২২ অগাস্ট, ২০২২ ০৯:৪৬ এএম

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে শিগগিরই নীতিমালা

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধে শিগগিরই নীতিমালা
নীতিমালার আওতায় প্রত্যেক হাসপাতালে নিজস্ব অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি তৈরির নির্দেশনা দেবে স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তর।

মো. মনির উদ্দিন: অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে শিগগিরই নীতিমালা করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তর। এর আওতায় প্রত্যেকটি হাসপাতালে নিজস্ব অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হবে। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাসপাতালসহ বড় বড় হাসপাতালে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের বিভিন্ন মাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে প্যানেল সুপারিশ (অভিজ্ঞ চিকিৎসক দল) ছাড়া রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিকগুলো কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না।

এর প্রাথমিক কাজগুলো পর্যায়ক্রমে এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বাস্তবায়নাধীন পুরো বিষয়টি স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তর পর্যবেক্ষণ করবে। এর কাঙিক্ষত সাফল্যের ধারাবাহিকতায় পর্যায়ক্রমে চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন মূল্যায়নেরও উদ্যোগ নেবে অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর মেডিভয়েসকে একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানিয়েছেন। 

মাসব্যাপী কর্মশালা শুরু

কার্যক্রম এগিয়ে নিতে গত ১৭ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরনো ভবনে শুরু হয়েছে এ সংক্রান্ত একটি কর্মশালা। মাসব্যাপী এ কর্মশালায় দেশের সকল বড় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎকসা এসেছেন। প্রাথমিকভাবে ঢাকা মেডিকেল, স্যার সলিমুল্লাহ, সোহরাওয়ার্দী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও রাজশাহীসহ সব মেডিকেলের মেডিসিনের অধ্যাপকবৃন্দকে নিয়ে আসা হয়েছে। পরবর্তীতে সার্জারি, গাইনি ও পেডিয়াট্রিক্সের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের আনা হবে। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য স্পেশালিটির সবাইকে নিয়ে আসা হবে। এ কার্যক্রমে দেশের সকল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের অপকারিতা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও এর সাবধানী প্রয়োগের বিষয়ে উৎসাহিত করা হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রত্যাশা, বিলম্বে হলেও কাজগুলো শুরু হয়েছে। এগুলো শেষ করতে পারলে এ সংক্রান্ত সমস্যাগুলো দূর হবে।

সব স্তরের অংশীজনদের সঙ্গে শিগগিরই বৈঠক

অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) নেতৃত্বে বিষয়টি এগিয়ে যাবে। তাদেরকে একটি মিটিং করতে বলেছি, যেখানে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সম্মতি আছে। আমরা শিগগিরই সব স্তরের অংশীজন অর্থাৎ নিয়ন্ত্রক এবং বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করবো। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি), বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল, ঔষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, চিকিৎসকদের বিভিন্ন সোসাইটি ও কমিউনিটির নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে মিটিংটি হবে।’

অ্যান্টিবায়োটিক নীতিমালা প্রণয়ন

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রথম কাজ হলো, নীতিমালা প্রণয়ন (পলিসি মেক) করা। এর আলোকে কোন উপজেলায় কতটুকু অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যাবে, সদর হাসপাতালে কতটুকু হবে—এগুলো ঠিক করা হয়েছে। একই সঙ্গে রিজার্ভ অ্যান্টিবায়োটিক, যা কোনোভাবেই ব্যবহার করা যাবে না—যতক্ষণ না একটি প্যানেল সুপারিশ করে। এটা ঠিক করা হবে।

স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, এ নীতিমালার আওতায় প্রত্যেকটি হাসপাতালে নিজস্ব অ্যান্টিবায়োটিক পলিসি তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হবে। এটি এজন্য হবে, কারণ ঢাকার একটি বড় হাসপাতালের ল্যাবরেটরি সুযোগ-সুবিধা অনেক ভালো, তার পক্ষে এভিডেন্স ভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে ইনভেস্টিগেশনের পর্যাপ্ত সুবিধা নেই, সেখানকার চিকিৎসককে তো অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই চিকিৎসা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি কতটুকু লিখতে পারবেন কিংবা রিজার্ভ ড্রাগটা যেন শুরুতেই না লিখেন, সেজন্য তার স্থানীয় জনশক্তি দিয়ে এ বিষয়ে একটি পলিসি তৈরি করে নিবেন। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

পর্যায়ক্রমে প্রেসক্রিপশন মূল্যায়ন শুরু

তিনি আরও বলেন, ‘এটা নিশ্চিত করা গেলেও নন-রেজিস্ট্রার্ড, নন-ডক্টর প্রচুর লোক, হাজার হাজার বৈধ-অবৈধ ফার্মেসির ওষুধ বিক্রেতা, সবাইকে নিয়ন্ত্রণ কিংবা নলেজ আপডেটের আওতায় আনা সম্ভব না। এ অবস্থায় এই ব্যাপক জনগোষ্ঠী, যারা অবৈধভাবে ওষুধ লিখছে এবং তাদের ব্যাপারে আমরা ডিজিডিএকে শক্তভাবে নির্দেশ দিবো, উনাদের জনবল বাড়ানো বা অন্যান্য সহায়ক শক্তি বাড়িয়ে হলেও এসব বন্ধ করবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তারা আমাদের সহযোগিতা নেবে। এর মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের অপপ্রয়োগ অন্তত বন্ধ হবে। সেটা সমান্তরালভাবে করার মাধ্যমে একটি আদর্শ স্বাস্থ্য পরিবেশ তৈরি হবে। এর পর দেখা হবে, আমরা যেসব প্রেসক্রিপশন করছি, তা এই রুল অনুযায়ী হচ্ছে কিনা; অর্থাৎ প্রেসক্রিপশন মূল্যায়ন, যা এই মুহূর্তেই সম্ভব না। কারণ সেটা যাচাইয়ের জন্য আমাদের কিছু সূচক-নির্দেশ থাকতে হবে। বাস্তবায়নকারী সূচক-নির্দেশকই হবে প্রেসক্রিপশন অডিট। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধসহ সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে এটা করা হবে। আদর্শ পরিবেশ তৈরি না করে এটা শুরু করলে কখনোই কার্যকর কিছু হবে না।’

আসছে শক্ত আইন

নন-রেজিস্ট্রার্ড, নন-ডক্টরদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার বন্ধে কীভাবে পদক্ষেপ নেবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একটি সমস্যায় আমরা ভুগছি। তাহলো: যে কোনো কাজ করতে গেলেই আইন নিয়ে আমাদের অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়। বিদ্যমান প্রাইভেট ক্লিনিক অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ এর, তার পর আর আপডেট হয়নি। এ নিয়ে মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি জানিয়েছেন, এইগুলো নিয়ে সংসদে আলোচনা করে এমন একটি শক্ত আইন করা হবে, যাতে আমাদের এই কার্যক্রমকে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারেন। আর বিদ্যমান আইন অনুযায়ীই নন-ডক্টর কেউ অ্যান্টিবায়োটিক লিখতে পারবেন না। আইনের বাস্তবায়ন খুব জরুরি। সেজন্য সমন্বিত মিটিংটি করছি, যার মাধ্যমে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।’

রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসক ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার নয়

অধ্যাপক আহমেদুল কবীর বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এখন স্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সমস্যা। আমাদের একটি সমস্যা হলো, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের যে গাইড লাইন, যেমন: কে কতটুকু লিখতে পারবেন, কোনটা রিজার্ভ ড্রাগ—এই বিষয়গুলো ঠিক করা যায়নি। আমাদের প্রেসক্রাইবার অনেক। এর মধ্যে রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তার প্রেসক্রাইব করছেন, অন্যরাও করছেন। আমাদের নীতি নির্ধারণ করতে হবে যে, রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তার ছাড়া কেউ অ্যান্টিবায়োটিক লিখতে পারবেন না। যার অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে, কেবল তিনি লিখতে পারবেন। সুতরাং অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার বিষয়ে নীতি নির্ধারণ করা হবে প্রথম বড় ধরনের ধাক্কা।

অ্যান্টিবায়োটিকের নির্ভুল প্রয়োগ নিশ্চিতের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, ‘আমি যে কাজটা করছি, সেই সম্পর্কে আমার পুরোপুরি ধারণা থাকলে কাজটি যথাযথভাবে করতে পারবো, যৌক্তিকভাবে করতে পারবো। ফায়ার আর্মসের উপকারের পাশাপাশি অপকার আছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ফায়ার আর্মস থাকলে, যেখানে প্রয়োজন, সে সেখানেই এটি প্রয়োগ করবেন। একজন উন্মাদের কাছে ফায়ার আর্মস থাকলে বিনা কারণে নির্দোষ মানুষ মেরে ফেলবে।’

তিনি বলেন, একইভাবে অ্যান্টিবায়োটিকও একটি ফায়ার আর্মসের মতো। এটা যাকে আমি দিচ্ছি, সেই মানুষের ক্ষতি হতে পারে, আবার উপযুক্ত স্থানে প্রয়োগ করতে পারলে এর দ্বারা উপকারও হতে পারে। আমার যদিও লক্ষ্য অর্গানিজমকে হত্যা করা। কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া যেই মানুষটাকে আমি দিচ্ছি, তার বড় ক্ষতি করতে পারে। এমনকি জীবনও হুমকির মুখে পড়তে পারে। সুতরাং এই ধরনের একটি অস্ত্র প্রয়োগের আগে, সে সম্পর্কে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।’

প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি নিষিদ্ধ

তিনি বলেন, ‘এটা একেবারেই কমন একটি ব্যাপার যে, অ্যান্টিবায়োটিক বিষয়ে যথেষ্ট নলেজেবল পারসন এটা ব্যবহার করতে পারবেন। ঠিক অস্ত্রের লাইসেন্সের মতো। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ বা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের জন্য লাইসেন্স প্রদানের আগে তাঁর সে জ্ঞান থাকতে হবে। বিষয়টি খুবই পরিষ্কার যে, শুধুমাত্র রেজিস্ট্রার্ড ফিজিশিয়ান্স অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব ব্যবহার করতে পারবেন, যারা এ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। এটা প্রথম কাজ। দ্বিতীয়ত রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ফার্মেসিগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করা যাবে না। এ বিষয়টি যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যার দায়িত্বে রয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।’ 

অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে প্রাথমিক কাজগুলো নিয়ে স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তর পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও জানান অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর।

চিকিৎসকদের রিফ্রেশার নলেজ প্রদানের উদ্যোগ

স্বাস্থ্য সেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকদের রিফ্রেশার নলেজ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করছি। এখানে কেউ একবার স্পেশালিস্ট হয়ে গেলে পড়াশোনা করা কিংবা নতুন করে রেজিস্ট্রেশন নবায়ন পরীক্ষা দিতে হয় না, এ ব্যবস্থা নেই। এটা সত্য যে, ব্যক্তিগতভাবে আমরা সবাই আপডেটেড হই। আন্তর্জাতিক নানা জার্নাল ও পাবলিকেশন থেকে পড়াশোনার মাধ্যমে জ্ঞানার্জনের ধারা অব্যাহত রাখি। কিন্তু ইউনিফর্ম এডুকেশন নেই। এজন্য সিডিসিকে বলা হয়েছে, আমাদের একটি সফটওয়্যার থাকবে, যার মাধ্যমে একজন চিকিৎসক নিজেকে প্রশিক্ষিত করতে পারবেন। সেখানে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিক, এর প্রয়োগ এবং প্রতি মুহূর্তে রিফ্রেশার নলেজ, আপডেটেড ধারণা দেওয়া থাকবে। এর মাধ্যমে প্রেসক্রাইবারদের নিজেদেরকে আপডেট করে নিতে হবে। তিনি নিজে নিজেই পরীক্ষা দেবেন। একটি নির্দিষ্ট স্কোর তাঁকে অর্জন করতে হবে। এটা অর্জন করে অনলাইনে আমাদেরকে ও তার ইনস্টিটিউট হেডকে অবহিত করবেন, যার ফলে তার একটা আপডেট হওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে যাচ্ছে। রেজিস্ট্রার চিকিৎসক ও ফিজিশিয়ান্সদের আমরা এর আওতায় নিয়ে আসতে পারবো।’ 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : অ্যান্টিবায়োটিক
‘ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ অনুসন্ধান করুন’

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের গালমন্দ নয়: প্রধানমন্ত্রী

‘ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ অনুসন্ধান করুন’

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের গালমন্দ নয়: প্রধানমন্ত্রী

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত