‘দুর্নীতি-অপচয়ের কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটছে না’

মেডিভয়েস রিপোর্ট: দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটছে না। এজন্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের অদক্ষতাও অনেকাংশে দায়ী। চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবার মান সর্বকালের সর্বনিম্নে অবস্থান রয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে। আজ মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) সাড়ে ১১টায় রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে নাগরিক বিকাশ ও কল্যাণের (নাবিক) আয়োজনে ‘জনবান্ধব বাজেট ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন।
স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ সর্বনিম্নে অবস্থান করছে উল্লেখ করে তারা বলেন, ব্যক্তির পকেটের খরচ কমাতে এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি।
নাবিকের সহ-সভাপতি বুরহান ফয়সলের সঞ্চালনায় ‘স্বাস্থ্য বাজেট’ পর্বে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। এতে আলোচক হিসেবে ছিলেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. মো. এনামুল হক, এবি পার্টির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মনজুর মোরশেদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আলোকে এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব বাড়াতে হবে। এটি ছাড়া নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বরাদ্দের তুলনা নির্দেশ করে অ্যালায়েন্স ফর হেলথ রিফর্মস বাংলাদেশের (এএইচআরবি) আহ্বায়ক বলেন, স্বাস্থ্য বরাদ্দে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একদম তলানিতে রয়েছে।
তিনি বলেন, গত বছর স্বাস্থ্যে মোট বাজেটের ৫ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল, যা জিডিপির ০.৪৭% ছিল। আগেরবারও এমন ছিল। ২০২২-২৩ এ প্রস্তাব ছিল ৩৬ হাজার কোটির বেশি, ষান্মাসিক পর্যালোচনার সময় কমিয়ে ২৯ হাজার সাতশ’ কোটি করা হয়। এ বছর ব্যয় হয় ২২ হাজার ৬০০ কোটির মতো।
‘আমাদের বুঝতে হবে এটি কেন ব্যয় করতে পারছি না। যদি পুরোটা ব্যয় করা যায়, তাহলে তিনগুণ বেশি কাজ করা যাবে। কিন্তু দুর্নীতির কারণে সম্ভব হয়নি। আরেকটি হচ্ছে, সকল চিকিৎসকের সমানভাবে দায়িত্ব পালন নিশ্চিত না করা’—যোগ করেন অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ।
তিনি বলেন, হাসপাতাল একটি জটিল প্রতিষ্ঠান। নীতিনির্ধারকদের এই ক্ষেত্রে বোঝার ঘাটতি আছে। এটি জনসম্পদের অপচয়। আমাদের রিসোর্সগুলোকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে হবে। একইসাথে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। আধুনিক কোনো ফ্যাসিলিটিজ গড়ে তোলা হয়নি। আধুনিক মেডিকেল স্টোরেজ নাই। ৫৪ বছরে এই আর্কিটেকচারাল ডিজাইনই করা যায়নি।
এর সমাধানে একাধিক পরামর্শ তুলে ধরেন তিনি। বলেন, রুরাল হেলথ সিস্টেমের তিনটি এপিসেন্টারকে ইউটিলাইজ করে একটি সেন্টারে পরিণত করতে হবে। সবার জন্য হেলথ কার্ড দিতে হবে। ন্যাশনাল হেলথ ফান্ড গঠন করতে হবে।
নাবিকের সহ-সভাপতি বুরহান উদ্দিন ফয়সলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন এবি পার্টির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আব্দুল ওহাব মিনার, স্বাস্থ্য হাইলি টেকনিক্যাল বিষয়। সাধারণ মানুষ এগুলো বোঝে না।
এক সময় মানুষ টিকা নিতো না। এখন সে প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে ইপিআই কর্মসূচি সফল হয়েছে।
স্বাস্থ্য প্রশাসনকে বোঝাতে হবে। যারা ক্ষমতার চেয়ারে বসে, তাদের প্রথম টার্গেট থাকে এই চেয়ারে কতদিন থাকা যায়। এ থেকে কীভাবে উত্তরণ হবে?
ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর জরিপের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এ জরিপগুলো সত্য নয়। এ রোগগুলো প্রিভেন্ট করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
২.৫ মিলিয়ন ড্রাগ এডিক্টস বাংলাদেশে। এদের ৮০ ভাগই বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী।
স্বাস্থ্যে বরাদ্দের চেয়ে তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেন অধ্যাপক ওহাব মিনার। তিনি বলেন, ‘বাজেট বেশি রেখে লাভ নাই, বালতির তলা ছিদ্র করে বের করে দিবে। যে বাংলাদেশ তৈরি করতে চায় তা প্রস্তুত, কিন্তু আমরা প্রস্তুত না।
সভাপতির বক্তব্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা, স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, সব জায়গার মতো স্বাস্থ্যেও ঘাটতি আছে। স্বাস্থ্যবান জাতিই উন্নত জাতি। স্বাস্থ্যবান জাতি না হলে উন্নত জাতি হতে পারবেন না।
তিনি বলেন, জনবান্ধব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য দরকার বাজেট। প্রয়োজনটা যেন মেটানো যায়। কিন্তু শুধু বাজেট থাকলেই স্বাস্থ্যের মান বাড়বে না।
ডব্লিউএইচওর সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মানোন্নয়ন হচ্ছে না, তার কারণ স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি। আরেকটি হলো অপচয়, যেখানে যা ব্যয় হওয়ার কথা সেখানে হচ্ছে না। এজন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীদের অদক্ষতাও একটি কারণ।
তিনি বলেন, মানুষের চিকিৎসায় বড় অংশ নিজের পকেট থেকে ব্যয় করে, যা প্রায় আফ্রিকার দেশগুলোর সমান।
চিকিৎসা শিক্ষার মান সর্বকালের সর্বনিম্নে। চিকিৎসা সেবার মানও একই। শিক্ষার মানোন্নয়নে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার মান বাড়াতে পারলে সেবার মান বাড়াতে পারব।
এ সময় স্কুলের পাঠ্যক্রমে স্বাস্থ্যশিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এটি করা গেলে সবাই উপকৃত হবে।
বক্তব্যে নাবিক সহ-সভাপতি বুরহান উদ্দিন ফয়সলে বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে পিছিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। একইসাথে বরাদ্দেও পিছিয়ে রয়েছে।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের (বিএইচআরএফ) সভাপতি রাশেদ রাব্বি বলেন, দুর্নীতি রোধের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। জনস্বাস্থ্যে গুরুত্ব দিতে হবে।
বক্তব্য রাখেন জাতীয় বিপ্লবী পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. মো. জহিরুল ইসলাম।
