ডা. সুরেশ তুলসান

ডা. সুরেশ তুলসান

সহকারী অধ্যাপক (সার্জারি), কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ।


০৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ১২:৩৫ পিএম

ওষুধের স্যাম্পল: একজন চিকিৎসকের ভাবনা

ওষুধের স্যাম্পল: একজন চিকিৎসকের ভাবনা
সব কিছু আমরা ঠিক করতে পারবো না। তবে স্যাম্পল নামক এই দুষ্ট প্রথা যদি দূর করতে পারি সেটাই বা কম কী?

কিছুদিন পূর্বে একজন বুদ্ধিজীবী একটা টক শো তে এরকমই একটি মন্ত্যব্য করে ব্যাপক জনরোষ, সরি ডাক্তার রোষের শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। মন্তব্যটা ছিলো অনেকটা এরকম, যদিও আমি নিজে চোখে বা কানে লাইভ দেখি নাই বা শুনি নাই, পরে জেনেছি। ‘ডাক্তাররা কোনো একটি ওষুধ কোনো রোগীকে লেখার আগে সেই ওষুধ ওই ডাক্তার সাহেব নিজে খেয়ে ওষুধের গুণাগুণ ও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’ একটু এদিক ওদিক হতে পারে ভাষার তারতম্যে। কথা হলো, টক-শোতে কত লোকে কত কথাই বলে। ওষুধের স্যাম্পল (নমুনা) নাকি চিকিৎসকদেরকেই খেতে হবে। তিনি এটা বলতেই পারেন।

তার এই মন্তব্যের ব্যাপক যৌক্তিক এবং অযৌক্তিক সমালোচনা হয়েছে। অনেকে তাকে গালাগালি ও নানান উপাধি দিয়েছেন। চিকিৎসকদের কেউ কেউ তাকে চিনে রাখার হুমকি দিয়ে বলেছেন, কোনো চিকিৎসকের চেম্বারে ঢুকলেই যেন, তাকে বের করে দেওয়া হয়। চিকিৎসা দেওয়া না হয়। আরও অনেক কথা বলা হয়েছে।

ওষুধের স্যাম্পল (নমুনা) বলে একটা বিষয় আমাদের ওষুধ শিল্পের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় বৈধভাবে স্থান করে আছে দীর্ঘদিন ধরে। আমার জানা ভুল হতে পারে, যতদূর জানি এই স্যাম্পলের ওষুধ বিনা ট্যাক্সে বাজারে আসে। চিকিৎসকদের মাঝে বিলি করার জন্য প্রায় সকল ওষুধ কোম্পানিরই ভালো বেতন-ভাতা ভুক্ত দক্ষ ও উচ্চশিক্ষিত এমপিও (MPO)বাহিনী আছে। যাদেরকে স্থানীয় ভাষায় রিপ্রেজেন্টেটিভ বলা হয়।

এখন প্রশ্ন হলো-ডাক্তার সাহেব যদি এই স্যাম্পল না খান, তাহলে স্যাম্পল দিয়ে কি করবেন, কে খাবে? প্রথম উত্তর রোগী সেবন করে দেখবেন, ওষুধের গুণাগুণ ঠিক আছে কিনা, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কেমন? যদিও আজকের দিনে বিশ্বের কোথাও এই সুযোগ নেই।

কারণ, এই আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে যে কোনো ওষুধকে বাজারজাত করার পূর্বে ল্যাবরেটরিতে, প্রাণীদেহে এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে মানবদেহেও বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ক্লিনিকাল ট্রায়ালের (Clinical Trial) পর বেশকিছু আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মান নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক গুণাগুণ, কার্যকারিতা ও নিরাপদ কিনা সে বিষয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে বাজারজাত করতে হয়।

সাধারণত কোনো ওষুধের এক সেট স্যাম্পলে (নমুনা) পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ থাকে না, যা দিয়ে কোনো একজন রোগীর নির্দিষ্ট রোগের উপর পরীক্ষা করা যায়। একটা বিশেষ রোগের শ্রেণিভুক্ত রোগীর উপর পরীক্ষা তো অনেক পরের কথা।  প্রচলিত আইনে স্যাম্পল (নমুনা) ওষুধ বাজারে বিক্রি নিষেধ। ধরা পড়লে শাস্তি ও জরিমানা।

দ্বিতীয় উত্তর, ওই ওষুধ ডাক্তারকে খেয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, হোক না তা যত কঠিন রোগেরই ওষুধ। ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া যত কঠিনই হোক না কেনো, তা ডাক্তার সাহেবকেই খেয়ে দেখতে হবে। তা না করা হলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা থেকে স্যাম্পল (নমুনা) নামক এই ব্যবস্থাটি চিরতরে বিলুপ্ত করতে হবে। যদি তা না করা হয়, তাহলে আমি টক-শোর সেই বুদ্ধিজীবী সাহেবের পক্ষে।

ওষুধ স্যাম্পলের ক্ষতিকর দিক

১. ট্যাক্স ফ্রি কিন্তু বাজারেই বিক্রি হয়, এতে সরকার কিছু রাজস্ব হারায়।
২. স্যাম্পলের নামে কারখানার বাইরে এনে ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে বিক্রির একটা সুযোগ থেকেই যায়।
৩. স্যাম্পলগুলো অনেক সময় পড়ে থেকে নষ্ট হয়, সুতরাং অপচয়। 
৪. প্রায়ই স্যাম্পলসমূহ কাটা কাটা স্টিপে থাকে বিধায় মেয়াদউত্তীর্ণ হলেও বোঝা যায় না। অনেক সময় বস্তায় ঢুকাতে যে সময় লাগে, সেই সময়ে অনেক স্যাম্পলের মেয়াদ থাকে না। অথচ অজান্তে বা জেনেও বাজারে বিক্রি হয়ে যায়।
৫. অনেকে হয়তো মনে করেন যে, ডাক্তাররা ওষুধের স্যাম্পল পেয়ে থাকেন বিধায় ডাক্তারদের নিজের এবং পারিবারিক প্রয়োজনে ওষুধ কেনা লাগে না। বিষয়টি মোটেও ঠিক না। স্যাম্পল হিসাবে প্রাপ্ত ওষুধ কখনোই ডাক্তারদের নিজের বা পারিবারিক প্রয়োজনে তেমন কাজে আসে না। এই স্যাম্পল হিসাবে প্রাপ্ত ওষুধের জন্য ডাক্তাদের অনেক সময় উল্টো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়।

কারণ, প্রয়োজনের সময় স্যাম্পলের ওষুধ বস্তায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর থাকলেও পরিমাণে পর্যাপ্ত হয় না। ফলে তেমন কাজে লাগে না। সুতরাং শেষ পর্যন্ত ওষুধ কেনাই লাগে।

আর বিড়ম্বনার কারণ হলো, স্যাম্পল হিসাবে প্রাপ্ত মনে করে অনেক সময় কিছু কিছু বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজন ডাক্তারের নিজে খাওয়ার জন্য কেনা ওষুধেও ভাগ বসান। তারা ভাবেন ডাক্তাররা তো ফ্রিতেই ওষুধ পায়।

৬. সামান্য স্যাম্পল বিলির জন্য উচ্চ শিক্ষিত দক্ষ জনশক্তির ব্যবহার অপচয় এবং লজ্জাকর। 
৭. বর্তমান বাজারে বেশ কিছু ভালো ভালো ওষুধ কোম্পানি আছে, যাদের মার্কেট পলিসিতে স্যাম্পল নামক কোনো বিষয় নেই। 
৮. আবার এমন ডাক্তারের সংখ্যাও অনেক যারা স্যাম্পল নিতে অস্বীকার করেন।
৯. স্যাম্পল ওষুধ  প্রস্তুত, প্যাকিং, বিলি- বন্টণের খরচ ও অপচয়ের বোঝার প্রভাব পড়ে ওষুধের দামের উপর। এতে দাম বাড়ে।

পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বুঝা যায় যে, আইন করে ওষুধের স্যাম্পল বিলি নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে।

অনেকে আমার এই লেখা পড়ে ওষুধ কোম্পানি আর ডাক্তারদের মধ্যে বিভিন্ন রকম সম্পর্ক, লেনদেন, উপঢৌকন, বিদেশ ভ্রমণ, ইত্যাদি নিয়ে নানা কথা বলবেন। তাদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য হলো, সব কিছু আমরা ঠিক করতে পারবো না। তবে স্যাম্পল নামক এই দুষ্ট প্রথা যদি দূর করতে পারি সেটাই বা কম কী?

আমার বিশ্বাস বর্তমান সময়ে অধিকাংশ ডাক্তারই স্যাম্পল (নমুনা) প্রথার বিপক্ষে। Unfortunately (দুর্ভাগ্যবশত) আমিই হয়ত প্রথম মুখ খুললাম।

টিআই/

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত