অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান

অধ্যাপক, রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগ
 উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়


১৬ নভেম্বর, ২০২২ ০৭:৫৪ পিএম

জীবনের জন্য ফুসফুস

জীবনের জন্য ফুসফুস
সিওপিডি বা দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসকষ্ট জনিত রোগটি মূলত: শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ জনিত রোগ।

প্রতি বছর নভেম্বর মাসের তৃতীয় বুধবার বিশ্ব সিওপিডি দিবস পালিত হয়। অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে ক্রনিক অকস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজেস (সিওপিডি) একটি অন্যতম শীর্ষস্থানীয় রোগ এবং একটি নিরব ঘাতক। বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী মৃত্যুর সকল কারণের মধ্যে সিওপিডি রোগটির অবস্থান তৃতীয়। এই রোগের কারণগুলোর সম্পর্কে আমরা যদি এখনই সচেতন না হই এবং প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা না নিই, তাহলে আগামী ১০ বছর পরে মৃত্যুর কারণে এই রোগটির অবস্থান দ্বিতীয় বা প্রথমে চলে আসতে পারে। সারাবিশ্বের জনসংখ্যার শতকরা ১৫.২ ভাগ ধূমপায়ী সিওপিডিতে আক্রান্ত হয়। 

এ ছাড়া সাবেক ধূমপায়ী যারা এক বছরের বেশি সময় ধরে ধূমপান ছেড়েছেন, তাদের শতকরা ৭.৬ ভাগ এবং অধূমপায়ীদের শতকরা ২.৮ ভাগ মানুষ সিওপিডিতে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশের একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিছে, ৪০ বছরের ঊর্ধ্ব জনসংখ্যার শতকরা ১২.৫ ভাগ সিওপিডিতে আক্রান্ত। যার মধ্যে শতকরা ২৪.৮ ভাগ ধূমপায়ী, ২৮.১ ভাগ সাবেক ধূমপায়ী, যারা বিগত এক বছরের বেশি সময় ধরে ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন এবং ৬.১ ভাগ অধূমপায়ী। যে সকল মহিলা তামাক জাতীয় পণ্য (যেমন- জর্দা, গুল) সেবন করেন, তাঁদের সিওপিডিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা ১৫ গুণ বেশি। তাই ভয়ঙ্কর এই রোগটি সম্পর্কে আমাদের ভালভাবে জানতে হবে এবং প্রতিরোধে সচেষ্ট হতে হবে। 

সিওপিডি বা দীর্ঘমেয়াদী শ্বাসকষ্ট জনিত রোগটি মূলত: শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ জনিত রোগ। দীর্ঘসময় ধরে বিভিন্ন বিষাক্ত ও ক্ষতিকারক উপাদান শ্বাসতন্ত্রে প্রবেশ করার ফলে শ্বাসনালী ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং আক্রান্ত স্থানে প্রদাহ তৈরি হয়। আক্রান্ত ফুসফুসের ছোট ছোট বায়ু কুঠুরিগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় (এমফাইসিমা) অথবা শ্বাসনালীর অংশগুলোর আবরণের ধরণ পরিবর্তিত হয়ে বাড়তি মিউকাস নিঃস্বরণ করে এবং সিলিয়া বা প্রক্ষেপকযুক্ত আবরণীয় সংখ্যা কমে যায় (ব্রংকাইটিস)। ফলে দীর্ঘ মেয়াদী কাশি, কফ নিঃসরণ ও শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে প্রছন্ন হয়ে উঠতে থাকে। বয়সের সাথে সাথে সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করে এবং এক সময় এমন অবস্থায় এসে পৌছায় যে, তখন রোগী নিজের দৈনন্দিন কাজকর্ম করতেও শ্বাসকষ্টে ভোগেন। একইসঙ্গে দানা বাঁধে সিওপিডি জনিত অন্যান্য জটিলতা। যেমন- হৃদরোগ, মাংশপেশীর দূর্বলতা, ওজন হ্রাস, বিষণ্নতা ও ফুসফুসের ক্যান্সার ইত্যাদি নানান ধরণের বাড়তি সমস্যা।

ধূমপান, ধূমপান এবং ধূমপানই সিওপিডির প্রধানতম কারণ। শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রেই ধূমপান সিওপিডির প্রধান কারণ এবং ১৭.৩ ভাগ ক্ষেত্রে জৈববস্তু জ্বালানি (যেমন- খড়, লাকড়ি, গোবর, ইটভাটার ধোঁয়া ইত্যাদি) এই রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে এক গবেষণায় পাওয়া গেছে। তবে সকল ধূমপায়ী হয়ত সমানভাবে আক্রান্ত হবার ঝুঁকিতে ভুগেন না। এ ক্ষেত্রে জিনগত প্রবণতা এই রোগটির তীব্রতার গতি নির্ধারণ করে। কত দ্রুত একজন ধুমপায়ী রোগটির জটিল পর্যায়ে আর্বিভূত হবে, সেটি নির্ধারিত করা না গেলেও নির্দ্বিধায় বলা যায় একজন ধুমপায়ী জীবনের কোনও না কোনও পর্যায়ে শ্বাসকষ্টের এই জটিল সমস্যায় অবশ্যই উপনিত হবেন। যেমন- যারা প্রতিদিন এক প্যাকেট সিগারেট ১০ বছর ধরে খেয়ে চলেছেন, ৪০ ঊর্ধ্ব বয়সে তাঁদের মধ্যে প্রতি দুই জনের এক জন সিওপিডিতে ভুগবেন। তাই ধূমপান ত্যাগ করা সিওপিডি থেকে মুক্ত থাকার প্রধানতম উপায়।

এক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার তামাকমুক্ত বাংলাদেশ ২০৪০ বাস্তবায়নে, তরুন প্রজন্মকে ধংসের হাত থেকে রক্ষা করতে এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে তামাক কোম্পানির সকল ধরনের প্রচারণা বন্ধ করা, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আয়োজিত প্রোগ্রামগুলোতে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে তামাকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা এবং সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসে ও আশেপাশে অর্থাৎ ১০০ গজের মধ্যে তামাকের বিক্রয় বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার মাধ্যমে সিওপিডি প্রতিরোধে পদক্ষেপ রাখবে-এটি আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

গত তিন বছর যাবৎ আমাদের সারা পৃথিবী কোভিডের মতো একটি ভয়াবহ শ্বাসতন্ত্রের রোগে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। কোভিডের কারণে আমাদের অনেকেরই ফুসফুস ইতিমধ্যে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। তাই এই দূর্বল ফুসফুসে সিওপিডি’র মতো দীর্ঘমেয়াদী ফুসফুসের রোগ স্বাস্থ্যমানের জন্য আরও ঝুঁকিপূণ হয়ে উঠেছে। বর্তমান সময়ে ফুসফুসের যত্ন নেয়া, ফুসফুসের সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা সর্বাধিক অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে উঠেছে। ২০২২ সালে সিওপিডি দিবসের প্রতিপাদ্য Your Lungs for Life  ‘জীবনের জন্য ফুসফুস’।

আপনি যদি একজন সাধারন তরুন ধুমপায়ী হন তবে এখনই ধূমপান ত্যাগ করুন। যদি মধ্য বয়সি এমন কেউ হন যিনি সারা বছরব্যাপি খুশখুশে কাশি আর হালকা শ্বাসকষ্টের কারণে কর্ম উদ্দীপনা হীনতায় ভুগছেন, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। সহজ কিছু লাং ফাংশন পরীক্ষার মাধ্যমে আপনি সিওপিডি রোগটিতে ভুগছেন কিনা, শনাক্ত করুন। যদি অবস্থা এমন হয়ে থাকে যে, সারা বছর শ্বাসকষ্টে কফ কাশিতে ভুগছেন, পায়ে পানি চলে আসছে, সঙ্গে রয়েছে হৃদরোগসহ অন্যান্য জটিলতা, তবে অবশ্যই সিওপিডির সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করুন। বিশেষত বছরের যে বিশেষ কয়েকটি সময়ে শ্বাসকষ্ট মারাত্মক অবস্থা ধারণ করে (এক্সাজারবেশন) সেই সময়গুলোতে প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিন। এই রোগ প্রতিরোধে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করুন, নিয়মিত কায়িক পরিশ্রম করুন, ইনফ্লুয়েঞ্জা ও নিউমোনিয়া প্রতিবেষধক টিকা বা ভ্যাকসিন নিন। দূষিত বায়ু  (যেমন- ইটভাটা, কল-কারখানা, যানবাহন থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া) ও ধূলা বালি থেকে দূরে থাকুন, পেশাগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমানোর জন্য সঠিক নিয়মে মাস্ক পরিধান করুন, ঘরে পর্যাপ্ত আলোবাতাসের ব্যবস্থা রাখুন, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করুন, প্রয়োজনে দীর্ঘ মেয়াদি অক্সিজেন গ্রহণ করুন। তবে প্রত্যেকটি পর্যায়ে অবশ্যই ধূমপান বর্জন করুন। আর আপনি যদি কোনও সমাজ ও স্বাস্থ্য সচেতন নাগরিক হন, তবে গড়ে তুলুন ‘ধূমপান নিরোধক সংঘ’। বন্ধুকে সিগারেট শলাকা এগিয়ে না দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপনের পরামর্শ দিন। সহযোগিতা করুন সিওপিডির রোগীকে, ধূমপান থেকে বিরত থাকার দৃঢ় সংকল্প নেয়া পরিজনকে, সচেতন করুন বন্ধু-প্রতিবেশী-স্বজন ও সমাজকে। Your Lungs for Life  ‘জীবনের জন্য ফুসফুস’ বিশ্ব সিওপিডি দিবস ২০২২-তে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত