০৬ মে, ২০২৫ ০৭:৪২ পিএম
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন

জেলা সদর ও মেডিকেল হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ

জেলা সদর ও মেডিকেল হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ
শিশু বিকাশ কেন্দ্র। ছবি: সংগৃহীত

মেডিভয়েস রিপোর্ট: সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে শিশু বিকাশ কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার প্রদানের সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। সকল জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়েছে। প্রয়োজনে কেন্দ্রগুলোকে রেফারেল ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে এসে রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনার সুপারিশও করা হয়েছে।

সোমবার (৫ মে) প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেওয়া স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করা হয়।

প্রতিবেদনের ‘স্বাস্থ্য সেবাদান ও ভৌত অবকাঠামো’ শীর্ষক তৃতীয় পরিচ্ছেদের ‘হাসপাতাল এবং রোগ নির্ণয় পরিষেবাভিত্তিক সংস্কার প্রস্তাবনা’য় সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্যে গৃহীতব্য কার্যাবলীর ১৫টি প্রস্তাবনা তুলে ধরে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। এর মধ্যে শিশু বিকাশ কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার প্রদান অন্যতম। এতেও বেশ কয়েকটি প্রস্তাব তুলে ধরেছে কমিশন। এগুলো হচ্ছে—

শিশু বিকাশ কেন্দ্র পুনর্বিন্যাস
শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোকে তাদের মূল ধারণা অনুসারে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। কেন্দ্রগুলোকে শিশুদের কোনো রোগ বা ব্যাধির আলোকে চিহ্নিত করা হবে না। কারণ রোগ বা ব্যাধির কেন্দ্রগুলো প্রতিটি শিশুর সীমাবদ্ধতাগুলোকে সামনে নিয়ে আসে; তাদের শক্তি নয়, দুর্বলতাগুলো নিয়ে কাজ করে।

মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং মান উন্নয়ন
সকল জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি সেবার অংশ হিসেবে মাল্টি-ডিসিপ্লিনারি শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং মান উন্নয়ন করতে হবে। প্রতিষ্ঠিত শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোতে একজন অভিজ্ঞ শিশু স্বাস্থ্য চিকিৎসক, শিশু মনোবিজ্ঞানী এবং উন্নয়ন থেরাপিস্টসহ বিশেষজ্ঞদের একটি প্রশিক্ষিত দল দ্বারা শিশুদের পরিষেবার মান নিশ্চিত করতে হবে।

উচ্চতর শিশু বিকাশ কেন্দ্রে রেফারেলের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনা
কিছু কিছু শিশুর প্রয়োজনের ভিত্তিতে মাধ্যমিক বা সেকেন্ডারি ও উচ্চতম (টারশিয়ারি) শিশু বিকাশ কেন্দ্রে রেফারেলের মাধ্যমে যথাযথ রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে।

শিশুর স্নায়বিক বিকাশের দ্রুত মূল্যায়ন ও প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা গ্রহণ
শিশুর স্নায়বিক বিকাশের দ্রুত মূল্যায়ন ও প্রয়োজনমতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

প্রশিক্ষণ, জনবল ও গবেষণা পরিচালনা
শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, জনবল সৃষ্টি ও এ সকল বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করতে হবে।

শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপন এবং সহায়তার জন্য আইন
শিশু বিকাশ কেন্দ্র স্থাপনে এবং তার কার্যক্রম ও কর্মসূচিতে সহায়তার জন্য একটি যুগোপযোগী আইন তৈরি করতে হবে।

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন এসব প্রস্তাবনা বাস্তবায়নের সময়সীমা তিন বছর নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া এর দায়িত্ব ও প্রক্রিয়া প্রস্তাবিত বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস ও ক্লিনিক্যাল সেবা অধিদপ্তরে অর্পণের সুপারিশও করেছে কমিশন।

প্রসঙ্গত, স্নায়ু-বিকাশগত সমস্যা রয়েছে এমন শিশুদের নিয়ে কাজ করে শিশু বিকাশ কেন্দ্র। ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নির্দেশনায় শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লায়লা জামান খানের প্রচেষ্টায় শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রকল্পটি সেক্টর কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরের বছর আগস্ট মাসে পাঁচটি কেন্দ্রের মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১০ ও ২০১৪ সালে পাঁচ করে ১০টি কেন্দ্র বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালের মার্চে আরও ২০টি কেন্দ্র এই প্রকল্পে যুক্ত হয়। এই ৩৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪টি এবং জেলা সদর হাসপাতালে ১১টির কার্যক্রম চলমান আছে।

জানা গেছে, প্রতিটি কেন্দ্রে একজন শিশু স্বাস্থ্য চিকিৎসক (চাইল্ড হেলথ ফিজিশিয়ান), একজন শিশু মনোবিজ্ঞানী (চাইল্ড সাইকোলজিস্ট) ও একজন ডেভেলপমেন্টাল থেরাপিস্ট রয়েছেন। এ ছাড়া একজন করে পরিচ্ছন্ন কর্মী থাকেন। এর বাইরে প্রথম ১৫টি কেন্দ্রে একজন অফিস ম্যানেজারও আছেন। সব মিলে ৩৫টি কেন্দ্রে চাকরি করেন ১৭৫ জন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এই প্রকল্পে মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে রয়েছেন আরও ১১ জন, এর মধ্যে তিনজন সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর। সর্বশেষ তথ্যমতে, মোট ১৮৬ জনের মধ্যে শূন্যপদ রয়েছে ৩৭টি।

গত বছরের জুনের একটি হিসেবে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের আগস্ট মাস থেকে ৩৫টি কেন্দ্রে প্রায় দুই লক্ষ ৩৭ হাজার ৯৩৪ শিশু স্নায়ু-বিকাশজনিত সমস্যার সেবা গ্রহণ করেছে। শিশু বিকাশ কেন্দ্রে চিকিৎসা পেশাজীবীদের একটি সমন্বিত দল স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর একই সাথে একই সেটিংসে সকল বিশেষায়িত সেবা প্রদান করছে। নিজ জেলায় মাত্র ১০টাকায় শিশুরা এই সেবা নিতে পারে। সমাজের নিম্ন আর্থসামাজিক শ্রেণি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে এই শিশু বিকাশ কেন্দ্র। দেশে প্রতিবন্ধিতার হার কমিয়ে সুস্থ নাগরিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই কেন্দ্রগুলোর।

এদিকে গত বছরের জুন মাসে শিশু বিকাশ কেন্দ্রসহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন সবগুলো অপারেশনাল প্ল্যানের মেয়াদ শেষ হয়। পরবর্তীতে এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ চললেও বেতন-ভাতার পাশাপাশি চাকরি অনিশ্চয়তায় পড়েন শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। প্রায় এক বছরেও কোনো সমাধান দেয়নি সরকার। বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও থোক বরাদ্দও দেওয়া হয়নি প্রকল্পগুলোতে।

এ নিয়ে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে চার দফা দাবি তুলে ধরেন শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা। দাবিগুলো হলো—

১. শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিগত মাসের প্রাপ্য বকেয়া বেতন ও ভাতা অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে।
২. শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোকে রেভিনিউ বাজেটের অন্তর্ভুক্তি বা সরকারি বিশেষ সেবাদানকারী গুরুত্বপূর্ণ জরুরি সেবা হিসাবে চালুর বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৩. শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবার মান উন্নয়নের জন্য শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন করতে হবে।

এনএআর/

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক