুবিন্যস্ত প্রশাসনিক কাঠামো প্রয়োজন। আলাদাভাবে বণ্টিত পদ সৃজন না হওয়ার কারণে সেবা সহজলভ্যতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার যে প্রয়াস, তা সঠিকভাবে পালন করতে হলে অপার সম্ভাবনাময়ী এ নার্সিং পেশায় পদ বিন্যাস প্রয়োজন। জনগণের সেবা প্রাপ্তি সহজীকরণ ও নার্সদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (অটোমেশন) সময়োপযোগী দক্ষ ও আধুনিক জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে, এ পেশায় প্রশাসনিক সক্ষমতা ও পদবিন্যাস বা উচ্চতর গ্রেডের নতুন পদ সৃজন অনেকটা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুতরাং বলা চলে, স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন করতে হলে নার্সিং পেশার মান্নোয়ন প্রয়োজন। নার্সদের সুষ্ঠু জনবল কাঠামো বা পদসোপান তৈরির মাধ্যমে এ পেশার মান্নোয়ন—সর্বোপরি স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি পাবে। প্রিভেন্টিভ নার্সিং, কমিউনিটি নার্সিং ও সংক্রমণ বিধিমালার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের প্রতিরোধযোগ্য রোগবালাই ও রোগের প্রাদুর্ভাব, হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার ও ভর্তিকৃত রোগীর অবস্থানকাল কমানো যাবে। সেক্ষেত্রে আরো অনেক উপকারিতা লক্ষ্য করা যায়। এতে হাসপাতালের অতিরিক্ত স্বাস্থ্যসেবার যে অর্থ ব্যয় সেটা কমে যায় এবং হাসপাতালে জনবলের উপর বাড়তে যে চাপ তৈরি হয় সেটা কমে যায়। ফলে অর্থনীতিতে একটি নীরব বিপ্লব সংগঠিত করা সম্ভব।
সুতরাং অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের একটি সোপান জনগণের দোরগোড়ায় নার্সিং সেবা পৌঁছে দেওয়া। যদি আমরা সামগ্রিক সেবার মাধ্যমে রোগীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করতে পারি তাহলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় অর্থব্যয় যেভাবে কমবে, পাশাপাশি জনগনের অর্থিক ক্ষতি হ্রাস পাবে এবং আলমা আতা ঘোষণা অনুযায়ী সার্বজনীন সেবা নিশ্চিত হবে।
এনএআর/
-
১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
-
২৫ জানুয়ারী, ২০২৫
-
১৩ নভেম্বর, ২০২৪
-
০২ নভেম্বর, ২০২৪
-
১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
-
০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
-
১৪ অগাস্ট, ২০২৪
-
১৭ জুলাই, ২০২৪