মরণোত্তর অঙ্গদানে আইন প্রণয়ন জরুরি: অধ্যাপক এবিএম আব্দুল্লাহ
আবু নাঈম মনির: মরণোত্তর অঙ্গদানের ব্যবস্থা সহজতর করতে আইন করা জরুরি বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে ব্রেন-ডেড রোগীদের অঙ্গদান নিয়ে যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের কথা বলবেন।
রোববার (২৭ মার্চ) রাজধানীর সাতারকুলে ইউনাইটেড ক্লাব হাউসে আয়োজিত ‘মেকানিক্যাল হার্ট ইমপ্লান্টের সাফল্য ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলবো, একটি আইন করে দেন, যাতে ব্রেনডেড রোগীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানের ব্যবস্থা সহজ হয়। সফলভাবে কৃত্রিম হৃদপিন্ড ট্রান্সপ্ল্যান্টের পর এ ব্যাপারে আমার উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। সংসদে এ সংক্রান্ত আইন পাস হলে মানুষের মধ্যে প্রচার-প্রচারণা বাড়বে, সচেতনতা তৈরি হবে।’
‘তবে আইন হলেই হবে না, মানুষকে বোঝানোর ধারা অব্যাহত থাকতে হবে। একবারেই সব কিছু হয়ে যাবে না। সব কিছু সবাই জানেও না’, যোগ করেন এই ইউজিসি অধ্যাপক।
এ সময় ক্যাডাভারি ট্রান্সপ্ল্যান্টের অপরিহার্যতা তুলে ধরে তিনি বলেন, কোনো মানুষ যদি মৃত্যুর সময় তার বিভিন্ন অঙ্গ দান করেন যান, তাহলে ৬/৭ মানুষকে নবজীবন দান করা সম্ভব। দুটি কিডনি দুইজনকে দেওয়া যায়। হার্ট একজনকে দেওয়া যায়। দুইটা লাং দুইজনকে দেওয়া যায়। চোখ দেওয়া যায়। লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যায়।
‘আমাদের কেউ যদি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন অঙ্গ দান করেন, তাহলে তিনি মারা গেলেও তাঁর চোখ, কিডনিটা বেঁচে থাকে। কে কোন বিশ্বাসের, কোন ধর্মে, বর্ণের—এটা বড় কথা না। মানবতাই হলো মূল বিষয়। আমরা মারা গেলে অঙ্গ না দিলেও এগুলো পঁচেই যাবে, অথচ এটা দান করলে এর মাধ্যমে আরেকজন মানুষ বেঁচে থাকার সুযোগ পান। ট্রান্সপ্ল্যান্টের মাধ্যমে সুস্থ হওয়া ব্যক্তি বড় কিছুও হতে পারেন। সুতরাং ক্যাডাভারি ট্রান্সপ্ল্যান্ট আলোর মুখ দেখলে এটা মানুষ, মানবতার জন্য বিশাল কাজ হবে বলে আমার মনে হচ্ছে’, যোগ করেন ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।
এ ব্যাপারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেন, ‘প্রশাসন, সুশীল সমাজ, চিকিৎসক, গণমাধ্যমকর্মী—তারা যদি প্রচার-প্রচারণা চালান, তাহলে এটা খুব কঠিন হবে না।’
এ প্রসঙ্গে বিদ্যমান আইনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নাই। এটি যদি পূর্ণাঙ্গ ও যুগোপযোগী করা যায়, তাহলে জনগণ অঙ্গদানে উৎসাহিত হবেন, উদ্বুদ্ধ হবেন। কারণ আইন যেমন দরকার, তেমনি নিরাপত্তাও দরকার।
বক্তব্যে এই আইন প্রণয়নের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে নিজের লেখালেখির কথা তুলে ধরেন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। জানান, গণমাধ্যমে তাঁর এ সংক্রান্ত লেখা প্রকাশের পর একাধিক ব্যক্তি তাঁকে ফোন দিয়ে জানতে চেয়েছেন, তারা অঙ্গদানে আগ্রহী, এটি করতে তারা কোথায় যাবেন?
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আরও বলেন, অনেকেই তাদের একাধিক অঙ্গদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। সুতরাং ক্যাডাভারি ট্রান্সপ্ল্যান্টের কথা বললেই হবে না, এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে, কিছু করতে হবে। সুশৃঙ্খল উপায়েই করতে হবে।
এ সময় দেশে কৃত্রিম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের ঘটনাকে স্বাস্থ্যখাতের অভাবনীয় সাফল্য হিসেবে অভিহিত করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক। দেশের মাটিতে এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, এ ধরনের সাফল্যের জন্য মানসম্মত হাসপাতাল ও দক্ষ জনবল দুইই জরুরি।
গত ২ মার্চ রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে এক নারীর হৃৎপিন্ডে মেকানিক্যাল হার্ট বা লেফট ভেন্ট্রিকুলার অ্যাসিস্ট ডিভাইস (এলভ্যাড) স্থাপন করা হয়।
এ নিয়ে দেশ-বিদেশে সবার মধ্যে বিস্ময়ের কথা তুলে ধরে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘যে দিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট হলো, সে দিন আমাকে অ্যামেরিকা থেকে একজন ডাক্তার ফোন দিয়ে বললেন, ‘এটি আসলেই হয়েছে? অর্থাৎ তারা বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি বললাম, হয়েছে। তিনি বললেন, এটা তো অসম্ভব ব্যাপার। পৃথিবীতে সপ্তাশ্চর্য আছে, অষ্টমাশ্চর্য হলে বোধ হয়, বাংলাদেশে ট্রান্সপ্ল্যান্টের বিষয়টি বিবেচিত হতো।’
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেন, ‘দেশে ম্যাকানিক্যাল হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্ট হলো, এটি আসলেই আশ্চর্যের বিষয়। কারণ, প্রথম কথা হলো, এ রকম হাসপাতাল আছে কিনা, এ রকম চিকিৎসক আছে কিনা, টেকনোলজি আছে কিনা! কারণ এজন্য ম্যান-মেশিন দুইই দরকার। এ ধরনের হাসপাতাল না থাকলে তো এমন অপারেশন হতো না।’
এ রকম আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশে কৃত্রিম হার্ট প্রতিস্থাপনে সাড়া দেওয়ায় ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান প্রখ্যাত এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। বলেন, তারা হাসপাতাল করেছিলেন বলেই এ রকম একটি ঐতিহাসিক অর্জন ধরা দিয়েছে। এখানে শুধু কার্ডিয়াক না, বাইপাসহ অন্যান্য সব বিভাগের চিকিৎসা হচ্ছে। ফলে মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছে।
এ সময় রোগী ও তার স্বজনদের ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি রোগী ও তার স্বামীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি৷ বাংলাদেশে যে এ ধরনের সার্জারি সম্ভব তা ডা. জাহাঙ্গীর কবীরের নেতৃত্বে প্রমাণিত হয়েছে। এটি অত্যন্ত গৌরবের। এটি আমাদের বিরাট সাফল্য।’
বাংলাদেশে বাইপাস সার্জারির ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, হার্টের চিকিৎসার জন্য মানুষ কলকাতা যেতো, দিল্লি যেতো। ওই পরিস্থিতি থেকে তাদের প্রচেষ্টায় এখন দেশে অহরহ বাইপাস সার্জারি হচ্ছে।
এ পথ ধরে হার্ট ট্রান্সপ্ল্যান্টের সূচনা হওয়ায় তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে ঐতিহাসিক সূচনার জন্য ডা. জাহাঙ্গীর কবির ও তাঁর দলকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, বাহির থেকে কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না যে, বাংলাদেশে এটা সম্ভব হয়েছে।
ডা. আব্দুল্লাহ আরও বলেন, ‘যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ট্রান্সপ্ল্যান্ট সফল করতে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের আবারও অভিনন্দন। তাদের আন্তরিতক প্রচেষ্টায় রোগী কত চমৎকারভাবে সুস্থতার সঙ্গে আছেন। আসলে আল্লাহ তা’লাই করেছেন। তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন, তিনি না করলে তো আর এসব হতো না। সব সময় মনে রাখতে হবে, যা হয়, আল্লাহ তা’লার হুকুমেই হয়। তিনিই এই রোগীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কারণ তার এই স্বাস্থ্য সমস্যা সেই ২০১৬ সাল থেকে। এতো দিনে তাঁর বেঁচে থাকারও কথা ছিল না। আল্লাহর রহমতেই তিনি বেঁচে আছেন। আমাদের চিকিৎসকরা সফল হয়েছেন।