তাবাসসুম সুলতানা

তাবাসসুম সুলতানা

মেডিকেল শিক্ষার্থী


০৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ০৪:৪৭ পিএম

অমিক্রনে আতঙ্ক নয়, সতর্ক হোন

অমিক্রনে আতঙ্ক নয়, সতর্ক হোন
অমিক্রন করোনার নতুন আরেকটি ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট; যার মিউটেট হবার ক্ষমতা পূর্বের ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট থেকেও অনেক বেশি। ছবি: তাবাসসুম সুলতানা

বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন সবাই স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করেছে এবং দেশে করোনা শনাক্তের হার যখন এক শতাংশের ঘরে ও প্রাণহানিও কমে এসেছে ঠিক তখনি আবার নতুন আতঙ্ক ও উদ্বেগ জাগিয়েছে অমিক্রন। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের নতুন ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট অমিক্রন। ইতোমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ প্রায় ৪০টি দেশে, দক্ষিণ আফ্রিকায় শনাক্ত হওয়া সর্বশেষ ভ্যারিয়েন্ট অমিক্রন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২৬ নভেম্বর এই ভ্যারিয়েন্টকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ অর্থাৎ উদ্বেগের কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। চলুন, বিস্তারিত জেনে নেই অমিক্রন সম্পর্কে।

অমিক্রন কি?

ইতোপূর্বে আমরা করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট যেমন আলফা, বিটা, ডেলটা ইত্যাদি ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে অবগত হয়ে এসেছি। অমিক্রন এই প্রাণঘাতী মহামারী করোনাভাইরাসের নতুন আরেকটি ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট; যার মিউটেট হবার ক্ষমতা পূর্বের ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট থেকেও অনেক বেশি। সদ্য শনাক্ত হওয়া এই অমিক্রনের বৈজ্ঞানিক নাম বা কোড নাম ৫.১.১.৫২৯।

সর্বশেষ শনাক্ত এই ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে বেশি মিউটেট হওয়া সংস্করণ। সাউথ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, এই অমিক্রনের আরএনএতে জেনেটিক কোড (এডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ইত্যাদি) এই পর্যন্ত প্রায় ৫০ বারের মতো মিউটেট বা পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এর গায়ে থাকা স্পাইক প্রোটিন (যা ভাইরাসকে মানবদেহে প্রবেশে সাহায্য করে) প্রায় ৩০ বারের মতো মিউটেট ঘটিয়েছে। জেনে রাখা ভালো যে, এই স্পাইক প্রোটিনের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয় ভ্যাকসিন।

সর্বশেষ শনাক্ত হওয়া এই ভ্যারিয়েন্টে ভ্যাকসিন কার্যক্ষমতা কম হবার সম্ভাবনা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও অমিক্রনের রিসেপ্টর বাইন্ডিং (ডোমেইন ভাইরাসের যে অংশটি প্রথম মানবকোষের সাথে সংযোগ ঘটায়) এ মিউটেট ঘটেছে প্রায় ১০ বার যেখানে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে। এই ডোমেইনে মিউটেট ঘটেছিল মাত্র ২ বার। অর্থাৎ বলা বাহুল্য যে, সাউথ আফ্রিকান এই নতুন ভ্যরিয়েন্ট অমিক্রন মিউটেট বা রূপ পরিবর্তন করে অনেকভাবে এবং অতি দ্রুত।

সর্বপ্রথম শনাক্তকরণ

অতি সংক্রামক এই অমিক্রন সর্বপ্রথম শনাক্ত হয় বোতসোয়ানা এবং সাউথ আফ্রিকাতে। ২৪ শে নভেম্বর প্রথম সাউথ আফ্রিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিওএইচও)এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, ৯ নভেম্বর বোতসোয়ানার থেকে সংগ্রহ করা এক নমুনায় পাওয়া যায় এই ভ্যারিয়েন্ট। এছাড়া এটি বর্তমানে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সাউথ আফ্রিকা ছাড়াও ইউএসএ বেলজিয়াম, ভারতসহ আরও ৪০টি দেশে। গত মাসে জিনগতভাবে বিশ্লেষণ করা নমুনার প্রায় ৭৪ শতাংশই অমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট। বর্তমানে সাউথ আফ্রিকায় এই ভ্যারিয়েন্টে শনাক্তের সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি। তবে এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের কারও মৃত্যু হয়নি বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

কেন ওমিক্রন নামকরণ করা হয়?

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের এ পর্যন্ত অনেক ভ্যারিয়েন্ট বেড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, তাদের নামকরণ গ্রীক অক্ষর অনুসারে আলফা, বিটা, গামা, ডেলটা, ল্যামডা ইত্যাদি বিবরণের সুবিধার্থে  করা হয়৷ এই নিয়ম অনুসারে সদ্য আবিষ্কৃত নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের নাম হবার কথা ছিল Nu (নিউ) বা  Xi (জি) কিন্তু তা না হয়ে এর পরবর্তী অক্ষর অমিক্রন করা হয়েছে। মূলত উচ্চারণগত ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের নাম অমিক্রন রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। গবেষকরা মনে করেন, Nu (নিও) সহজেই New এর সাথে উচ্চারণগত কারণে কনফিউশান তৈরি করবে। ডব্লিউএইচওর মতে, Xi হচ্ছে কমন লাস্ট নেইম হিসেবে ব্যবহার হয়, বেশির ভাগ ব্যক্তির ক্ষেত্রে। তাই এই দুটি অক্ষর এড়িয়ে গিয়েছেন। তবে চীনের রাষ্ট্রপ্রধানের নাম শি জিনপিং (Xi jinping) বলে সেই কারণে নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের নামকরণ  Xi হয়নি বলে অনেকেই ধারণা করছেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কেন ‘ভ্যারিয়েন্ট অন কনসার্ন’ বলছেন

ইতোমধ্যে ইউএসের সার্চ কোভিড-২ ইন্ট্রিগ্রেন্সি গ্রপ (এসআইজি) বৈকল্পিক শ্রেণীবিভাগ প্রকল্পটি করোনাভাইরাসের ভ্যারিয়েন্টগুলোর চারটি শ্রেণী নির্ধারণ করেছে। এগুলা হলো-

১. ভ্যারিয়েন্ট বিয়িং মনিটরড (ভিবিএম), যার মধ্যে আলফা বিটা গামা ইত্যাদি ভ্যরিয়েন্ট আছে।

২. ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট (ভিওআই), এতে ল্যামডা, জেটা, ইটা ও থেটা ইত্যাদি ভ্যারিয়েন্ট।

৩. ভ্যরিয়েন্ট অব কনসার্ন (ভিওসি), এতে ডেলটা ও অমিক্রনকে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে।

৪. ভ্যারিয়েন্ট অব হাই কোনসিকুয়েন্স (ভিওএইচসি), এখন পর্যন্ত কোন ভ্যারিয়েন্ট এই শ্রেনিতে নেই।

অতি সংক্রামক করোনাভাইরাসের নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট অমিক্রন অতি দ্রুত ও সহজে সংক্রমিত হতে পারে। এতে মিউটেট হার অনেক বেশি। বিজ্ঞানীরা, একে উদ্বেগের কারণ বা ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন শ্রেণিতে রেখেছেন৷

-এই ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা রিইনফেকটেড অর্থাৎ এর দ্বারা পুনরায় সংক্রমণ হবার সম্ভাবনা বেটা ও ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট থেকে তিনগুণ বেশি।

-রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম।

-এন্টিবডির কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।

-ভ্যাকসিন কার্যকক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।

এ সকল কারণেই মূলত ডেলটার মতে অমিক্রনকেও ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন বলেছেন।

তবে শঙ্কার কথা হলো এই যে, আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি জানা যাচ্ছে।

অমিক্রনের উপসর্গ

একটি ভাইরাস যত বেশি সংক্রমিত হয় তত বেশি মিউটেশন হয়৷ মিউটেশন থেকেই তৈরি হয় নতুন ভ্যারিয়েন্ট। করোনাভাইরাসে এ যাবত অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তন এসেছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনের প্রভাব সামান্য। তবে নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব কতটা সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা এখনও বলা যাচ্ছে না। সাউথ আফ্রিকান ডা. এন্জলিজা কুয়েডজির ভাষ্যমতে, নতুন এই ভ্যারিয়েন্টের উপসর্গ অস্বাভাবিক; তবে খুবই মৃদু। হয়তো এ জন্যই এতদিন এই ভ্যারিয়েন্টটি ধরা পড়েনি। তিনি জানান- রোগীদের মাঝে ক্লান্তি অনুভব,মাংস পেশিতে ব্যথা ও মাথা ব্যথার উপসর্গ লক্ষ করা গিয়েছে। কিন্তু কোন কাশি ছিল না এবং স্বাদ গন্ধও না থাকার কোন কেস ছিল না। এছাড়াও ছয় বছরের এক শিশুর হাই পালস রেইট ছিল বলে জানিয়েছেন।

ডাটা এনালাইটিকাল ফার্মের ভেস্কি সৌনদরারাজান জানিয়েছেন, অমিক্রনের জিন বিন্যাসে সাধারণ ঠান্ডায় ভাইরাসের উপস্থিতি থাকার, কারণেই হয়তো অমিক্রনের মৃদু উপসর্গ বা কোন উপসর্গ ছাড়াই ছড়াতে পারছে।

ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর

এ পর্যন্ত করোনার ভ্যারিয়েন্টে হাজার হাজার পরিবর্তন এসেছে; ভাইরাসের এই পরিবর্তনগুলোই তাকে টিকে থাকতে সাহায্য করে। তবে স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। ভ্যাকসিনের এন্টিবডি এই স্পাইক প্রোটিনকে দেখে ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। আর তাই অমিক্রনের স্পাইক প্রোটিনের অনেক বার মিউটেট হবার কারণে করোনার যে স্ট্রেইনকে মাথায় রেখে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে।  তা এখন অনেকখানি ভিন্ন, তাই ভ্যাকসিন এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে কম বা কার্যকর নাও হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷ তবে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না। কারণ এ নিয়ে এখনো কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে প্রাথমিক তথ্য মতে, এই ভ্যারিয়েন্টে পুনরায় সংক্রমণ হবার আশংকা অনেক। অস্ট্রেলিয়া ও হংকং এ এমব ব্যক্তি পাওয়া গিয়েছে, যারা দুটি ডোজ টিকা নেওয়া হয়েছে তবু অমিক্রনে আক্রান্ত। তবে বিশেজ্ঞদের মতে, যাদের দুটি ডোজ নেয়া হয়েছে; তাদের ক্ষেত্রে অবশ্যই ভ্যাকসিনের মত কাজ করবে, তবে তা কতটুকু কার্যকর হবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না।

সচেতনতা ও সতর্কতা

নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আতংকিত না হয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। যেহেতু নতুন এই অতি সংক্রামক ভ্যারিয়েন্ট অতি দ্রুত ছড়াচ্ছে। এর উপসর্গ মৃদু বা নাই বললেই চলে। এছাড়া অনেকবার মিউটেশনের ফলে ভ্যাকসিন কতটা কার্যকর হবে বা আদৌ কার্যকর হবে কিনা তা এখনো নিশ্চিত না। তাই আমাদের নিজেদের সচেতন হতে পারে এই ভ্যারিয়েন্ট থেকে রক্ষার প্রধান ধাপ।

ভ্যাকসিন নেওয়া হয়ে গেলেও মাস্ক ব্যবহার করতে হবে৷ জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে, অচেনা মানুষজন থেকে মেলামেশা বন্ধ রাখতে হবে, হাত সেনিটাইজ রাখতে হবে, নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। তবেই আমাদের পরিবার সুরক্ষিত থাকবে। এসময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। যেমন: নিয়মিত শরীচর্চা ও ব্যায়াম করা, খাদ্য তালিকায় প্রচুর ভিটামিন ও আইরন ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে, পর্যাপ্ত ঘুম ও পানি পান করতে হবে৷ 

আতংকিত না হয়ে সতর্ক থাকার চেষ্টা করতে হবে। কারণ মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। এখনি সচেতন না হলে বাংলাদেশেও এই ভ্যারিয়েন্ট খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে অল্প সময়েই। তাই সরকারকে সংক্রমিত দেশগুলো থেকে আগত সকল যাতায়াত ব্যবস্থা বন্ধ রাখতে হবে, বেশি বেশি স্ক্রিনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে, টিকা কার্যক্রমকে আরও দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একই সাথে আমাদেরকে একে অপরকে সকল স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে। তবেই এই ভয়ংকর অতি সংক্রামক নতুন ভ্যারিয়েন্ট অমিক্রন থেকে আমরা সুরক্ষা পেতে পারি। 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক