বৈকালিক স্বাস্থ্যসেবা সরকারি হাসপাতালে যেসব জটিলতা তৈরি করবে
দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনার পর গত ৩০ মার্চ নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে ইনিস্টিটিউশনাল বা বৈকালিক প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম পরীক্ষামূলক উদ্বোধন করেছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এর মধ্য দিয়ে ‘সরকারি হাসপাতালে বেসরকারি বাণিজ্যিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হলো!’
নাগরিকদের চিকিৎসা পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সরকারি হাসপাতালগুলোতে যতটুকু পাওয়ার সুযোগ ছিল তাও বিপর্যস্ত হওয়ার পথে–এ সিদ্ধান্তে চিকিৎসক ও সাধারণ রোগীদের বহুবিধ সংকট সৃষ্টি হবে। ব্রিটিশ উপনিবেশের হাত ধরে বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা যখন থেকে ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করেছে, তখন থেকে চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালু হয়েছে। কিন্তু কখনও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত হাসপাতালে সরকারি চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অনুমোদন ছিল না। কেউ করার চেষ্টা করলে, সেটি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হতো। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেই দীর্ঘদিনের লালিত অপরাধকে বৈধতা দিল সরকারি হাসপাতালের বারান্দায়।
চিকিৎসকরা মূলত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। মাসিক বেতনের ভিত্তিতে তারা রাষ্ট্রের পক্ষে নাগরিকদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রীয় প্রটোকলের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে মন্ত্রীর কল্পনাপ্রসূত এরূপ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে যে সকল দ্বান্দ্বিক অসঙ্গতি দেখা দিতে পারে-
১. চিকিৎসকদের বৈকালিক অবসরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রাইভেটাইজেশন হওয়া এক কথা নয়।
২. চিকিৎসকরা আন্তর্জাতিক শ্রম আইন দ্বারা নির্ধারিত সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা শ্রম ও মেধা দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করেন। দিনের অন্য সময় তারা বিশ্রাম, বিনোদন ও পারিবারিক কাজে সময় ব্যয় করেন। এ ছাড়া শুক্রবারে সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করেন। মন্ত্রীর এ আদেশে চিকিৎসকের সে অধিকার খর্ব করা হলো।
৩. হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বাইরে যেকোনো দিন তাদেরকে (চিকিৎসকদের) ছুটে যেতে হয়। এ সিদ্ধান্তের ফলে উল্লিখিত নিয়ম-রীতি বিপর্যস্ত হবে।
৪. বিশ্রাম, বিনোদন ও পরিবারের সদস্যদের সময় না দিয়ে অতিরিক্ত অর্থের প্রয়োজনে কিছু চিকিৎসক প্রাইভেট চেম্বারে প্র্যাকটিস করে। এটি তার একান্তই ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ওই এলাকার জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা। প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেও পারেন, নাও পারেন। (বেসিক সাইন্সের অনেক চিকিৎসক প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না)। মন্ত্রীর আদেশ চিকিৎসকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করলো। এ অধিকার মন্ত্রীর নেই।
৫. স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বৈকালিক প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হওয়ায় হাসপাতালের চেম্বার প্রাইভেট চেম্বারে রূপান্তরিত হলো! সেখানে রোগী ফি দিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ ও অপারেশন করাতে পারবেন। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতাল বিকাল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত হয়ে গেল প্রাইভেট বা বাণিজ্যিক হাসপাতাল! যে কোনো ধরনের বাণিজ্যিকতা রাষ্ট্রায়ত্ত হাসপাতালের দায়বদ্ধতা ক্ষুণ্ণ করবে।
৬. চিকিৎসকের নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টার পরে কেবলমাত্র রোগীর জরুরি অবস্থাকালীন তাকে ডেকে পাঠানো ছাড়া কোনো প্রকার বাধ্য করার এখতিয়ার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আছে কি? এ আদেশে সংবিধানের কোন ধারা বা বিধিবিধানের উল্লেখ নেই। মন্ত্রীর একান্ত মনগড়া আদেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চলবে?
৭. স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ আদেশ প্রত্যক্ষভাবে আইএলও কনভেনশনের লঙ্ঘন বা অস্বীকৃতি। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম আদালত কখনও এই সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না। এ আদেশের বিরুদ্ধে চিকিৎসকরা আন্তর্জাতিক শ্রম আদালতে অভিযোগ দাখিল করলে বাতিল হয়ে যাবে।
৮. মেডিকেল কলেজের সহকারী , সহযোগী ও অধ্যাপকদের দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর কত কাজ করাতে চান? কলেজের ছাত্র পড়ানো ও তাদের পরীক্ষা নেওয়া, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বহির্বিভাগে রোগী দেখা, ভর্তি রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া, নিয়মিত অপারেশন করা এবং জরুরি যে কোনো চিকিৎসা বা অপারেশনে হাসপাতালে ছুটে আসা, অন্য মেডিকেল কলেজের পরীক্ষা নিতে যাওয়া। এরপরে আবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর খায়েশ চাপলো ‘বৈকালিক চিকিৎসা কেন্দ্র সরকারি হাসপাতালে’ সপ্তাহে ২ দিন (৩টা হতে ৬টা) রোগী দেখতে হবে। এতগুলো কাজের জন্য অধ্যাপকরা সময় পাবেন কোথায়, তাদের কি ব্যক্তিজীবন থাকবে না? স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি তাদের পুরোই গোলামীর জিঞ্জিরে আবদ্ধ করতে চান?
৯. রাষ্ট্রের দেওয়া বেতনের বাইরে যে অধ্যাপক মুদ্রাস্ফীতির চাপে জর্জরিত, সেটা সামাল দিতে ব্যক্তি জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে বিকাল হতে গভীর রাত পর্যন্ত প্রাইভেট প্রাকটিস করেন। সে পথে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কাঁটা বিছিয়ে দিলেন।
১০. হাসপাতালে বিদ্যমান ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ, অবকাঠামো , জনবল , প্রযুক্তি ও উপকরণের তীব্র অভাব। এ অবস্থায় বৈকালিক রোগী দেখা কার্যক্রম কিভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী সুস্থ রাখবেন?
১১. মাত্র ৩০০ টাকায় হাসপাতালে যেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মত নিতে পারবে, সে রোগী কেন দ্বিগুণ, তিনগুণ টাকায় প্রাইভেট পরামর্শ নিতে রাজি হবেন? তখন হাসপাতালের এ সকল বাণিজ্যিক চেম্বারে প্রচণ্ড ভিড় হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক যখন অধিক সময়ে অধিক রোগী দেখতে অপারগ হবেন, তখনই শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি সে ‘মাইর’ ঠেকাতে আসবেন? হাসপাতাল ভাঙচুর ও স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট হবে। নৈমিত্তিক এ ঘটনায় হাসপাতালের ভর্তি থাকা সাধারণ রোগীরা আতঙ্কে থাকবেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী তাদেরকে কি দিয়ে আশ্বস্ত করবেন?
১২. রোগীদের রোগ নিরীক্ষার ব্যবস্থা সরকারি হাসপাতালে একেবারেই অপ্রতুল, টেকনোলজিস্ট, প্রযুক্তি ও জনবল নেই বললেই চলে। তারপর বৈকালিক বাণিজ্যিক প্রাইভেট রোগীদের রোগ নিরীক্ষার ব্যবস্থা কীভাবে হবে? স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মস্তিষ্কে এ ভাবনা আছে কি? বাংলাদেশের সবপ্রান্তের হাসপাতাল মন্ত্রীর আশীর্বাদপুষ্ট মানিকগঞ্জের হাসপাতাল নয় যে, হাত বাড়ালেই সব মিলবে।
১৩. সরকারি হাসপাতালে বৈকালিক প্রাইভেট প্রাকটিসের উল্লিখিত অব্যবস্থাপনার ফলে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালেরা হাসপাতালের বারান্দায় অবস্থান নেবে, রোগী ধরে টানাটানি শুরু করবে। এ ছাড়াও ওষুধ কোম্পানির লোকেরা চিকিৎসকদের ভিজিট করার জন্য হাসপাতালের একই জায়গায় ভিড় করবে, হাসপাতালের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। ভিডিও ক্লিপে দেখলে মনে হবে মাছের বাজার-সে দৃশ্য দেখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী কি লজ্জা পাবেন?
১৪. ৩০০টাকা ফি দেওয়া রোগীর স্বজনদের দাপটে হাসপাতালের পরিবেশ হবে থরকম্প। সকালে ১০ টাকা টিকেটের বিনিময়ে নাগরিকরা যে চিকিৎসা প্রত্যাশা করবে, বৈকালিক ১৫০-৪০০ টাকার বিনিময়ে একই হাসপাতালে, একই ব্যবস্থাপনা, একই জনবল–পার্থক্য কেবল সময়ের সকাল ও বিকাল। দুই সময়ে দুই ধরনের রোগীদের সাথে একই হাসপাতাল ভিন্নভিন্ন আচরণ করবে কিভাবে? তখনই বঞ্চিতরা ক্ষুব্ধ হয়ে মাইর ও ভাঙচুর শুরু করবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে তখন কোথায় পাওয়া যাবে?
১৫. মেডিকেল গ্রাজুয়েটরা জেনারেল প্র্যাকটিস (জিপি) করে যে ফি’র বিনিময়ে রোগী দেখত, সেই সমপরিমাণ বা তারচেয়ে কম টাকা দিয়ে বিকালে হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে পারবে–এ কারণে জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের প্র্যাকটিস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হবে, যা চিকিৎসক বেকারত্বকে আরও প্রকট করে তুলবে।
১৬. রাষ্ট্র যেহেতু সকল চিকিৎসককে নিয়োগ দিতে পারছে না, তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না। জেনারেল প্র্যাকটিস করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ বিলাসী সিদ্ধান্তে তাদের আয়ের একমাত্র পথও বন্ধ হয়ে যাবে। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার এ সব বিলাসী সিদ্ধান্তে না গিয়ে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত জেনারেল প্র্যাকটিস বা জিপি চালু করলে চিকিৎসক বেকারত্ব একেবারেই দূর হতো। প্রান্তিকের সাধারণ মানুষ মানসম্মত চিকিৎসা পেতো।
এ ঘোষণার পূর্বাহ্ণে রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অভিভাবক স্বাস্থ্যমন্ত্রী উল্লিখিত সংকটের বিষয়ে কোন কিছু না ভেবেই, মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকদের সাথে কোন পরামর্শ না করে, আমলাদের একচ্ছত্র পরামর্শ ও প্ররোচনায় এরূপ কল্পিত ও অবাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
সরকারি হাসপাতালে প্রাইভেট চেম্বার না করে সারা বাংলাদেশে জিপিদের জন্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রাইভেট চেম্বার খুলে দিলে, রোগীরা মানস্মত চিকিৎসা পেত ও চিকিৎসক বেকারত্ব দূর হতো। এরপরেও কি চিকিৎসকরা চুপ করে থাকবেন? চিকিৎসকদের কথা বলা ও প্রতিবাদ করা প্রয়োজন।
এএইচ/এমইউ
-
৩১ মার্চ, ২০২৩
-
৩০ মার্চ, ২০২৩
-
৩০ মার্চ, ২০২৩
-
২৯ মার্চ, ২০২৩
-
২৭ মার্চ, ২০২৩
-
২৭ মার্চ, ২০২৩