ডা. ইমরান হোসেন

ডা. ইমরান হোসেন

সাবেক শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ


২১ মে, ২০২২ ১১:৪১ এএম

ইন্টার্নশিপের গল্পকথা

ইন্টার্নশিপের গল্পকথা
এই দীর্ঘ সময়ে আমি আমার ওয়ালে এই মেডিকেলের কারো সাথেই কোনো ছবি দেইনি, সবাই আমার মনের গহীনে আছে, খুব যতনে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমার অফিসিয়ালি এক বছর পূর্ণ হয়েছে ২৮ এপ্রিল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছিলাম ১০-১১ সেশনে। পাস করেছি ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। রেজাল্ট হয়েছিল একই বছরের ২০শে ডিসেম্বর। আমার সহধর্মিণী যেহেতু ৩৭তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে পোস্টেড হয়েছিল তাই বাধ্যতামূলকভাবেই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্টার্নশিপের জন্য আবেদন করি। সেই আবেদন তিনবার রিজেক্টেড হয়ে চতুর্থবারের মাথায় মার্চ ২১ সালে জয়েন করি।

নিজের মেডিকেল কলেজের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার দরুন নতুন জায়গা সমন্ধে মানসিক দোটানায় ভুগে ৩১শে মার্চ জয়েনিং সম্পন্ন হয়। নিঃসন্দেহে, এটা মেডিকেল জীবনের আমার সবচেয়ে দ্রুততম বছর। শুরু করেছিলাম, গাইনি দিয়ে। কপালগুণে পেয়েছিলাম এমন কিছু কলিগ, যাদেরকে আমার কাছে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত ফেরেশতা মনে হয়।

শুরুতেই বলবো আমার ইন্টার্নমেটদের কথা। প্রথম যে ছেলেটির সাথে পরিচয় হয়েছিল, মোহাইমিন নামের এই ছেলে কোর্স কারিকুলামে আমার চার ব্যাচ জুনিয়র। ওর সাথেই আমার বেশিরভাগ গাইনি ডিউটি কেটেছে। মোহাইমিনের একটি কথাই আমার ইন্টারনশিপের পুরো মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, ‘ভাই বসে থাকলে পুরো একটি বছরই আপনি বসে থাকতে পারবেন কিন্তু কিছুই শিখতে পারবেন না।’ আমি আর বসিনি। দৌঁড়ের উপর ছিলাম পুরো একটি বছর। গৌরীপুর টু ময়মনসিংহ পাক্কা ২৫ কিমি রাস্তা। প্রতিদিন ৫০ কিমি জার্নি করে আবার তারপরের দিনের প্রিপারেশন নিয়েছি।

পরিশেষে, পেয়েছি উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্য, আমার সিএ কান্তা আপু তাঁর স্বামী ডা. পুনম ভাইকে এক অনুষ্ঠানে আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এই যে, দ্যাখো আমার ভাই ডা. ইমরানও ৯ নম্বর রুমে থাকলে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকতাম।’ বলে রাখা ভালো ৯নং রুম গাইনি অ্যাডমিশন রুম। যে আমি স্যার ম্যাডামদের দেখলে কোনোদিন সামনে যেতাম না সেই আমি চেষ্টা করতাম রাউন্ডে মির্জা ম্যাডামের কাছাকাছি থাকার। আসলে পরিবেশ এবং সময় সবকিছু বদলে দেয়। গাইনির ঐ সময়ে কান্তা আপু, সুচিত্রা আপু, চৈতী আপু, ববি আপু আপনাদের ঋণ আমি এ জন্মে শোধ করতে পারবো না। মোহাইমিন, রিয়া, মম, শোভা, তৌহিদ, নোমান, উচ্ছ্বাস তোদের কোনোদিনও ভোলা সম্ভব নয়। এক সপ্তাহের ফ্যামিলি প্ল্যানিং ডিউটি করতে যেয়ে পরিচিত হওয়া বিলকিস ম্যাডাম আপনাকেই বা ভুলি কিভাবে? ম্যাডাম বলেছিলেন, ‘ইমরান তোমার যে প্যাশন আছে, তুমি গাইনিতেই ক্যারিয়ার করো বাবা।’ তখনও ভাবিনি এইসব উৎসাহের সবে তো শুরু।

শুরু করলাম মেডিসিন। আবারও নতুন ওয়ার্ড নতুন মুখ। গাইনির নোমান আমাকে একদিন পরিচয় করিয়ে দিলো মেডিসিনের সিএ সুমনদার সাথে। দাদা বললেন, ‘সময় মতো চলে এসো।’ যেয়ে পরিচয় হলো রেহান ভাইয়ের সাথে। তারপর কই দিয়ে সময় চলে গেলো, তা আমার আল্লাহ জানেন। প্রনবদা, প্রদীপদা, আনোয়ার ভাই, আসাদ ভাই, পলাশদা আপনারা কিভাবে এতো আপন করে নেন সবাইকে। শ্যামল স্যারের সাথে রাউন্ড মানেই ছিল জ্ঞানের সাগর পাড়ি দেওয়া। ইউনিট প্রধান খোরশেদ স্যারের সাথে আমার প্রথম দেখা ২০নং ওয়ার্ডের রাউন্ডে। স্যার ডেকে বললেন, ‘তোমার নাম কি?’ বলতেই বললেন, ‘তুমি তো খুব পরিশ্রমী। লেগে থাকো।’ আমি লেগেছিলাম। স্যার দ্বিতীয়দিন দেখা হতেই বললেন, ‘ইমরান এ দিকে আসো, বলো।’ আমি তো অবাক, স্যার আমার নামও মনে রেখেছেন! কিভাবে সম্ভব! সম্ভব যে বটে সেটা রেহান ভাইয়ের মেসেজ দেখে বিশ্বাস হয়েছিল যে মেসেজ আমি সেভ করে রেখেছি আমার মোবাইল ফোনে। যদি কখনো হতাশা আসে তবে মেসেজটি দেখি, ‘Special thanks to you. I have never seen such a doctor like you. I wish you will be a great doctor one day. Try your best and Allah will reward you.’ একে একে মেডিসিনের পেরিফেরি সব শেষ করলাম। যেটা করি সেটাই মজা লাগে। যা করি, তাই মজা লাগে। মেডিকেল সাইন্স এতো সুন্দর! আমি অবাক হয়ে যাই এবং অবাক হবে আমার নিজ মেডিকেলের সহপাঠী সবাই  যারা আমাকে নিশ্চিত অর্থেই অকর্মার ঢেঁকি বলে জানে।

এই দীর্ঘ সময়ে আমি আমার ওয়ালে এই মেডিকেলের কারো সাথেই কোনো ছবি দেইনি, সবাই আমার মনের গহীনে আছে, খুব যতনে। রেহান ভাইয়ের কাছে আমার মাকে দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম, আমার মা-বাবাকে ভাই বলছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না আপনার ছেলে অনেক বড় ডাক্তার হবে! জানেন, ওর কথা ওয়ার্ডে আমরা এই গতকালও গল্প করেছি।’ আমি জানি না আমি কি শিখেছি, শুধু জানি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আমাকে একবুক ভালোবাসা দিয়েছে, যার প্রতিদান কোনোদিন দেয়া সম্ভব নয়।

সার্জারিতে যাওয়ার পর পুরনো ইন্টারনমেটদের সাথে আমার ছিল মাত্র চারদিন। তারপর সম্পূর্ণ নতুন ব্যাচ আসলো। আমার মেডিকেল ব্যাচের মতোই ওদের ব্যাচ ফিফটি থ্রি। দুই-তিন যেতে না যেতেই বাচ্চাগুলোর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। নিশাত, আশিক, অক্সিন, অনিমা, মালিহা, লামিয়া, প্রান্তি, আনিকা, রতি, সুমনা আর শরীফ। ভালোবেসে ওরা বলতো আমাদের ভাই এসআই (সিনিয়র ইন্টার্ন)। একসময় এমন হলো যে, হাসপাতালে না গেলেই মনে হতো কি যেন নেই। শোয়েব ভাই, নাজমুল ভাই, তুহিন ভাই, তামান্নাপু, তুষার ভাই, মোর্সেল ভাই, আসলাম স্যার, বিপ্লব স্যার, সিরাজ স্যার আপনারা একেকজন লিজেন্ড। আপনাদের দেখে কেন যেন মনে হয়েছে আমাকে সার্জনই হতে হবে। যতবার তৌহিদ স্যারের সাথে ওটিতে দাঁড়িয়েছি আমার কেন যেন মনে হয়েছে আমাকেও এমন হতে হবে। ইউনিট প্রধান রেজা স্যার আপনার রাউন্ড মানে ভালোবাসা। এতো সুন্দর করে ফলোআপ নেওয়া পৃথিবীর অন্যকোনো চিকিৎসক দ্বারা সম্ভব নয়। আমি সার্জারি ইউনিট টুয়ের প্রেমে পরেছি। পরবো শতসহস্রবার।

সার্জারি পেরিফেরিতে ডিউটির অর্থোপেক্সির কথা না বললে লেখাটা অসম্পূর্ণ থাকবে। সাইফুল স্যারের রাউন্ডে স্যার বললেন, ‘তুমি কে?’ পরিচয় দিতেই বললেন, ‘ইন্টার্নরা তো রাউন্ডে আসে না। তুমি এসেছো, বাবা তোমাকে দেখে আমি ইন্সপায়ার্ড হচ্ছি।’ তারপর সারাক্ষণ স্যারের পাশেই রাখলেন। প্রশ্ন করলেন, যতটুকু পারলাম উত্তর দিলাম। রাউন্ড শেষে বললেন, ‘ইমরান তুমি অর্থোপেডিক্সেই ক্যারিয়ার করো। ভালো করবে।’ অর্থোপেডিক্সের সোহান ভাইকে আমার সত্যিকার অর্থেই আইকন মনে হয়। ভাই শেষের দিন বললেন, ‘ইমরান ফিল ফ্রী টু কাম অ্যানি টাইম।’

ইউরোলোজির মাহমুদ ভাইয়ের একটি কথা দিয়ে শেষ করছি, ‘ইমরান মিনিমাম এক মাস আমাদের সাথে থেকে যাও। তোমার মতো ইন্টার্ন একজন হলেই হয়, যে পাঁচজনের কাজ একা করে।’

এতোকিছু বলার কারণ একটাই, আপনার যে কোনো বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা যেকোনো দিন, যেকোনো সময় আসতে পারে। জানি না রিজিক আমায় আবার কোথায় নিয়ে যাবে, তবে মেডিকেল সাইন্সের যে, সৌন্দর্য আমি পেডিয়াট্রিক্সে দেখেছি তা বারবার পেতে চাইবো। ইভানা আপু, শাহীন ভাই, ডাবল মাহফুজ ভাই, সোহান ভাই, শাহজাহান ভাই আপনারা নিজেরাই একেকজন জীবন্ত শিশু যারা স্টেথোস্কোপ পরে পুরো শিশু ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ান। বিশ্বজিৎ স্যার ইউ আর অ্যা বিউটি অব পিডিয়াট্রিক্স।

মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে লাখো কোটি শুকরিয়া, আমাকে আমার ভালোবাসা পরিপূর্ণরূপে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। মাবুদ এ ভালোবাসা তুমি আরও বিকশিত করে দাও। হালাল রিজিকের ব্যবস্থা করে দাও।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
‘ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ অনুসন্ধান করুন’

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের গালমন্দ নয়: প্রধানমন্ত্রী

‘ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ অনুসন্ধান করুন’

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের গালমন্দ নয়: প্রধানমন্ত্রী

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত