ডা. নুসরাত সুলতানা লিমা

ডা. নুসরাত সুলতানা লিমা

সহযোগী অধ্যাপক (ভাইরোলজি),
পিএইচডি গবেষক (মলিকুলার বায়োলজি),
ইনস্টিটিউট ফর ডেভলপিং সায়েন্স এন্ড হেল্থ ইনিশিয়েটিভস। 


০২ জুলাই, ২০২২ ১১:৩১ এএম

‘সাবসেন্টারে ভিজিট আর অপারেশন চার্জ নিতে চাপ প্রয়োগ করা হতো’

‘সাবসেন্টারে ভিজিট আর অপারেশন চার্জ নিতে চাপ প্রয়োগ করা হতো’
‘সাবসেন্টারে ভিজিট আর অপারেশন চার্জ নিতে আমাকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। আমি সাফ বলে দিতাম, অনৈতিক কোনো কাজ আমি করি না। এ পবিত্র পেশায় অনৈতিকতা বেমানান।’

আজ ২ জুলাই, বিসিএস এ জয়েনিংয়ের ১৭ বছর। কোনো ইচ্ছা ছিল না—বিসিএসে জয়েন করার। শহরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা, আমি গ্রামে গিয়ে কাজ করবো ভাবতেই পারতাম না। সবচেয়ে বড় কথা আমি অত্যন্ত হোমসিক। যতই ঘোরাঘুরি করি না কেন, দিন শেষে আপন আলয়ে ফিরে আসার আনন্দটুকু অপ্রতীম আমার কাছে। তা ছাড়া রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে আমার চাকরি, কোয়ার্টার সবই হয়ে গিয়েছিল। আর গাইনিতে এফসিপিএস প্রথম পর্ব ও হয়েছে এরই মাঝে। তবুও এই ‘দিল্লি কা লাড্ডু’ বিসিএসে জয়েন না করার সাহস কেউ দিতে পারলো না। বরঞ্চ একটু চাপের মাঝেই ছিলাম। 

পুলিশ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের খুব স্নেহভাজন ছিলাম আমি। উনিই একমাত্র আমাকে এই আশ্বাস দিলেন যে, এখানে থাকলে পোস্টগ্রাজুয়েশন শেষ করার সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দেবেন। কিন্তু কি এক সম্মোহনে ২০০৫ সালের জুলাইয়ের দুই তারিখ বিসিএসে জয়েন করি।

আমার প্রথম পোস্টিং বিখ্যাত সাব-সেন্টারে হয়। কেন বিখ্যাত জানেন? ওটা বর্তমান সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আর সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদের এলাকা। 

অনেকের অনেক রকম উপদেশে আমার কান ঝালাপালা হওয়ার দশা। কিভাবে কাজ করবো, এই বৈরি পরিবেশে? আমি তো একেবারেই অভ্যস্ত নই। 

এতদিন যে আমি সিনিয়রদের ছায়াতলে ছিলাম, সেই আমাকে চিকিৎসা সংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত একাই নিতে হবে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হতো আর পরিবেশটাও ছিল ভয়াবহ পলিটিক্যাল। 

জয়েনিংয়ের দুই দিন পর স্থানীয় মেম্বার আর তার কিছু সাঙ্গ পাঙ্গ ২ লিটারের সেভেন আপের বোতল আর কয়েক প্যাকেট এনার্জি বিস্কুট নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাদের কথা-বার্তা আর বেশভূষা দেখে অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়ি। এ কোথায় আসলাম আমি? পুলিশ হাসপাতালের চাকরি ছাড়ার জন্য আক্ষেপ হতে থাকে।

এরপর কেটে যায় কিছুদিন। নিজেকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করি। মনযোগ দিয়ে রোগী দেখতে থাকি। অল্প ক’দিনেই তাদের জন্য একটা কোমল স্থান তৈরি হয় হৃদয়ে।  

একজন মহিলা ডাক্তার পেয়ে নারী রোগীরা যেন হালে পানি পেল। এতদিন ধরে একজন স্যাকমোর কাছে তারা তাদের স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো জানাতো। স্বাভাবিকভাবেই আশাপ্রদ চিকিৎসা পেত না। আমি আসার পর আমার কাছে তারা মন খুলে তাদের সমস্যার কথা বলে আস্বস্ত হতেন। 

আমার বেশভূষার জন্য তারা প্রথমে খুব ইতস্তত বোধ করতেন। গ্রামাঞ্চলের মানুষরা খুবই পর্দানশীল হন। আপাদমস্তকই ঢাকা আর আমার শহুরে চাল-চলন, বেশভুষা। কাছে ঘেঁষতেও যেন এক অদৃশ্য বাঁধা। নিজেকে পরিবর্তিত করি। মাথায় কাপড় দেওয়া শুরু করি। আস্তে আস্তে ওদের অন্তরঙ্গ হয়ে যাই। ভালবেসে ফেলি অসহায় মানুষগুলোকে। 

ঢাকা থেকে কিছু সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি নিয়ে sebaceous cyst, bartholin cyst excision, perineal tear repair শুরু করি। ইতোমধ্যে হয়ে যাই সাবসেন্টারের স্যাকমো আর মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্টের শত্রু। আমাকে ভিজিট নেওয়া আর অপারেশন চার্জ নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। আর এও বলে ভিজিট না নিলে আমাকে কেউ বড় ডাক্তার মনে করবে না।

আমি সাফ বলে দিতাম, ‘তাতে আমার কিছু আসে যায় না, অনৈতিক কোনো কাজ আমি করি না।’ এ পবিত্র পেশায় অনৈতিকতা বেমানান। নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকে চিকিৎসা করতে থাকি।

গাইনিতে এফসিপিএস প্রথম পর্ব করা ছিল, ক্যারিয়ারের ব্যাপারটাও আমার কাছে ছিল মুখ্য। এর মাঝে মন্ত্রণালয় থেকে একটা সার্কুলার হয়, যারা বিসিএস জয়েনিংয়ের আগে এফসিপিএস প্রথম পর্ব পাস করেছে, তারা কোর্স শেষে গ্রামে এসে কাজ করবে—এই শর্তে ট্রেনিংয়ে জন্য আবেদন করতে পারবে। আমিও আবেদন করি। এলাকার মানুষ ব্যাপারটা অচিরেই টের পায়। আমার প্রতি অগাধ ভালোবাসার প্রকাশস্বরূপ এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে তারা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার (ইউএইচএফপিও) কাছে আবেদন করে, যাতে আমার পোস্টিং অন্য জায়গায় না হয়। তারা আমাকে হারাতে চান না। আমি দ্বিধায় পড়ি। 

একদিকে ক্যারিয়ারের অমোঘ টান, অন্যদিকে মানুষের নিঃস্বার্থ ও আন্তরিক ভালবাসা। কষ্ট পেতে থাকি। এদিকে ইউএইচএফপিও অফিসের কেরানীরা আমাকে ট্রেনিং পোস্টের আবেদন অগ্রগামী করার জন্য উৎসাহ দিতে থাকেন। আর বলতে থাকেন, ‘ম্যাডাম, ওদের চিঠি ইউএইচএফপিও স্যারকে দেয়া যাবে না। দিলেই আপনার সব কিছু জনস্বার্থে আটকে যাবে।’

এখান থেকে ক্লিয়ারেন্স নিয়ে তাড়াতাড়ি সিভিল সার্জন অফিসের গন্ডি পার করার পরামর্শ দিলেন। আমিও তাই করলাম। বিদায়ের দিনে ভেদু মিয়া, রহিমা খালাসহ আরও অনেকের চোখের পানির কথা আজও ভুলতে পারি না। আমারও চোখ ভিজে উঠে। অনাত্মীয়ের প্রতি এতো কম সময়ে কীভাবে এতো ভালবাসা গড়ে উঠে আমি ভেবে পাই না।

আমাকে ইউএইচএফপিও অফিসের কর্মচারীরা ফেয়ার ওয়েল দেন। উপহার হিসেবে জায়নামাজ ও দেন। 

উল্লেখ্য, সাবসেন্টারে ৯ মাসের চাকরি জীবনে আমাকে এক পয়সাও ঘুষ দিতে হয়নি। কর্মচারীরা বেশিরভাগই রিটায়ারমেন্টে চলে গেছেন। এখনও আমি তাদের সাথে যোগাযোগ রাখি, তারাও। আমার সাফল্যে উনারা আমার নিকটাত্মীয়ের মতই আনন্দে উদ্বেলিত হন।
 
পরিশেষে, প্রথম পোস্টি আমার জীবনের জন্য ছিল এক আশির্বাদ। আমাকে শিখিয়েছে মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, নির্লোভ মনোভাব, নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদী হতে।

আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, বিসিএসে জয়েন করার ইচ্ছা আমার মাঝে জাগ্রত হয়েছিল। ফেলে আসা মানুষগুলোর অকৃত্রিম ভালোবাসার ঋণ কোন দিনও শোধ করতে পারবো না আমি। 
তাদের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাই। 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত