ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দীন
নার্স ও পুষ্টিবিদ,
বিএসসি ইন নার্সিং (চবি), এমপিএইচ ইন নিউট্রিশন (ইবি)।
০৯ জুলাই, ২০২৪ ০২:১২ পিএম
অর্থনীতি ও সেবার চিত্র বদলে দিতে পারে নার্সিং পেশা
নার্সিং পেশা একটি মানবিক পেশা। বর্তমানে তরুণদের কাছে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কারণ এই পেশা সংশ্লিষ্টরা যেমন অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা পাচ্ছে, তেমনি তারা অবদান রাখছে জাতির স্বাস্থ্যসেবায়। যুগযুগ ধরে নার্সিং খাত অবদান রেখে চলছে দেশের স্বাস্থ্যসেবায়। স্বাস্থ্য বিভাগের অন্যান্য অর্জন যেমন—সর্বশেষ করোনা মোকাবিলায় নার্সদের আত্মত্যাগ, নিবেদিত প্রাণ ও কর্মতৎপরতা, দেশ ও জাতির কল্যাণে তাদের যে দায়িত্ব পালনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভ্যাকসিন হিরো পুরস্কার অর্জনসহ মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমানো তাই প্রমাণ করে।
বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল প্রান্তিক জনগণের কাছেও স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া, যাতে তারা সহজেই এই সেবা পেতে পারে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী দেশের স্বাস্থ্যসেবাকে গ্রামের মানুষের জন্য সহজলভ্য করতে জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে স্বাস্থ্য সেবার মান ও সুবিধা বৃদ্ধি করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারের সময়কালে প্রায় ৩২ হাজার নার্স ও আড়াই হাজার মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ৪৭ হাজার নার্স সরকারিভাবে কর্মরত।
গেল কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক নার্স দিবস পালিত হয়েছে। এবারে দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছিল ‘Our Nurses Our Future: The economic power of care.’ অর্থ—‘‘আমাদের নার্স আমাদের ভবিষ্যৎ: অর্থনৈতিক শক্তি, নার্সিং পেশার ভিত্তি।’’ এই সেবা, অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে বেশ কিছু বিষয় গুরুত্ব পেতে পারে—
কমিউনিটি নার্সিংয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার কম
কমিউনিটি নার্সিং কেয়ারের মাধ্যমে হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার কমাতে অবদান রাখেন নার্সরা। এই সুবিধার মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি একসাথে বিশাল জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় সম্পৃক্ত করা যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এতে জনগণের অর্থ ও সময় দুটো সাশ্রয় হচ্ছে। সঠিকভাবে কমিউনিটি নার্সিং কেয়ার প্রদান করলে রোগের প্রাদুর্ভাব উল্লেখযোগ্য হারে কমবে, যা দেখা গেছে করোনাকালীন সময়ে। কমিউনিটি নার্সিং সেবা পদ্ধতি কানাডাসহ বিশ্বের অন্যন্য দেশেও খুব জনপ্রিয়।
প্রতিরোধমূলক নার্সিং সেবায় অসংক্রামক ব্যাধি নিরাময়
প্রিভেন্টিভ নার্সিং কেয়ার বা প্রতিরোধমূলক নার্সিং সেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের মাঝে স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। জনসচেতনতা বাড়লে সংক্রামক/ অসংক্রামক ব্যাধিগুলো সংক্রমনের হার কমে যায়। ফলে হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি হার কমে। জাতীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব পড়ে। কারণ একজন কর্মক্ষম ব্যক্তি যদি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় তাহলে তার আয় বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ হয়।
সংক্রমণ বিধিমালা মেনে সেবা দেয়ায় কম সময়ে সুস্থ রোগী
সংক্রমণ বিধি মেনে হাসপাতালে নার্সরা সঠিকভাবে সেবা প্রদানের ফলে হাসপাতালে রোগীর অল্প সময়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু যদি সংক্রমন বিধিমালা না মেনে সেবা দেওয়া হলে Hospital Acquired Infection (HAI) স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত সংক্রমণ হার বেড়ে যায়। এতে হাসপাতালে রোগীর অবস্থানকাল দীর্ঘ হয় ফলে অতিরিক্ত অর্থ, সময় ও বাড়তি জনশক্তি দরকার হয়, যার বিরূপ প্রভাব পড়ে অর্থনীতিতে।
নার্সদের বৈদেশিক মুদ্রায় সচল দেশের অর্থনীতি
বর্তমানে মধ্য প্রাচ্য যেমন—কুয়েত, সৌদি আরব, লিবিয়াসহ ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী প্রায় পাঁচশতাধিক নার্স কর্মরত রয়েছেন। বুয়েসল (BOESL) মাধ্যমে আরও কিছু দেশে নার্স রপ্তানি কাজ চলমান। ফলে আমাদের যে রিজার্ভ সংকট তা কমাতে সহায়ক হচ্ছে এই পেশা। তাই আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নার্স শিক্ষা-কারিকুলাম ও বিদেশ গমন আরও সহজতর করা জরুরি।
বয়স্কদের চিকিৎসায় সেবা কেন্দ্র চালু সময়ের দাবি
জেরিয়াট্রিক সেবা কেন্দ্র চালু করলে বয়োজ্যেষ্ঠ (সিনিয়র সিটিজেন) আপদকালীন সময়ে চিকিৎসা ব্যয়টা কমবে কিংবা বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার হারটা কমবে। ফলে অল্প খরচে ভালোমানের চিকিৎসা দেশে দেওয়া সম্ভব হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে দুই লাখ ৫০ হাজার নার্সের প্রয়োজন হবে। কারণ তখন আমাদের ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য জেরিয়াট্রিক সেবা কেন্দ্র দরকার।
নার্সিং পেশাকে আরও গুরুত্ব দেয়া জরুরি
এখন এটা সুস্পষ্ট যে, স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে নার্সিং পেশার মান্নোয়ন প্রয়োজন। বলা হয়, একটি দেশের স্বাস্থ্য সেবার মানদণ্ড ৮০ শতাংশ নার্সিং সেবার মানের ওপর নির্ভরশীল। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিঙ্গাপুর,থাইল্যান্ড,কানাডা, ইংলান্ড আমেরিকাসহ যেসব দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত, সেসব দেশের স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধির পেছনে নার্সদের সেবা প্রদানের ভূমিকা রয়েছে। পাশের দেশ ভারত, মায়ানমার তাদের স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়ন করেছে নার্সিং পেশা গুরুত্ব দিয়ে। এ জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নার্সদের উন্নতিকল্পে প্রয়োজনীয় প্রদক্ষেপ নেওয়ার জন্য গুরুত্বারোপ করেছিলেন।
যদি নার্সদের পদ বিন্যাস আরও সুশৃঙ্খল আর আধুনিকমানের করা যায়, তাহলে এসডিজি অর্জন সহজতর হবে এবং আমরা আরও অগ্রসর হবে। দেশে স্বাস্থ্যসবে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে এই সংশ্লিষ্ট জনবল। তাই এ বিশাল জনবলকে সুষ্ঠুভাবে মনিটরিং দরকার। নার্সিং খাতের আরেকটি সহযোগী খাত হচ্ছে মিডওয়াইফারি খাত। নার্সিং বিদ্যমান প্রশাসনিক জনবল কাঠামো দিয়ে মিডওয়াইফারিকে দেখভাল করা হচ্ছে। বর্তমানে মিডওয়াইফ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বহুগুণ বেড়েছে। ফলে এটিও বর্তমান নার্সিং প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর নতুন করে চাপ তৈরি করছে। এজন্য নতুন প্রস্তাবিত পদ বিন্যাস বহুলাংশে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জরুরি উচ্চতর গ্রেডের নতুন পদ সৃজন
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মিশন ভিশন গ্রাম হবে শহর, জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেয়ার যে প্রয়াস তা সঠিকভাবে পালন করতে হলে অপার সম্ভাবনাময়ী এ নার্সিং পেশায় পদ বিন্যাস প্রয়োজন। জনগণের সেবা প্রাপ্তি সহজ করতে ও নার্সদের চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের (অটোমেশন) সময়োপযোগী দক্ষ ও আধুনিক জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে, এ পেশায় প্রশাসনিক সক্ষমতা ও পদবিন্যাস বা উচ্চতর গ্রেডের নতুন পদ সৃজন অনেকটা সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সুতরাং বলা যায়, স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন করতে হলে নার্সিং পেশার মান্নোয়নে প্রয়োজন। নার্সদের সুষ্ঠু জনবল কাঠামো বা পদসোপান তৈরির মাধ্যমে নার্সিং পেশার মান্নোয়ন সর্বোপরি স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধি পাবে। তাই সময় এসেছে প্রিভেন্টিভ নার্সিং, কমিউনিটি নার্সিংয় ও সংক্রমণ বিধিমালার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের প্রতিরোধযোগ্য রোগবালাই,রোগের প্রাদুর্ভাব, হাসপাতালে রোগীর ভর্তির হার কমানো যাবে। এতে অর্থনীতির নিরব বিপ্লব সংগঠিত হবে।
যদি আমরা সামগ্রিক সেবার মাধ্যমে রোগীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করতে পারি তাহলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় অর্থব্যয় কমবে। তাই অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জনে আরও বেশি বেশি নার্সিং সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া প্রয়োজন।
এনএএন/