ডা. ফারহানা মোবিন

ডা. ফারহানা মোবিন

লেখক ও সমাজকর্মী


০৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২১ ০৯:০২ পিএম

নীল চশমা

নীল চশমা
ছবি: সংগৃহীত

হঠাৎ বেজে উঠল মোবাইল ফোন। আমিনুল সাহেব ভীষণ বিরক্ত হয়ে দেখলেন তার মা মিস কল দিয়েছেন।

বিরক্ত হয়ে বৃদ্ধা মাকে বকা দিলেন সব কলিগদের সামনে। চিৎকার করে বললেন, তুমি ব্রিটিশ আমলের মানুষ, তুমি যখন তখন ফোন করে ফেলো, জানোই না যে, মিটিংয়ের সময় ফোন করতে হয় না।

ছেলের চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে গেলেন বৃদ্ধা মা।

বৃদ্ধা মা: বাবা, আমিতো জানি নারে কখন তোর মিটিং থাকে। তাই ভুল করে ফোন করে ফেলেছি। ছেলের বকা খেয়ে দুচোখ ভিজে উঠল বৃদ্ধা মায়ের। ছানি পড়া চোখটি আরো ঝাপসা হয়ে উঠলো।

দরজাতে কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। দরজা খুলতেই উপমা প্রশ্ন করলো: দীদা, তুমি দরজা বন্ধ করে কেন ফোন করো? তোমার এত গোপন কি কথা থাকে?

দীদা: নারে দাদু ভাই, তোর বাবার সাথে আমার কোন গোপন কথা নাই। কারো সাথে আমার কোন গোপন কথা থাকে না। তাহলে এইভাবে চুরি করে ফোন করো কেন, প্রশ্ন করল উপমা।

দীদা: তোর বাবাকে ফোন করতে দেখলে, তোর মা খুব বিরক্ত হবে।

উপমা: আমার বাবা তোমার ছেলে, তুমি তাকে ফোন করতেই পারো।

দীদা: ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে সবাই বাবা-মার আপন থাকে না।

উপমা: তাহলে বড় হয়ে কি আমিও বাবা-মায়ের পর হয়ে যাবো?

দীদা: না দাদু ভাই, তুই খুব ভালো মেয়ে। ভালো মেয়েরা সবার আপন থাকে। তোর বাবা আমাকে যেভাবে কষ্ট দিচ্ছে, তুই কখনো তোর বাবা মাকে কষ্ট দিবি না।

উপমা: তুমি কাঁদছো কেন? কই কাঁদছি নাতো।

দীদার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল উপমা। দীদা হাত বুলাতে লাগলেন উপমার মাথায়।

মনোযোগ দিয়ে উপমা শুনতে লাগলো পুরানো দিনের গল্প। হঠাৎ ঘরের বাহিরে প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচি।

উপমা লাফ দিয়ে উঠল বিছানা থেকে। এক চোখ দিয়ে মালতি বেগম দেখলেন তার ছেলের বউ চিৎকার করে বলছেন, কেন মা, তোমাকে জমির ওই ভাগ দিবে? মা আমার বাসায় থাকে, তার একটা খরচ আছে না? ওই জমির ভাগ আমাদের। মা ওই জমি কাউকে দিতে পারবে না। আমি কাউকে দিতে দিবো না। জমির ভাগ আমাকে দিয়ে তারপরে এই বাসা থেকে জাহান্নামে যাক। তাতে আমার কোনো আপত্তি নাই।

ছেলের বউয়ের কথা শুনে মালতি বেগমের বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। তিনি বসে থাকতে পারলেন না। বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

উপমা: দীদা আমি সোনারগাঁ হোটেলে চলে যাচ্ছি সাঁতার কাটতে। এসব টাকা-পয়সার ঝগড়া আমার ভালো লাগছে না। আর শোনো তোমার মোবাইলে ৫০০ টাকা দিয়েছি। তুমি যার সাথে ইচ্ছা মন খুলে কথা বলো। তুমি ৫০ টাকার জন্য বাবা আর ফুফুদের কাছে হাত পাতো আমার খুব খারাপ লাগে। তুমি আমার কাছে থেকে নিবা।

দীদা: তুই টাকা পাবি কোথায়? 

উপমা: আমি প্রতি মাসে ১০০০ টাকা স্কলারশিপ পাই। এই ১০০০ থেকে ৫০০ টাকা তোমার, ৫০০ আমার। আবেগ আর আনন্দে মালতি বেগম বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর নাতিকে।

দীদা: তুই ছাড়া আমার কেউ নাইরে। তুই আমার খুব ভালো বন্ধু।

এক মাস পরের ঘটনা।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল মালতি বেগমের। বাসার মধ্যে উকিল, পুলিশ ও কোর্টের লোকজন। কি ভয়ঙ্কর কথা। এতো মানুষজন কেন? বিছানা থেকে নামতে পারছিলেন না তিনি। দৌঁড়ে এসে এক মহিলা পুলিশ তাঁকে বিছানা থেকে টেনে হিচড়ে নামালেন। ৫ মেয়ে আর ৪ ছেলে, নাতি, নাতনি, মেয়ের জামাই; ছেলের বউরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন মালতি বেগমের নামে বরাদ্দ থাকা ৫ কাঠা জমির ভাগ নেবার জন্য।

মালতি বেগম: বাবা তোরা আমার সাথে এইভাবে গন্ডগোল করিস না, আমার খুব শরীর খারাপ।

মীনা বেগম: দেখো মা, এসব নাটক করবা না। ভালো মানুষের মতো জমিটা আমাদের লিখে দাও। তা না হলে তোমার বিরুদ্ধে কেস করবো। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো।

মালতি বেগম: মা, তুই আমার সন্তান হয়ে এই কথা বলতে পারলি! ওই জমিটা আমি রেখেছি কাব্যের জন্য। কাব্যকে আমি রাস্তা থেকে তুলে এনে মানুষ করেছি। তোরা এতো বড় বড় চাকরি করিস যে, আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি, এইটা জানার সময় তোদের নাই। 

আজ কতো বছর পরে তোদেরকে একসাথে দেখলাম। আমি এতো দুর্ভাগা মা যে, ঈদের দিনেও তোদের সবাইকে দেখতে পাই না। আজ জমির ভাগ নিতে তোরা সবাই উপস্থিত। আমাকে জেলখানায় পাঠানোর জন্য এসেছিস। তবুও ভালো তোদেরকে দীর্ঘ বছর পরে অন্তত একসাথেতো দেখতে পেলাম।

রাকিব খান (দ্বিতীয় ছেলে): মা তাড়াতাড়ি দলিলে স্বাক্ষর দাও। তোমার সাথে এতো কথা বলার সময় আমাদের নাই। তুমি বেকার মানুষ। তোমার কাজ নাই। কিন্তু আমাদের অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি স্বাক্ষর দাও। নইলে সত্যিই আমরা তোমায় আদালতে নিয়ে যাবো।

কাব্যকে আমাদের টাকাতে মানুষ করেছো, এটাইতো যথেষ্ট। ওকে জমি দিবা কেন?

মালতি বেগম: তোদের সবাইকে আমি বাড়ি, গাড়ি ও ব্যাংকের টাকা সব ভাগ করে দিয়েছি। আমার ভাগের ৯০ ভাগ তোদেরকে দিয়েছি। 

কাব্যকে আমি মাতৃস্নেহে বড় করেছি। ওর বাবা-মার কোন পরিচয় নাই ঠিকই কিন্তু মানুষ হিসাবে সে বড় ভালো। আমি এই জমি ওকেই দিবো। এটা আমার দীর্ঘ বছরের ইচ্ছা। 

ঝগড়া, চিৎকার চেঁচামেচি আর ছেলেমেয়েদের লালসার কাছে হার মানলেন মালতি বেগম। পাঁচ কাঠা জমি দিয়ে দিলেন নয় ছেলে মেয়েকে। এইবার পাঁচ কাঠাকে নয় ভাগ করার জন্য বেধে গেল মহাযুদ্ধ। প্রচণ্ড পরিমাণে বুকে ব্যথার জন্য মালতি বেগম ঘরে যেয়ে দরজার বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন।

পরদিন সকাল বেলা। আকাশভরা মেঘ। সরকারি ছুটির দিন। আমিনুল সাহেবের বাসার বুয়া, মালি, ড্রাইভার ও উপমা দরজা ভেঙে বের করল মালতি বেগমকে।

নিথর দেহে পড়ে আছেন মেঝেতে। দুচোখ থেকে গড়িয়ে যাওয়া পানিগুলো মিশে গেছে গালের সাথে। ডান হাতে ধরে ছিলেন একটি চিঠি। তাতে লেখা, ‘উপমা, দাদুভাই, আমায় ক্ষমা করে দিস। তোকে ছেড়ে চলে গেলাম ওইপারে। দীর্ঘ দিন ধরে সবার এই অপমান আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম নারে।

আমাকে আর কষ্ট করে ওল্ড হোমে পাঠাতে হবে না। দাদু ভাই, তোর জন্য আমার একটি কিডনি তোকে দিয়ে গেলাম। এইবার তোর কিডনি ট্রান্সপ্ল্যানটেশানটা হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ্ হয়ে যাবি। বিদায় দাদু ভাই। আমাকে ক্ষমা করে দিস।’

উপমা কাঁদতে পারছে না। বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে দীদার এক পা ভাঙা টেবিলের দিকে। শূন্য আর নিথর হয়ে পড়ে থাকা দীদার কালো চশমাটি বেদনায় হয়ে গেছে নীল। 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : গল্প
‘ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ অনুসন্ধান করুন’

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের গালমন্দ নয়: প্রধানমন্ত্রী

‘ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ অনুসন্ধান করুন’

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের গালমন্দ নয়: প্রধানমন্ত্রী

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত