স্বাস্থ্যসেবা ও সচেতনতা সৃষ্টির অনন্য কারিগর অধ্যাপক জাকির হোসেন

যাদের মহৎ চিন্তার বাস্তবায়নে সমাজের উন্নয়ন হচ্ছে, মানুষের চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসছে, যাদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হচ্ছে সমাজ। যাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সততা এবং কর্ম মানুষকে সত্যিকারের মানুষ হতে অনুপ্রাণিত করছে, তারাই আলোকিত মানুষ। এমনই একজন অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন। তিনি দেশের একজন বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কল্যাণে কাজ করে যাওয়া একজন সাধক। তার সাধনা ও জীবনব্রত চিকিৎসাসেবা ও শিক্ষকতা। স্বসমাজ-স্বজাতি-স্বদেশের মানুষের মানসম্মত চিকিৎসাসেবা প্রদানই তার জীবনের একমাত্র ব্রত। তার সমাজসেবার মূলে রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ।
তিনি একজন অনন্য আদর্শবাদী, সদাচার, ধর্মপ্রাণ ও উদারনৈতিক সমাজসেবী। তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান, একটি চিকিৎসা আন্দোলনের নাম। তার জীবনবোধ সুপ্রসিদ্ধ লেখক রাসকিনের বাণীর মতোই duty towards God, duty towards parents and duty towards mankind—এর অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। তিনি বগুড়া ও রংপুরে কতগুলো সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা এবং অন্যতম পৃষ্ঠপোষক।
অধ্যাপক ডা. জাকির সুদীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে অসংখ্য রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপ রোগীর নানান সমস্যা অবলোকন করে এসেছেন, যা বাংলাদেশে গড়ে এক-চতুর্থাংশ মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ রোগটি রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসারকে ‘নীরব ঘাতক ব্যাধি’ হিসেবে অভিহিত।
এর ঝুঁকি সম্পর্কে না জানা কিংবা সচেতনতার অভাবে অধিকাংশ মানুষ রোগটির চিকিৎসায় উদ্যোগী হয় না কিংবা চিকিৎসা নেওয়া বন্ধ করে দেয়। রক্তচাপ স্বাভাবিক না থাকলে আমাদের নানা রকম ক্ষতি হতে থাকে। ফলে আমরা আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকসহ বিভিন্ন গুরুতর রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকি। এমনকি এই রোগের জটিলতায় বরণ করে নিতে হতে পারে পঙ্গুত্ব অথবা অকাল মৃত্যু।
স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ যেমন প্রতিরোধ করা সম্ভব, তেমনি যথাযথ চিকিৎসা নিয়ে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে মাধ্যমে এই ঝুঁকিগুলোও অনেকাংশে কমানো সম্ভব। এদেশে এই রোগের চিকিৎসা দেওয়ার মতো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড়ই অভাব। অধ্যাপক ডা. জাকির এই মারাত্মক ব্যাধির সমস্যায় সর্ব প্রথম এগিয়ে এসেছেন। তিনি ২০০৮ সালের ১৪ নভেম্বর উচ্চ রক্তচাপ রোগী ও জনগণকে সচেতনতা করতে রংপুরে হাইপারটেনশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
এ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে তিনি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীদের গ্রামে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি শনাক্ত করছেন এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এর ফলে স্টোক, অন্ধত্ব, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইল্যুরের মতো নানাবিধ জটিলতা থেকে অসংখ্য রোগী বেঁচে যাচ্ছেন। যাদের উচ্চ রক্তচাপ অথবা ডায়াবেটিস আছে তারা মাত্র ৫০ (পঞ্চাশ) টাকার বিনিময়ে রেজিস্ট্রেশন করে এই প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা পরামর্শ নিতে পারেন এবং পরবর্তীতে আজীবন ৪০ (চল্লিশ) টাকা প্রদান করে ফলোআপ করতে পারেন। প্রতিষ্ঠানটিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা, অসহায় দুঃস্থ ও প্রতিবন্ধী রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা পরামর্শ প্রদান করা হয়।
আমরা মনে করি, অধ্যাপক ডা. জাকিরের জীবনে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা এক বিরাট মহৎ কাজ। তিনি এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে অদ্যবধি বিনামূল্যে এই প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধিত রোগীদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করে আসছেন। এ পর্যন্ত তিনি নিজে এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৩০ হাজার রোগী দেখেছেন এবং অদ্যবধি দেখে যাচ্ছেন। গত ১২ নভেম্বর পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানে থেকে প্রায় ৪৫ হাজার নিবন্ধিত রোগী নিয়মিত চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেছেন।
হাইপারটেনশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারটিতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ও টেকনিশিয়ন রয়েছেন। এখানে স্বল্পমূল্যে এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিনামূল্যে সকল রকম ল্যাব ইনভেস্টিগেশন হয়। প্রতিষ্ঠানটি রংপুরে হলেও সারাদেশের মানুষকে সেবা দিচ্ছে। বিশেষ করে রংপুরের বাইরে বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাও, দিনাজপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় সচেতনতমূলক সেমিনার, উঠান বৈঠক, মেডিকেল ক্যাম্প, এনসিডি ক্যাম্প করে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস সম্পর্কে জনসচেতনতা করছে।
ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলায় হাইপারটেনশন এ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিনামূল্যে ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস ও বিএমআই নির্ণয় করে হাজার হাজার মানুষকে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস শনাক্ত এবং শনাক্তকৃত রোগীদের রোগ সম্পর্কে কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে কমিউনিটি লেভেলে বিনামূল্যে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা প্রদান কার্যক্রম সুনিপুণভাবে সম্পাদন করা হয়। উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে, ডাটা সংরক্ষণ, রিসার্চ মেথডোলজিসহ কয়েকটি একাডেমিক প্রশিক্ষণ কোর্স ও গবেষণায় এটিই বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন তার সময় ও অর্থের অনেকটাই ব্যয় করেন সমাজসেবায়। তিনি মানুষের কল্যাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ৭টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি নানান কল্যাণমুখী সামাজিক কাজকর্ম ছড়িয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষানুরাগী অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেনের পিতা মরহুম ডা. ওয়াছিম উদ্দিন আহমেদ নিজ এলাকায় বগুড়ার ধুনটের গোঁসাইবাড়িতে নারী শিক্ষার অগ্রায়ণে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জমি ও নগদ অর্থ দান করেন। এই অর্থে গোসাঁইবাড়ীতে করিম বকস ওয়াসিম উদ্দিন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এই স্কুলটি আশির দশকের প্রারম্ভে এমপিওভুক্ত হয়। পরবর্তীতে অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বিদ্যালয়টির কাঠামোগত উন্নয়ন ঘটে। এ প্রতিষ্ঠানে পিছিয়েপড়া ও সুবিধাবঞ্চিত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঝড়েপড়া ঠেকাতে তাদের নিয়মিত পাঠ সামগ্রী ও নগদ অর্থ বিতরণ করে আসছেন তিনি।
অধ্যাপক ডা. জাকির গোসাইবাড়ী আমির উদ্দিন আয়েজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ে কৃতী শিক্ষার্থীদেরকে ২০০৫ সাল থেকে অর্থবৃত্তি প্রদান করছেন। তার নেতৃত্বে রংপুর ও বগুড়া অঞ্চলে গড়ে ওঠেছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্য পরিচর্যায় দুটি প্রতিষ্ঠানসহ একটি সমৃদ্ধ গণগ্রন্থাগার। তার স্বোপার্জিত অর্থে প্রতিষ্ঠিত ৭টি প্রতিষ্ঠানে প্রায় শতাধিক দক্ষ কর্মী কর্মরত।
অধ্যাপক ডা. জাকির বয়স্ক, বিধবা, অস্বচ্ছল আত্মীয়-স্বজনদের দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত হারে মাসিক ভাতা প্রদানসহ দুর্যোগ দুর্বিপাকে এলাকার মানুষের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। মসজিদ, ইদগাহ মাঠ, কবরস্থান ও গুচ্ছগ্রামসহ নিজ গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণে জমিসহ আর্থিক সহায়তা করছেন তিনি।
বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যক্ষসহ বিভিন্ন সরকারি মেডিকেল কলেজে পেশাগত জীবন অতিবাহিত করেন। বর্তমানে বগুড়ার টিএমএসএস মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বিসিএস ক্যাডার অফিসারদের স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণের প্রশিক্ষক এবং মেডিকেল সম্পর্কিত উচ্চতর ডিগ্রির অন্যতম শিক্ষক ও পরীক্ষক। দেশের অসংখ্য চিকিৎসক তার ছাত্র। অধ্যাপক ডা. জাকির ১৯৮৫ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে সেখানেই চিকিৎসক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স (বিসিপিএস) থেকে মেডিসিনে এফসিপিএস এবং ১৯৯৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত তদানীন্তন আইপিজিএম অ্যান্ড আর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে ইন্টারনাল মেডিসিনের ওপর এমডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
২০০৫ সালে আমেরিকান কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স থেকে এফএসিপি এবং ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের দ্য রয়েল কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অব এডিনবার্গ থেকে এফআরসিপি ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টির বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সেমিনারে উপস্থাপন করেছেন তিনি। বিভিন্ন মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তার ৪৫টির বেশি প্রবন্ধ। দেশের পত্রপত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে স্বাস্থ্যসমস্যা ও সচেতনতা নিয়ে সাক্ষাৎকার ও আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করছেন এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ রোগী ও ছাত্র-চিকিৎসকদের উন্নয়নে গ্রন্থ লিখেছেন ও প্রকাশ করেছেন তিনি।
অধ্যাপক ডা. জাকির উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সুদীর্ঘ চিকিৎসক কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে এ বিষয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম ‘রক্তচাপ ও উচ্চ রক্তচাপ’ (ফেব্রুয়ারি ২০২৪) নামে তিনি একটি বই লিখেছেন। এই বইটি উচ্চ রক্তচাপ বিষয়ে সাধারণ পাঠক ও রোগীদের বোধগম্য ভাষায় লেখা। এ বইটি উচ্চ রক্তচাপের রোগী ও তাঁদের স্বজন, সাধারণ মানুষসহ চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী ও চিকিৎসকদের অশেষ উপকারে আসছে।
অধ্যাপক ডা. জাকির কর্মের স্বীকৃতি হিসিবে বাংলা একাডেমি সাম্মানিক ফেলোশিপ ২০২২, প্রফেসর এসজিএম চৌধুরী মেমোরিয়াল অরেশনস গোল্ড মেডেল ২০২৩, আউটস্ট্যান্ডিং কন্ট্রিবিউশন ইন কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ সম্মাননা ২০২৩ প্রভৃতি পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন।
প্রখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. মো. জাকির হোসেন ১৯৬১ সালে বগুড়া জেলার ধুনট থানার শিমুলবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একপুত্র ও এক কন্যার জনক। পিতার পথ অনুসরণে কন্যা ডা. পারিসা বিনতে জাকির, এফসিপিএস (পার্ট-১ উত্তীর্ণ) ও ছেলে জুনায়েদ বিন জাকির এমবিবিএস ফাইনাল বর্ষে অধ্যয়নরত। ডা. জাকির হোসেনের স্ত্রী নাসরিন নাহার রউফ একজন গৃহিণী।
এমইউ/
