ডা. আশিকুর রহমান রুপম

ডা. আশিকুর রহমান রুপম

এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), এফসিপিএস-২য় পর্ব (অর্থোপেডিক্স) 
অর্থোপেডিক ফিজিশিয়ান এবং স্বাস্থ্য কলামিস্ট


০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০৬:৪৬ পিএম

হাড়ের টিউমার: জায়ান্ট সেল টিউমার

হাড়ের টিউমার: জায়ান্ট সেল টিউমার
জায়ান্ট সেল টিউমার।

মিসেস শিউলি, ৩৫ বছর বয়স। গত এক বছর ধরে হাঁটুর উপরের হাড়ে ব্যথা এবং ফোলা। ব্যথা সব সময় কনকন করে। তবে এক জায়গাতেই থাকে, কোনোদিকে যায় না। রাতের বেলা বেশি হয়ে যায়, পা নাড়ালে বা হাটলে ব্যাথা বেড়ে যায়।

ব্যথার ওষুধ খেলে কমে যায়, কিছুদিন ভাল থাকে। আবার ব্যথা হয়, যেন ব্যথা তাকে ছেড়েই যাচ্ছে না। ফোলাটাও এক বছরে ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। সাথে সাথে গত চার মাস হলো ঠিকমতো হাটতেও তিনি পারছেন না।

এই অবস্থায় তিনি চিকিৎসকের কাছে এসেছেন। কি তার অসুখ? আজ সেটাই আলোচনা করা যাক।

তার অসুখের নাম হল জায়ান্ট সেল টিউমার। এটা এক ধরনের নিরীহ প্রকৃতির হাড়ের টিউমার। তবে নিরীহ হলেও এটা অল্প জায়গার মধ্যে খুব আগ্রাসী হয়ে ওঠে। যেখানে হয়, সেখানকার হাড় নষ্ট করে ফেলে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে কোথায় কোথায় হয় এটা?

উত্তর, সবচেয়ে বেশি হয় হাঁটুর উপর-নিচে (উরুর হাড়ের নিচের দিকে বা পায়ের হাড়ের মাথায়), এটা হয় প্রায় ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে। এরপর হয় কব্জির হাড়ে (রেডিয়াসের নিচের দিকে) এবং বাহুর হাড়ের মাথায় অর্থাৎ শোল্ডার জয়েন্টে।

জায়ান্ট সেল টিউমার সর্বদা প্রাপ্তবয়স্কদের হয়, অর্থাৎ যখন থেকে কিশোর-তরুণদের উচ্চতা আর বৃদ্ধি পায় না, তখন থেকে এটা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যাদের বয়স ২০-৪০ বছর, তারা আক্রান্ত হতে পারে। শিশু বা বৃদ্ধদের সাধারণত এটা হয় না।

জায়ান্ট সেল টিউমারের কারণ

জায়ান্ট সেল টিউমারের আসল কারণ অজনা। তবে কিছু রিস্ক ফ্যাক্টরকে দায়ী করা হয়। যেমন ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাগুলোতে আঘাতের ফলে হতে পারে।

বৈশিষ্ট্য

১. মহিলাদের বেশি হয়, পুরুষের চেয়ে।
২. বয়স ২০-৪০ বছরের মধ্যে হয়। আবার ৩০-৪০ এ হওয়ার ঝুঁকি আরো বেশি।
৩. সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের হয়।
৪. এই টিউমার সাধারণত নিরীহ (৯০%)। তবে অল্প কিছু ক্ষেত্রে (৫-১০%) এরা ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
৫. এদের মধ্যে তিন শতাংশ টিউমার ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৬. পৃথিবীতে মানুষের হাড়ে যত ধরনের টিউমার পাওয়া যায়, তার মধ্যে এই টিউমার গুলো অল্প। হিসাব করলে মাত্র পাঁচ শতাংশ হলেও আমাদের দেশে এটা পরিচিত অসুখ।
৭. হাড্ডি ছাড়াও মাংসের টেন্ডন শিথেও এটা হতে পারে।
৮. এটা অপারেশন করে ফেলে দিলেও আবার হতে পারে। এর বারবার হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি।

লক্ষণ-উপসর্গ

ব্যথা: এই রোগীদের প্রধান অভিযোগই হল ব্যথা। দীর্ঘদিনের ব্যথায় রোগীরা কাতর হয়ে থাকে। দীর্ঘদিনের কনকনে বা চিনচিনে ব্যাথা থাকে হাটু, কবজি বা কাঁধের জয়েন্টে। দিন যত যায় ব্যাথার মাত্রা বাড়তেই থাকে। লক্ষণীয় ব্যাপার হল এই ব্যথা রাতে বেশি থাকে দিনের চেয়ে এবং কাজ করলে এটা আরো বেড়ে যায়।

ফোলা: ফোলাটা হয় সাধারণত কোনো জয়েন্টের আশপাশে; বিশেষ করে হাটু, কবজি বা কাঁধে। তবে জায়ান্ট সেল টিউমার জয়েন্টের কোনো এক ধারে হয়, পুরো জয়েন্ট জুড়ে নয়।

চলাফেরা: সাধারণত এটা জয়েন্টের আশ পাশে হলেও এটা জয়েন্টের মধ্যে কখনো ঢুকে না। তবে দীর্ঘদিন চিকিৎসা না হলে বা অবহেলা করলে জয়েন্টের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে।

ফ্র‍্যাকচার বা ভাঙা: কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীদের আক্রান্ত জায়গার হাড্ডি ভেঙে যেতে পারে। তবে এটা তুলনামূলক কম (৫-১০ %)। মজার ব্যাপার হল এই রোগীরা বুঝতেই পারে না, কখন তার হাড় ভেঙে গেছে। কারণ হাড় ভাঙার মত হঠাৎ তীব্র ব্যথা এখানে হয় না। একে বলে প্যাথলজিক্যাল ফ্র‍্যাকচার।

শারীরিক পরীক্ষা

আমরা ডাক্তাররা পরীক্ষা করে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিক্যাল ক্লু বা রহস্যের সূত্র পাই। তা হল:

- ফোলাটা দেখা যায় জয়েন্টের আশপাশের এক সাইডে হয়।

- উপরের চামড়াটা চকচক করে। তবে কোনো শিরা দেখতে পাওয়া যায় না।

- জায়গাটা গরম হয়ে থাকে এবং রোগী ব্যথার জন্য হাত দিতে দেয় না।

- ফোলার ধরন শক্ত, একটু চাপ দিলে কিছুটা ডিমের খোসা ভাঙার কড়কড় আওয়াজের মত শব্দ পাওয়া যায়। ফোলাটা নিচের হাড়ের সাথে লাগানো আছে এবং উপরের চামড়া থেকে আলাদা হয়ে আছে, এটা বোঝা যায়।

- আশপাশের লিম্ফনোড ফোলা পাওয়া যায় না, যা সাধারণত ক্যান্সারে পাওয়া যায়।

- এই রোগীদের হাত-পায়ের রক্তনালী বা স্নায়ুগুলো ভালই থাকে। অনুভূতি স্বাভাবিক থাকে।

- জয়েন্ট ফ্রি থাকে, অর্থাৎ হাত পায়ের জয়েন্ট গুলো শক্ত হয় না। তবে দীর্ঘদিন অবহেলা করলে টিউমারটা জয়েন্ট ধরে ফেলে। ফলে জয়েন্ট শক্ত হয়ে যেতে পারে।

- প্যাথলজিকাল ফ্র‍্যাকচার হলে হাত-পায়ের হাড্ডি এমনি নড়ে বেড়াবে। একে বলে abnormal mobility.

ল্যাব টেস্ট

এক্স-রে: এক্স-রে করলেই অনেকটাই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এটা জায়ান্ট সেল টিউমার।

রক্ত পরীক্ষা: সেরাম এসিড ফসফাটেজ, এলকালাইন ফসফাটেজ, ক্যালসিয়াম, ফসফেট ইত্যাদি।

সিটি স্ক্যান ও এম আর আই: এগুলো দেখা হয় টিউমারের স্টেজ দেখার জন্য। বিশেষ করে আমেরিকার ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটির অর্থোপেডিক্স প্রফেসর এনেকিং ১৯৮০ সালে দেখিয়েছিলেন টিউমারগুলো ৩ ধরনের অবস্থায় (স্টেজ) থাকতে পারে।

১. আছে, কিন্তু নিষ্ক্রিয়
২. সক্রিয়
৩. মারাত্মক বা আগ্রাসী।

এই অবস্থাগুলো বুঝা যায় এম আর আই করলে। কারন অবস্থা বুঝেই ব্যবস্থা (চিকিৎসা) নিতে হয়।

বায়োপসি: অপারেশনের শুরুতেই টিউমার কোষ নিয়ে হিস্টোপ্যাথলজি রিপোর্ট করতে পাঠানো হয়, একে বলে ফ্রোজেন সেকশন বায়োপসি। যদিও অপারেশনের পূর্বেই মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যাওয়া যায় যে, এটা জায়ান্ট সেল টিউমার। তাই এটা করা হয় না। আর এটার সুবিধাও সব জায়গায় নেই। তাই অপারেশন করে দেওয়া হয় এবং বায়োপসি পাঠানো হয়।

চিকিৎসা

চিকিৎসা নির্ভর করে কতগুলো বিষয় মাথায় রেখে-

১. শরীরের কোথায় হয়েছে এবং কত বড় সাইজ।
২. প্রফেস এনেকিংয়ের টিউমার স্টেজ।
৩. হিস্টোলজিকাল গ্রেডিং।

চিকিৎসা পদ্ধতি: অপারেশন

ক. স্টেজ ১ এবং ২ হলে (অর্থাৎ টিউমারটা নিষ্ক্রিয় বা সক্রিয় হলে) হাড়টা রেখে বিভিন্ন সার্জারী পদ্ধতি অনুসরণ করে টিউমার ফেলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে জনপ্রিয় হল কিউরেটেজ+কেমিক্যাল কটারাইজেশন+বোন গ্রাফট+বোন সিমেন্ট। তবে লিকুইড নাইট্রোজেন ব্যবহার করতে পারলে সবচেয়ে ভাল। এতে পরবর্তীতে আবার হবার ঝুকি অনেক কমে যায়, যদিও এতে নার্ভ ইঞ্জুরি হওয়ার এবং স্কিন পুড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

খ. স্টেজ ৩ (মারাত্মক আগ্রাসী) হলে অনেক সময় আক্রান্ত পুরো হাড়ই ফেলে দেওয়া হয় এবং কৃত্রিম হাড়ের মত ডিভাইস লাগিয়ে দেওয়া হয়। এটা খুব একটা পরিচিত নয়।

ওষুধ
বর্তমানে ডেনোসুমাব নামে একটা ওষুধের প্রচলন বেড়েছে।

ফলো-আপ

এই রোগীদের নির্দিষ্ট সময় পরপর চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হতে হবে এবং এক্স রে করে অন্যান্য শারিরিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে হবে যে, আবার হচ্ছে নাকি? প্রশ্ন হল কত দিন পরপর রোগীরা ফলো-আপে আসবেন? অপারেশন পরবর্তী প্রথম বছরে রোগীদের তিন মাস পরপর আসতে হবে। আর দ্বিতীয় বছরে আসতে হবে ছয় মাস পরপর। তবে নরমাল থাকলে তৃতীয় বছর থেকে বছরে একবার ফলো-আপে চলে আসলেই হবে।

জটিলতা

১. আবার হতে পারে (১৫% ক্ষেত্রে)
২. অবহেলা বা অপচিকিৎসা করলে আক্রান্ত হাড় ভেঙে যেতে পারে।
৩. ক্যান্সারে রুপ নিতে পারে।

আমাদের দেশে জায়ান্ট সেল টিউমার পরিচিত রোগ। প্রায় এরকম রোগী হাসপাতালে পাওয়া যায়। অনেকে গুরুত্ব দেন না৷ হাড়ের ব্যাথায় কিটোরোলাক বা ন্যাপরোক্সেন জাতীয় ওষুধ দিনের পর দিন খেয়ে যান। কিছুদিন ভাল থাকেন আবারো ব্যাথা হলে ওষুধ খান। এভাবেই চলতে থাকে।

এতে কিডনী লিভারের ক্ষতি হয়। হাড় ব্যাথাকে অবহেলা করেন। শেষমেশ যখন ফোলা দেখা যায়, তখন দুশ্চিন্তায় পড়েন এবং হাসপাতালে আসেন। তার আগে আসতে চান না। কাল ক্ষেপন করলে যে কোনো অসুখই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এখানেও তাই-ই ঘটে। টিউমারটা বড় হয়ে যায় এবং অনেক সময় জয়েন্ট ধরে ফেলে এবং জয়েন্টের ক্ষতি সাধন করে।

তাই আগে-ভাগে রোগ ধরা এবং দ্রুত চিকিৎসা নিলে এই রোগীরা সুন্দর জীবন যাপন করতে পারে।

এনএআর/

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এমবিবিএস গ্র্যাজুয়েটদের আবেদন

বিসিএস পরীক্ষা: সবার বয়স বাড়লেও সুখবর নেই চিকিৎসকদের

ইটনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে

আউটডোরে ৪৫০-৫০০ রোগী দেখেন ২ চিকিৎসক

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত