মানব কঙ্কাল ব্যবহারে চাই সুস্পষ্ট নীতিমালা

স্কুলে পড়াকালীন সময়ের কথা, আমাদের স্কুলের মূল ভবনের পিছনে ছিল বিজ্ঞান ভবন। ভবনটি বেশ পুরনো, রাজকীয় ডিজাইনের। সংস্কারের অভাবে জীর্ণদশা। থমথমে ভুতুড়ে পরিবেশ। শুধুমাত্র ব্যবহারিক ক্লাস বাদে অন্যান্য সময়ে ওখানে কেউ যেত না। ছোটদের যাওয়ার তো প্রশ্নই উঠে না, অবশ্য সঙ্গত কারণেই। আমরা জানতাম, ওটাকে ভুতের আবাসস্থল হিসাবেই। কারণ ওখানে বিজ্ঞান গবেষণাগারে ছিল একটি মানুষের কঙ্কাল। ওটা নাকি ছিল একটা নারীর কঙ্কাল, যে নাকি ভরদুপুরে এবং সন্ধ্যার পরে পেত্নী হয়ে গবেষণাগারের আশপাশে ঘুরে বেড়ায় এবং সুযোগ মতো বাগে পেলে যে কারও বিশেষ করে বাচ্চাদের ঘাড় মটকে রক্ত চুষে খেতেও দ্বিধা করে না। মিথ্যা বলবো না, ছোট ক্লাসে থাকাকালীন দরজার ফাঁক দিয়ে সাহসী ডানপিটে বন্ধুদের পাল্লায় পরে সেই নারী কঙ্কালের সৌম্যমূর্তি দেখার দুঃসাহস আমারও দুই-একবার হয়েছে। পরে বড় ক্লাসে খুব কাছ থেকে তার হাড়গুলো ছুঁয়ে দেখেছি বারকয়েক। একবার তো কয়েকজন সহপাঠীরা মিলে গুণে গুণে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি হাঁড়ের সংখ্যা ২০৬টা মিলে যায় কিনা।
একদিন ব্যবহারিক ক্লাসে ডেমোনেস্ট্রেটর স্যারকে সাহস করে কঙ্কালরূপী সেই নারীর নাম ঠিকানা পরিচয় জিজ্ঞাসা করে সহপাঠীদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপের শিকারও হয়েছি। পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ১ম বর্ষে ভর্তি হয়ে জানতে পারলাম, প্রত্যেক শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশোনার জন্য ব্যক্তিগত এক সেট করে মানব কঙ্কাল কিনতে হয়। অনেকেই আবার কয়েকজন মিলে শেয়ারে একসেট কঙ্কাল কিনে থাকে। হোস্টেলের দেয়ালে সাঁটা ‘এক সেট বোন্স বিক্রি হবে’ মার্কা বিজ্ঞাপন দেখে আমিও কিনেছিলাম একসেট। অবশ্যই একা একা। টাকার প্রাচুর্য ছিল, এমনটা নয়; পার্টনার পাইনি তাই বাধ্য হয়েই। তবে এতটুকু বলতে পারি আমার কঙ্কালের সেটটিই ছিল সেরা। দেখে বুঝেছিলাম হাঁড়গুলো ছিল একজন সবল পেশীবহুল পুরুষ মানুষের। কি মোটা মোটা আর শক্ত শক্ত হাত এবং পায়ের লম্বালম্বা হাঁড়গুলো দেখে হাড়ের মালিকের একটা চেহারা কল্পনা করার চেষ্টা করেছি অনেকবার। এনাটমির ডিসেকশন ফরমালিনে হলে আস্ত আস্ত মানুষের শবদেহের ব্যবচ্ছেদ বা মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার ছিল একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে নিজেদের কোনো স্বজনের মৃতদেহকে বা দেহাবশেষ এমনকি দেহভষ্মকে আমরা যতখানি সম্মান করেছি, তার ছিটেফোঁটাও কোনো দিন কোনো মেডিকেল ছাত্রদের মধ্যে দেখিনি।
এতো গেল মানবিক ভাবনাসমূহ। এবার আইনগত দিকগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি। একটি মৃতদেহ (মানব কঙ্কাল বা মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ) মানেই একটি মৃত্যু। মৃত্যু মানেই হলো একজন মানুষ, তার একটি নির্দিষ্ট পরিবার, পরিচয়, মৃত্যুর কারণ। স্বাভাবিক মৃত্যু, নাকি দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, অপহরণ, খুন, গুম, ধর্ষণ; এমন নানান প্রশ্ন। অনেকবারই ভেবেছি, আমার পড়ার টেবিলে থাকা মানব কঙ্কালটি বা ডিসেকশন হলের সেই মৃতদেহগুলো বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের পরিচয় কি, কিভাবে মৃত্যুবরণ করলেন, তাদের মৃত্যুর খবর আদৌ তাদের পরিবার পেয়েছিলেন কিনা, আদৌ কি উনাদের কোনো শেষকৃত্য হয়েছিল কিনা, মৃতদের হাঁড়গুলো কে কিভাবে বের করেছিলেন ইত্যাদি।
আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন এক সেট মানব কঙ্কালের দাম ছিল মাত্র কয়েকশ’ টাকা। সামগ্রিক দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, টাকার অবমূল্যায়ন, মানব কঙ্কাল বেঁচাকেনার কোনো বৈধ নীতিমালার অভাব, মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে দাম এখন আকাশছোঁয়া। ৫০ হাজারেও এখন ভালো একসেট মানব কঙ্কাল পাওয়া দুস্কর। অনেক সময় কবর থেকে মানব কঙ্কাল চুরি বা চোরাচালানের খবর পাওয়া যায়। চোরাচালানের কঙ্কালসমূহের উৎস সম্পর্কিত কোন তথ্য কোন খবরে পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। কখনো শুনিনি এই কঙ্কাল তৈরির জন্য ব্যবহৃত এই মৃতদেহগুলোর খুন এবং গুমের কারণে কাউকে কখনো কোন প্রশ্ন করা বা শাস্তি দেওয়া হয়েছে কিনা।
চিকিৎসা শিক্ষাসহ অন্যান্য যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা গবেষণাগারে যে সমস্ত মানব কঙ্কাল সংরক্ষিত আছে বা ব্যবহৃত হচ্ছে সেই সকল কঙ্কালসমূহের উৎস সম্পর্কিত কোনো তথ্য কি আদৌ আছে কোথাও? কার কাছ থেকে কেনা হয়েছে, আছে কোন খরিদা রশিদ? এই কঙ্কালগুলো তো আমার আপনার কোন হারিয়ে যাওয়া আপনজনেরও তো হতে পারতো?
আমাদের দেশে চিকিৎসা শাস্ত্রে বা গবেষণার উদ্দেশে স্বেচ্ছায় নিজ মৃতদেহকে দান করার খবর আমরা পাই, তবে তা কালেভদ্রে। প্রতি দশকে হয়তো হাতে গোনা কয়েকটা। বাদ বাকি আসে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় বা অন্য কোনো কারণে এবং সরকারি হাসপাতালে মৃত বেওয়ারিশ মৃতদেহগুলো।
চিকিৎসা শাস্ত্রে মানব কঙ্কাল বা মানব শবদেহ ব্যবহারের বিপক্ষে আমি নই, তবে এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে এবং তা পালন করতে হবে।
প্রস্তাবনাসমূহ
১. প্রত্যেকটি মৃতদেহ বা কঙ্কালের জন্য উনার রাষ্ট্রীয় পরিচয় এবং এনআইডি নাম্বার, মৃত্যুর দিন তারিখ, মৃত্যুর কারণ এবং হস্তান্তর প্রক্রিয়ার উল্লেখসহ একটি নির্দিষ্ট নম্বরে শনাক্তকরণপত্র বা পরিচয়পত্র থাকতে হবে।
২. অজ্ঞাত ব্যক্তির ক্ষেত্রে মৃতদেহ প্রাপ্তিস্থান বা দুর্ঘটনার স্থান, মৃত্যুর তারিখ এবং মৃতদেহ প্রাপ্তি কালে উনার ছবি শনাক্তকরণপত্রে সংযুক্ত থাকতে হবে। অবশ্যই একটি মৃতদেহ শনাক্তকরণ নাম্বার দিতে হবে।
৩. মৃতদের বা কঙ্কাল যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকবে তিনি এই শনাক্তকরণ বা পরিচয়পত্র হেফাজত করবেন।
৪. মানব কঙ্কাল বেচাকেনার জন্য একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে, যেমন: কে বা কারা বিক্রি করতে পারবেন। ব্যক্তি পর্যায়ে ক্রয়-বিক্রয় সংরক্ষণ করা যাবে কিনা। ব্যক্তি পর্যায়ে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় ব্যবহার করা যাবে। ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে হোস্টেলে রাখা যাবে কিনা অথবা ছুটির দিনে পড়াশোনার জন্য বাড়িতে নিতে পারবেন কিনা ইত্যাদি।
৫. প্রতিবার হাত বদলের ক্ষেত্রে মৃতদেহ শনাক্তকরণ নাম্বারের উল্লেখসহ নির্দিষ্ট ফরমে চুক্তিপত্র সম্পাদন করতে হবে।
৬. চিকিৎসা শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত সকল শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং লোকজনদের উচিত হবে এই সকল মৃত মানুষদেরকে একটি শিক্ষা উপকরণ না ভেবে একজন মানুষ হিসেবে তাদের প্রাপ্য সন্মান দেওয়া। যিনি তার অমূল্য দেহটি উৎসর্গ করেছেন আপনাদের এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য।