ডা. মোহাম্মদ আহাদ হোসেন

ডা. মোহাম্মদ আহাদ হোসেন

কনসালটেন্ট, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা
 


২২ জুন, ২০২০ ০৩:৫৩ পিএম

করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য

এই করোনাকালে প্লাজমা থেরাপি বেশ আলোচিত একটি বিষয়। এটা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে বেশ কয়েক দিন কাজ করেছি। আমাদের জনসচেতনতা বাড়ানো এবং সাধারণ মানুষকে এ বিষয়ে সঠিক ধারণা দিতেই আজকের লেখা। লিখতে গিয়ে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রেফারেন্স ফলো করার চেষ্টা করেছি।

প্লাজমা কী?

প্লাজমা হলো আমাদের রক্তের একটি অংশ। রক্তের লোহিত কণিকা, শ্বেতকণিকা ও অনুচক্রিকা বাদ দিলে যা থাকে, তাই প্লাজমা। এর ৯৩ শতাংশ পানি এবং ৭ শতাংশ অন্যান্য উপাদান, যাদের মধ্যে আছে বিভিন্ন প্রোটিন- যেমন ইমিউনোগ্লোবিন বা এন্টিবডি, ক্লটিং ফেক্টর বা রক্ত জমাট বাঁধার উপাদান ও অন্যান্য কিছু উপাদান। এন্টিবডি অংশটাই কোভিড রুগীর শরীরে কাজে লাগে।

প্লাজমা থেরাপি:

প্লাজমা থেরাপি নতুন কিছু নয়। প্রায় ১০০ বছর আগে থেকেই এই থেরাপি প্রচলিত। এর আগেও Rhabes, Hepatitis B, Measles, Infuenza, Ebola, MARS, SARS- এসব জীবাণু আক্রান্তের সময়ও এই থেরাপি ব্যবহৃত হয়েছে। মূলত এটা শরীর থেকে germ clearance বা জীবানু অপসারণে ভূমিকা রাখে।

করোনারোগীর ক্ষেত্রে কীভাবে কাজ করে:

যারা করোনায় আক্রান্ত হন তাদের শরীরে দুই থেকে তিন সপ্তাহ পর এক ধরনের এন্টিবডি তৈরি হয়, যাকে বলে নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি (Neutralizing antibody) যা কিনা ELISA টেস্টের মাধ্যমে জানা যায়। এটাও গবেষণায় দেখা গেছে যে যাদের এ ধরনের এন্টিবডি তৈরি হয় তাদের কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস ওই জীবাণু দ্বারা আবার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। বেশ কিছু প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, প্লাজমা থেরাপিতে বেশ কিছু severely বা critically অসুস্থ্ করোনা রুগী সুস্থ্ হয়েছেন বা জীবাণুমুক্ত হয়েছেন।

আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা লাইফ সাপোর্টে আছেন তাদের থেকে অন্যান্য critically অসুস্থ্ করোনা রুগী তাড়াতাড়ি সুস্থ্ হয়েছেন। আমাদের দেশেও এই থেরাপি ভালো কাজ করছে বলে চিকিৎসকরা মত প্রকাশ করেছেন। তাই বলা যায়, প্লজমা থেরাপি severely বা critically অসুস্থ্ করোনা রুগীর ক্ষেত্রে একটি ভালো উন্নতি নিয়ে আসতে পারে।

ঝুঁকি আছে কি না?

রক্ত বা অন্যান্য উপাদান মানবশরীরে প্রবেশে যে ঝুঁকি থাকে এ ক্ষেত্রেও সেরকম ঝুঁকি রয়েছে। যেমন এলারজিক রিয়েকশন, Transfusion Associated Circulatory Overload (TACO), Transfusion associated acute lung injury (TRALI), ফুসফুসের ক্ষতি। আর করোনার ক্ষেত্রে ফুসফুসেই ইনফেকশন হয়। তাই নিশ্চিত না হয়ে বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই প্লাজমা থেরাপি দেয়া যাবে না। তবে আশার কথা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের একটি তথ্য বলেছে তারা ৫০০০ রুগীর মধ্যে ৭০০০ ইউনিট প্লাজমা নিরাপদেই দিতে পেরেছেন।

এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। প্লাজমা দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সিস্টেম জড়িত থাকে; যেমন ডোনার নিরাপদ কি না, কালেকশন সিস্টেম নিরাপদ কি না, সঠিকভাবে সংরক্ষণ হয়েছে কি না, যিনি দিচ্ছেন সঠিকভাবে দিচ্ছেন কি না ইতাদি। সব স্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েই এটা দিতে হবে। তা না হলে উপকারের চেয়ে ক্ষতিও হতে পারে। শরীরের বাইরে থেকে একটি এজেন্ট শরীরে ঢুকালে উল্লেখিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা সঠিকভাবে অনুসরণ না করলে শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা উল্টো রিয়েকশন করতে পারে। এতে মারাত্নক ক্ষতি হতে পারে।

একজন কতবার কতটুকু প্লাজমা দিতে পারবে?

প্লাজমা ডোনেশনের ক্ষেত্রে রক্তের সেল বা কণিকাগুলো বাদ দিয়ে বাকি প্রোটিনগুলো নেয়া হয়। সেক্ষেত্রে শরীর স্বাভাবিকভাবে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম হয়। এই কারণে আমেরিকার ফেডারেল ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) সাত দিনে দুবার প্লাজমা ডোনেশনের অনুমতি দিয়েছে। তবে দ্বিতীয়বার ডোনেশনের মধ্যে অন্তত এক দিন সময়ের ব্যবধান থাকার কথা বলেছে। অবশ্য রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সপ্তাহে একবার প্লাজমা ডোনেশন নিচ্ছে।

বোঝা যাচ্ছে, আমরা একাধিকবার প্লাজমা দিতে পারি। একজন একবারে কী পরিমাণ প্লাজমা দিতে পারবে সেটা ডোনারের বয়স, ওজন ও অন্যান্য অবস্থার ওপর চিকিৎসক নির্ধারণ করবেন।

কোন ধরনের করোনা রুগীর জন্য প্লাজমা দরকার:

১। হাসপাতালে ভর্তি করোনা রুগী;

২। Severe disease condition- শ্বাসকষ্ট, শ্বাস-প্রশ্বাসের হার মিনিটে ৩০ বা তার বেশি, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৩ বা তার কম; বুকের এক্স-রেতে ৫০ ভাগের বেশি অক্রান্ত হওয়া;

৩। মারাত্নক খারাপ অবস্থা বা life threatening conditions- Respirattory Failure, Septic shock, Multi organ failure।

কারা প্লাজমা দিতে পারবে

১। করোনায় আক্রান্ত রুগী যিনি ন্যাজাল সোয়াবের পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছেন; অথবা যিনি টেস্ট করতে পারেননি, কিন্তু করোনা সন্দেহভাজন ছিলেন এবং পরবর্তীতে এন্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে করোনার এন্টিবডি পাওয়া গেছে।

২। করোনার লক্ষণসমূহ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার ১৪ দিন পর। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে শুধু নেগেটিভ টেস্টের মাধ্যমেই নিশ্চিতভাবে ডোনার নেয়া যাবে না।

৩। গর্ভবতী মহিলার প্লাজমা নেয়া যাবে না। প্লাজমা নিতে হলে তার প্রেগন্যান্সি টেস্ট নেগেটিভ হতে হবে।

৪। পুরুষ বা মহিলা ডোনার HLA antibody test negative হতে হবে।

৫। ডোনারের অবশ্যই Syphilis, Hepatitis and HIV (AIDS) স্ক্রিনিং টেস্ট করে নিতে হবে।

৬। ডোনারের সোশাল ও ভ্রমণের ইতিহাস জেনে নিতে হবে।

প্লাজমা ডোনেশন নিরাপদ কি না?

আমরা যারা নিয়োমিত রক্ত দেই, তারা যেমন নিরাপদ থাকেন, প্লাজমা ডোনেশনও সেই রকম নিরাপদ। এই প্রক্রিয়ায় যেসব ব্যাগ, টিউব ব্যবহার হয় সেগুলো একজন রুগীর জন্য একবার ও জীবাণুমুক্ত উপকরণ ব্যবহার হয়। তাই নিরাপদে আপনারা প্লাজমা দিতে পারেন।

ডায়াবেটিস রুগী প্লাজমা দিতে পারবে কি না?

এটা ডায়াবেটিস রুগীর ধরন বা তিনি কী ধরনের ওষুধ খাচ্ছেন। তার কোনো ডায়াবেটিস জনিত কম্পলিকেশন আছে কি না। এসব বিষয় জেনে নিয়ে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি প্লাজমা দিতে পারবেন কি না।

পরিশেষে বলতে চাই, প্লাজমা থেরাপি করোনা চিকিৎসায় একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে। তবে নিরাপদ প্লাজমা দেয়া ও নেয়া নিশ্চিত করতে রেজিস্টার্ড কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।

  ঘটনা প্রবাহ : করোনাভাইরাস
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত