ডা. আশরাফ জুয়েল

ডা. আশরাফ জুয়েল

চিকিৎসক ও কথাসাহিত্যিক,
কনসালটেন্ট, আইসিইউ ও ইমার্জেন্সি, বিআরবি হাসপাতাল।


১০ অগাস্ট, ২০২৩ ০৭:২২ পিএম

আমি বারবার চিকিৎসক হিসেবে জন্ম নিতে চাই

আমি বারবার চিকিৎসক হিসেবে জন্ম নিতে চাই
ডা. আশরাফ জুয়েল। ছবি: সংগৃহীত

চিকিৎসক হিসেবে আমার অর্জন হয়তো কিছুই নেই। তবুও, আমি বারবার চিকিৎসক হিসেবেই জন্ম নিতে চাই। পাস করার পর থেকেই কাজ করছি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। তাও প্রায় উনিশ বছর। রাজধানীর বারডেম থেকে আরম্ভ করে দুইটা কর্পোরেট ঘুরে এখন বিআরবি হাসপাতালে।

২০০৫ সালে যখন প্রথম বারডেম আইসিইউতে ঢুকি, মনে হয়েছিল এ বুঝি কোনো কল্পচিকিৎসা বিজ্ঞানের জগৎ। মেশিনপত্রে ঝুলে আছে মানুষের জীবন। খুব ভালো লেগে যায়। প্রথম দিন যে প্যাশন নিয়ে কাজ আরম্ভ করেছিলাম, নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি আজও সেই প্যাশন এতোটুকুও কমেনি।

দিনের পর দিন সংকটাপন্ন রোগীদের নিয়ে কাজ করতে একটুও ক্লান্তি লাগেনি, আজও লাগে না। প্রায় মাস খানেক আগে ক্যান্সার আক্রান্ত এক রোগী সেপসিস নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন আইসিইউতে। দিন দশেক পরে স্থানান্তর হয়ে ওয়ার্ডে যান। রোগীর অনুরোধে মাঝেমধ্যে কেবিনে গিয়ে তাঁকে আনঅফিশিয়ালি দেখে আসতাম। এক সময় তিনি বাসায় চলে যান। বারবার বুকে পানি জমে যাবার জন্য বুকে একটা পাইপ বা পিগ টেইল লাগিয়ে দিয়েছিলাম, যেন তিনি চাইলেই বুকের জমা পানি বের করে নিতে পারেন।

বাসায় গিয়েও মাঝেমধ্যে ছোট-খাটো প্রবলেম হলে কল দিয়ে পরামর্শ নিতেন। অজ্ঞান অবস্থায় পুনরায় তিনি হাসপাতালে আসেন, এবার কার্বনডাই অক্সিজেন রিটেনশন। নন-ইনভ্যাসিভ ভেণ্টিলেটর দিয়ে ম্যানেজ করা হয় এবং বাই-প্যাপসহ আবারও বাসায় পাঠানো হয়। দিন দশেক পর আবারও আসেন হাসপাতালে। এবারও আনকনসাস, সিও টু ১১৫ বা এরও কিছু বেশি। হাসপাতালে নন-ইনভ্যাসিভ ভেন্টিলেটর দিয়ে ম্যানেজ করা হচ্ছে এখনো।

যতবার উনার সামনে গিয়েছি, প্রতিবারই উনার হাসিমুখ দেখেছি। তীব্র শ্বাসকষ্টের মধ্যেও তার মুখ থেকে হাসি হারিয়ে যায়নি। প্রতিবার অবাক হয়ে ভেবেছি, একটা মানুষ এতো কষ্টের মধ্যেও হাসেন কীভাবে! আল্লাহর কাছে তার জন্য দোয়া করেছি আর মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি, তিনি এখনও আমাদের সুস্থ রেখেছেন এবং অসুস্থ মানুষের সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। মাঝে মাঝে আমার হাত ধরে তিনি বলতেন, ডাক্তার সাহেব, আমাকে বাঁচান, আমি বাঁচতে চাই! আমার বাচ্চা দুইটা ছোট, ওদের জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে। আমি আশ্বাস দিতাম, ইনশাআল্লাহ আপনি সুস্থ হবেন। কিন্তু জানতাম, এ রোগ তো সারার না।

আজ উনার অবস্থা বেশ খারাপ, যেকোনো সময়ই কার্ডিয়াক এরেস্টে যাবার আশঙ্কা। ডিএনআর/ডিএনআই দেওয়া। জ্ঞান আছে, মাঝেমধ্যে অলটারড। উনার ওয়াইফের বড় ভাই, আমাকে ডেকে একটা কাগজ দেখালেন। অনুরোধ করলেন, আমি যেন রোগীর অনুরোধ না ফেলি।

কাগজটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ ভিজেও এলো। রোগীর ভাই আমার হাত ধরে রোগীর শেষ ইচ্ছাটা রাখার জন্য অনুরোধ করলেন। একটা চিরকুটে স্বজনদের কাছে কাঁপাকাঁপা হাতে তিনি লিখেছেন, আমাকে যেন ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয় এবং আমি যেন আমার ইচ্ছে মতো এই টাকাটা খরচ করি এবং তার হাসপাতালের বিল হিসেবে যেন এ টাকা দেওয়া না হয়।

আমার কোনো কথাই তিনি শুনলেন না। রোগীর মাথায় হাত দিয়ে জানালাম, এই টাকা আমি নিতে পারবো না। কিন্তু তিনি অনড়। ইশারায় বারবার অনুরোধ করলেন। রোগীর ভাইও বললেন, এটা আমার ভাইয়ের শেষ ইচ্ছে, আপনি না করতে পারবেন না। রাজি হলাম এই শর্তে যে, এই টাকার পুরোটা আমি কোনো মসজিদ-মাদ্রাসায় রোগীর নামে দিয়ে দেবো বা কোনো গরিব রোগীর চিকিৎসায় ব্যয় করবো। তিনি শান্ত হলেন। রুমে ফিরে চুপচাপ বসে থাকলাম। চোখের দুই কোন ভিজে উঠলো অজান্তেই।

আল্লাহপাক আমাদের সকলকে সুস্থ করে দিন। সকলের সমস্ত গুনাহকে নেকীতে রূপান্তরিত করে দিন। সকলকে রোগমুক্ত করুন, রোগীর সকল কষ্ট দূর করে দিন। আমীন।

চিকিৎসক হিসেবে আমার প্রতি রোগীদের এই যে বিশ্বাস ও আস্থা—এই অর্জনগুলোই আজীবন আমার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : চিকিৎসা সেবা
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক