‘ট্রান্সপ্ল্যান্টের সুবিধার্থে ঋণ নিয়ে মেশিন কিনেছি, টাকা উঠবে কি-না জানি না’

অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বাবার সম্মানে বিনা পারিশ্রমিকে সম্প্রতি তিনি ১২০০ কিডনি প্রতিস্থাপন সম্পন্ন করেছেন। ফলশ্রুতিতে দেশের সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন এই মানবিক চিকিৎসক।
সরকারি চাকরি জীবনে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (নিকদু) ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন অধ্যাপক কামরুল ইসলাম।
কিডনি প্রতিস্থাপনে নানা জটিলতার প্রেক্ষাপটে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এ সেবাকে বেগবান করতে রাজধানীর শ্যামলীতে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস (সিকেডি) অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল।
এ হাসপাতালে তাঁর হাত ধরেই দেশের বেসরকারিখাতে কিডনি প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনার অপার দাঁড় খুলেছে। স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার স্বাধীনতা পদক পেয়েছেনও তিনি।
গত সপ্তাহে তাঁর রেকর্ড পরিমাণ কিডনি প্রতিস্থাপনের মুহূর্তটি স্মরণী করে রাখতে মেডিভয়েস মুখোমুখি হয় এই কিংবদন্তি চিকিৎসকের। আলাপচারিতায় উঠে আসে জীবনের সংগ্রামমুখরতা, ঈর্ষণীয় সাফল্যের গৌরবগাঁথা ইতিহাস ও দেশের স্বাস্থ্যখাত নিয়ে তার নানা ভাবনা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: সাখাওয়াত হোসাইন। সহযোগিতায় শাহেদুজ্জামান সাকিব।
মেডিভয়েস: ১২০০ কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। এটি চিকিৎসাসেবার জন্য মাইলফলক। নিজেকে মানবসেবায় নিয়োজিত করে কেমন লাগছে?
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: আমাদের দেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। প্রতি বছর প্রায় ছয় হাজার নতুন রোগীর ডায়ালাইসিস লাগছে, যাদের দুটি কিডনিই বিকল হয়ে গেছে। প্রতিস্থাপন করাও প্রয়োজন। সেই তুলনায় আমরা খুব কম পরিমাণে কিডনি প্রতিস্থাপন করছি। দেশে বছরে চারশ’র কাছাকাছি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। তার মধ্যে গত বছর আমাদের এখানে প্রায় ২০০ কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারছি।
মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি আমাদেরকে এই কাজটি সহজ করে দিয়েছেন। সফলতার সঙ্গে এই শেষ করতে পেরেছি। ভবিষ্যতে যাতে আরও বড় পরিসরে করতে পারি। সেটাই আপাতত চিন্তা-ভাবনা।
মেডিভয়েস: আপনার অনুপ্রেরণার উৎস জানতে চাই।
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: যখন কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু করেছিলাম, তখন অনেক ভয়ে ছিলাম। অনেক ক্ষেত্রে সফলতা আসে না। রোগী খারাপ হয়ে যায়, এমনকি মৃত্যুও হয়। কিডনি কাজ করে, আবার করে না, এ রকম নানা সমস্যা। একজন ডোনেট করছে, সেটা যদি কাজ না করে অনেক জবাবদিহিতার প্রশ্ন আসে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা খুব আস্তে আস্তে কাজ শুরু করি। শুরুর দিকে প্রতিস্থাপনের পর রোগীকে এক মাস বা দুই মাস রোগীকে হাসপাতালে রেখে দিতাম। সহজে ছুটি দিতাম না, সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার পর ছুটি দিতাম। এখন কাজ সহজ মনে হয়। এ ছাড়াও অনেক কাজ আমার সহযোগীরাও করতে পারেন। আগে পুরো কাজটাই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে করতে হতো। এখন প্রধান কাজ আমি করে, বাকিটা সহযোগীরা করতে পারেন। এতে আমাদের অনেক শেখাও হয়েছে।
রোগীদের সুস্থতাই আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপেরণা দেয়। একটা রোগী যখন সুস্থ হয়ে বাসায় যায়, সেটাই আমাকে দ্বিতীয় কাজে এগিয়ে নিয়ে যায়। যখন কোনো কঠিন কাজ সফলভাবে শেষ করা যায়, তখন দ্বিতীয় পদক্ষেপ নিতে সহজ হয়ে যায়। সফলতাই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
মেডিভয়েস: কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া ও খরচ সম্পর্কে একটু বলবেন।
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: দেশে আমরা এখনও জীবিত মানুষের কাছ থেকে কিডনি নিয়ে থাকি। সেটা নিকট আত্মীয় হতে হবে। ফার্স্ট ডিগ্রি বা সেকেন্ড ডিগ্রি হতে হবে। বাবা-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, চাচা-ফুফু—এই জাতীয় আত্মীয়দের কাছ থেকে কিডনি নেওয়া হয়ে থাকে। ২০১৮ সালে এই সম্পর্কিত একটি আইনও হয়েছে। এতে ডোনারের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধিও পেয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপনে আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সংকট হলো ডোনার স্বল্পতা, ডোনার খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। এক্ষেত্রে রোগীরা বিদেশের শরণাপন্ন হন, সেখানে গিয়ে চিকিৎসা নেন।
ডোনারকে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। তাঁর দুটি কিডনিই ভালো আছে কিনা? আবার রোগীর সঙ্গে ডোনারের কিডনি ম্যাচ করবে কিনা, এটাও একটা বিষয়। কিডনি প্রতিস্থাপনের আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রায় ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। যখন ভর্তির সময় রোগীর বেশ কিছু ওষুধপত্র লাগে। অপারেশনের পরে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) থাকতে হয়। আইসিইউ খরচ আছে। সেই সাথে ডোনারও থাকে আরেকটি বেডে। আর আমাদের হাসপাতালে সব মিলিয়ে ২ লক্ষ ১০ হাজার টাকা নিয়ে থাকি। বাণিজ্যিক হাসপাতালে টাকা আরেকটু বেশি লাগে। কিডনি ফাউন্ডেশনে সম্ভবত দুই লাখ বা আড়াই লাখ টাকা নিয়ে থাকে। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে প্রায় ১ লাখ ৬০-৭০ টাকা নিয়ে থাকে। ঢাকা মেডিকেলে আর কিডনি ইনস্টিটিউটে মনে হয় কোনো টাকা নেওয়া হয় না। তবে রোগীকে ওষুধ কিনতে হয়। এতেও প্রায় লাখ খানেক টাকা লেগে যায়।
মেডিভয়েস: এই কাজের সূচনা কিভাবে করলেন বা কবে থেকে?
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: আমি যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ, তৎকালীন পিজি হাসপাতাল) ইউরোলজিতে কাজ শুরু করি, তখন শুধু বঙ্গবন্ধুতেই কিডনি প্রতিস্থাপন করা হতো। আর কিডনি প্রতিস্থাপন বেশ কঠিন। অনেক সময় লাগে।
এরপর কিছু দিন ঢাকা মেডিকেলের রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করি, এরপর বরিশাল মেডিকেলে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করি। এরপর আমাকে জাতীয় কিডনি রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে পদায়ন করা হয়। কাঁধে দায়িত্ব পড়লো, এরপর মনে হলো কিডনি প্রতিস্থাপন আমাকে করতেই হবে। আর না হয় এই পদে থাকার কোনো মানেই হয় না। তখন মনে হলো, কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে আমাকে কাজ করতে হবে। এরপর এই বিষয়ে বইপত্র জোগাড় করা শুরু করলাম। আর পিজি হাসপাতালে থাকার সময় প্রায় ৫০টি কিডনি প্রতিস্থাপন দেখার সুযোগ হয়েছিল। এরপর ভাবলাম কোথায় যাওয়া যায়, আমার অত টাকা পয়সাও ছিল না, পার্শ্ববর্তী দেশেই ব্যাসিক ট্রান্সপ্লান্ট বিষয়ক প্রশিক্ষণের জন্য যাই। ২০০৪ সালে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পর মনে হলো, এখন আমি কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারবো। সমস্যা হয়ে যায়, সরকারি পর্যায়ে সহকারী অধ্যাপকদের জন্য কিডনি প্রতিস্থাপনে অনুমতি ছিল না। আর রোগী প্রস্তুতি করলে বঙ্গবন্ধু টিম এনে করতে হবে। অধ্যাপক ডা. সালাম স্যার, ডা. আব্দুল ওহাব স্যার—উনারা কিডনি ইনস্টিটিউটে এসে কাজ করে যেতেন।
মাঝে মাঝে মনে হতো কবে সহযোগী অধ্যাপক হবো, ততদিনে এই কাজটি ভুলেই যাবো। চিন্তা করতে থাকলাম কি করা যায়? মনে হলো, সরকারিতে যেহেতু করতে পারছি না, যেখানে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করি সেখানে করা যায় কিনা। এই চিন্তা ভাবনা থেকে সরকারি থেকে প্রাইভেটে আসার পরিকল্পনা শুরু করি। পরবর্তীতে একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করি, যেখানে প্রায় ৩০ জন রোগী সেবা নিতো। আর যেখানে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস করতে সেখানে দুটি ওটি ছিল, দুটিই আমরা ব্লক করে রাখতাম। আর প্রতি শুক্রবার সকালে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু করতাম, দুপুর পর্যন্ত লেগে যেত। আর প্রথম প্রতিস্থাপনটি ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত সময় লেগেছিল। প্রথমটিতেই সফল হয়েছিলাম। এরপর এই রোগী দ্বিতীয় রোগীকে নিয়ে আসলো। আবার দ্বিতীয় রোগী তিন নম্বর রোগী নিয়ে আসে। এভাবে চলতে থাকে। তবে খারাপ সময় যে যায়নি এমনটা নয়, খারাপ সময়ও গিয়েছে।
মেডিভয়েস: দেশের মানুষের চিকিৎসাসেবা নিয়ে আপনার পরিকল্পনা জানতে চাই?
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: স্বাস্থ্যখাত নিয়ে আমি ওভাবে কখনো চিন্তা করিনি। আমি সবসময় আমার কাজ নিয়ে চিন্তা করি। আমার কাজের ফলাফল সবচেয়ে ভালো হোক, সে বিষয় নিয়ে কাজ করি। আমি আমার কাজে সবসময় টেকনিক্যাল এডভান্টেজ নিয়ে আসার চেষ্টা করি, নতুন কি প্রযুক্তি আসলো সেগুলো যেন দেশেও থাকে, সেটা নিয়ে কাজ করছি। বিদেশে যা চলছে আমার দেশেও যেন তা শুরু হয়। বিদেশে লেজার চলছে আমার দেশেও যেন চলে। বিদেশে রোবট চলছে, আমার দেশেও যেন চলে।
আমি সবসময় আমার কাজে বিভোর থাকি। আমার ট্রান্সপ্ল্যান্ট নিয়ে স্পেশাল কাজ করতে হয়। দেখেন, একটা মেশিন আনতে অনেক টাকা লেগেছে, অনেক টাকা লোন নিতে হয়েছে। হয়তো এ টাকা উঠবেও না তারপরও আমি এটা নিয়ে এসেছি। কারণ এটা ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগীদের জন্য খুবই প্রয়োজন।
দেখুন, আমার কাজটা যাতে সবচেয়ে ভালোভাবে দেওয়া যায়, আমি সবসময় সে চিন্তা করি। আমি অত চাকচিক্য পছন্দ করি না, আমার হাসপাতাল বাইরে থেকে দেখতে অতটা সুন্দর না। তবে ভেতরে যে জিনিসগুলো আমরা ব্যবহার করি, তার বেশিরভাগই ইউরোপিয়ান স্টান্ডার্ট এবং খুবই উন্নত মানের। রেজাল্ট যেন সবচেয়ে ভালো হয় সেদিকে আমার প্রধান লক্ষ্য। আমার কাজটাকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই, যাতে বাইরের লোক এসে দেখার পর আমাদের মুখ রক্ষা হয়।
মেডিভয়েস: কিডনি প্রতিস্থাপনের সম্ভাবনার দ্বার কতটুকু খুলেছে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: কিডনি প্রতিস্থাপনে আমাদের দেশে যে আইন রয়েছে, এটা একটা ভালো আইন। এখনও আমাদের বাংলাদেশ বদনাম নেই। যেখানে কিডনি বেঁচাকেনা হয়। এ কারণেই আমরা ভালোভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে পারছি। আশপাশের দেশের মতো আমাদের দেশে অনৈতিক কোনো প্রতিস্থাপন হয় না।
আমরা যেটাতে সীমাবদ্ধতায় পড়ি, সেটা হলো আমরা এখনও মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়ে কাজ শুরু করতে পারিনি। যে রোগীগুলো আইসিইউতে মারা যাচ্ছে। সে রোগীর পরিবারকে সঠিক কাউন্সিলিং করা এবং অন্যান্য সলিড অর্গান নেওয়া হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট ইত্যাদি। আর যে রোগীগুলো আইসিইউতে মারা যাচ্ছে, তাদের মারা যাওয়ার পরও কয়েকটা অঙ্গ সচল থাকে। হার্ট, কিডনি ২৪ ঘণ্টার জন্য সচল রাখা যায়। এই সময়ের মধ্যে তাদের শরীর থেকে অঙ্গগুলো উঠিয়ে যাদের অঙ্গ বিকল রয়েছে তাদেরকে দেওয়া যায়। তাহলে তারা বেঁচে যাবে। আর ওই রোগীর বাহ্যিকভাবে কোনো ক্রটি দেখা দেয় না।
যে রোগীটা আইসিইউতে মারা গেছে বা ব্রেইন ডেথ টেস্ট দিয়ে শতভাগ নিশ্চিত করা যায়, রোগীটা মারা গেছে। কিন্তু তখনও তাঁর হার্ট চলছে, কিডনিটা ঠিক আছে। ওই অবস্থায় অনেক অর্গান মারা যাওয়া ব্যক্তির শরীর থেকে নিয়ে অন্য একটা রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা যায়। এটা এখনও আমরা করতে পারিনি। আমাদের আইনে বাধা নেই, কিন্তু আমরা এখনও কাজ করতে পারিনি। এটা সম্ভব হলে মারা যাওয়া ব্যক্তির অর্গান দিয়ে প্রায় ১৪ জন মানুষকে বাঁচানো সম্ভব। এ বিষয়ে অনেক চিকিৎসককে আগ্রহী হওয়াও দরকার। এতে কিডনি প্রতিস্থাপনটা আরও বেগবান হবে।
মেডিভয়েস: অনেক প্রতিষ্ঠানে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়, কিন্তু বলা চলে আপনার চেয়ে অনেক পিছিয়ে। কারণ কী?
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: আমি নিজেও এক সময় সরকারি হাসপাতালে চাকরি করতাম। জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউটে আমার শুরু এবং হাতেখড়ি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। সরকারি হাসপাতাল কিংবা অন্য যেকোনো হাসপাতালের কথা বলেন, যখন ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিষয়ে কথা হবে, তখন অন্য একটা কার্ডিয়াক সার্জারিও কিছুটা ব্যাহত হয়।
বড় সার্জারিগুলোতে লম্বা সময় ধরে আপনাকে থাকতে হবে। সেসব জায়গায় ডাক্তারদেরও লম্বা সময় ধরে থাকতে হবে। কিন্তু এই যে আমি হাসপাতালে ঢুকছি, ১২-১৪ ঘণ্টা হাসপাতালে থাকবো। এর ভেতরে ট্রান্সপ্ল্যান্ট যে দিন হয়, সেদিন হয়তো আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা ট্রান্সপ্ল্যান্টের জন্য ওটিকে থাকতে হয়। বাকি সময় আমি হাসপাতালেই অন্য কাজ করছি। হয়তো রোগী দেখছি, কিংবা অন্য কাজ করছি। এতে ট্রান্সপ্ল্যান্টের রোগী ১২-১৪ ঘণ্টা আমার পরিচর্যাতেই থাকছে।
কোনো একটা সমস্যা হলে এক মিনিটও লাগে না সেই রোগীর কাছে যেতে। কিন্তু আমি যখন সরকারি হাসপাতালে কাজ করেছি, তখন আমার কাজের সময় হলো ৬ ঘণ্টা। ৬ ঘণ্টা পর আমার চলে আসতে হয়, কারণ আমাকে প্রাইভেট প্রাকটিস করতে হবে। যেদিন ট্রান্সপ্ল্যান্ট থাকতো, সেদিন সকাল ৭টায় হাসপাতালে চলে যেতাম, ট্রান্সপ্ল্যান্ট শেষ হতে দুপুর আড়াইটা তিনটা বেজে যেত। শেষ করে চলে আসা যায় না, রোগী তো ফেলে আসা যাবে না।
আমাকে সন্ধ্যা ছয়টা-সাতটা পর্যন্ত হাসপাতালে থাকতে হয়, না হলে রোগীর কখন কি হয়, তা জানতে পারি না। তারপরও আমাকে সবসময় একটা দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়, যদি কল আসে তাহলে কীভাবে যাবো? আমার মনে হয়, হাসপাতালে বড় কাজ হবে সেখানে সার্জনের কমপক্ষে ১২ ঘণ্টা ডিউটি হতে হবে। তিনি হাসপাতালে অন্য কাজ করুন সমস্যা নেই, কিন্তু রোগীর নাগালেই থাকুন।
প্রথম দিকের ট্রান্সপ্ল্যান্টগুলোতে সারারাত হাসপাতালের চেম্বারে শুয়ে থাকতাম। কারণ রোগীর কখন কি হয় বলা যায় না। এই কারণে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা এতো লোড নিতে চান না। আর দ্বিতীয় কারণটা হচ্ছে, সপ্তাহে একটা ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে ডাক্তার যে বেতন পাচ্ছেন, তিনটা করলেও একই বেতন পাচ্ছেন। আবার বেশি কাজ করলেই যে পদোন্নতি হচ্ছে তাও না।
অনেক সময় সরকারি হাসপাতালে পদোন্নতি হয় রাজনৈকিভাবে। কাজেই এতো কাজ করে কেউ ঝুঁকি নিতে চান না। আবার সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে ভালো কাজ করতে গেলে বাঁধা আসে, ফলে কেউ ঝামেলায় পড়তে চান না। নিজস্ব হাসপাতালে রোগীর অনুমতিক্রমে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা যায়। আর বেসরকারি হাসপাতালে অনেক কাজ করা যায়, কারণ কেউ বাঁধা দেওয়ার থাকে না।
আবার সরকারি হাসপাতালে টিমওয়ার্ক ঠিক মতো হয় না। কিছু দিন পরপর এখানে বদলি হয়, নতুন যারা আসেন, তাদেরকে আবার নতুন করে শেখাতে হয়। কিন্তু আমার হাসপাতালে যারা কাজ করছেন, তাদের অধিকাংশই বিগত পনেরো বছর ধরে আমার সঙ্গে কাজ করছেন। কাজেই আমার সঙ্গে তাদের একটা ভালো বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গেছে এবং এর ফলও পাচ্ছি।
এই সুবিধা পেতে হলে সরকারি হাসপাতালের পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে। ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হবে, তার বেতন কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হবে। শক্তিশালী টিম গঠন করতে হবে এবং তাদের সেই পরিমাণ পারিশ্রমিক দিতে হবে। যারা সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার আছেন, তারা প্রাইভেট প্রাক্টিস করছেন, তাদের এই প্রাক্টিসটা হাসপাতালেই করার ব্যবস্থা করতে হবে। আবার যারা বেশি সার্জারি করবেন, তাদের একটা বেনিফিট থাকতে হবে। সেটা টাকার অংকে হোক কিংবা পদোন্নতির মাধ্যমে।
মেডিভয়েস: মানুষ দেশে ভালো চিকিৎসা না পেয়ে বিদেশ যাচ্ছেন, সীমবদ্ধতা কোথায়?
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: এ বিষয়ে আমার কথা বলা ঠিক হবে না। আর এতো তথ্যও আমার কাছে নেই। এটা কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে, কতজন বাইরে যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। আমাকে বলতে গেলে হয়তো অনুমান করে বলতে হবে। আমার কাছে মনে হয় মানুষের সামর্থ্য অনেক বেড়েছে। সক্ষমতার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। একটা বিয়ের বাজার বাংলাদেশ থেকে করা যায়, এখন শুনি অনেকে এজন্য বিদেশেও যায়। বিয়ে করতেও মানুষ বিদেশে যায়, জুতা সেন্ডেলও বিদেশ থেকে নিয়ে আসে। আমার ধারণা অনেকে বিলাসিতা করতেই বিদেশে যায়।
দেশে এখন আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে হার্ট সার্জারি, তারপরও মানুষ এ চিকিৎসায় বিদেশে যায়। আমাদের হয়তো কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা হয়তো সুন্দর করপোরেট ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারিনি। তবে চেষ্টা করলে আমরা আগামী দশ বছরে সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারবো। যেহেতু আমার হাসপাতালটা স্বল্পআয়ের এবং আমি এটা গরিব মানুষের জন্য করেছি, তাই যারা ধনাঢ্য পরিবারের তারা এখানে এসে খুব একটা সুখকর পরিবেশ পান না। সুন্দর লিফ্ট, সুন্দর কেবিন নেই। এসব বিষয় নিয়ে তাদের হয়তো কিছুটা অস্বস্তি থাকতে পারে।
কাজেই কেউ বিদেশ যাচ্ছে প্রয়োজনে, কেউ বিলাসিতার জন্য। জ্বর হয়েছে কাশি হয়েছে তিনিও বিদেশে যান, তাঁর হয়তো সামর্থ্য আছে, তাই বিদেশ যান। আবার প্রয়োজনেও অনেকে বিদেশে যান। দেশে নাই এমন চিকিৎসার জন্যও অনেকে বিদেশে যান। যদিও এখন এমনটা খুবই কম, এখন করপোরেট হাসপাতালগুলোতে অনেক অপারেশনই করা হয়।
মেডিভয়েস: আপনার নিজের কর্মকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম: আমার লক্ষ্য হলো, যে কাজই করি তার মাধ্যমে মানুষকে সেবা প্রদান করা। আন্তরিকতার সাথে সেরাটা প্রদান করার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। আর সেবা প্রদানের টার্গেট হবে সর্বাধিক এবং সুন্দরভাবে সেবাদান করবো। আমার লক্ষও এমনই। কাজটা সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারলে আমি সন্তুষ্টি পাই। সম্পন্ন না হলে সেটাকে লক্ষ্যে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করি। আমি যত কিডনি প্রতিস্থাপন করেছি, তার সফলতার হারই বেশি। এই সাফল্য আমার কর্মের মূল্যায়নের নির্ণায়ক। কোনো কোনো বছর ৯৪ শতাংশ আবার কোনো বছর সফলতার হার থাকে ৯৬ শতাংশ। ১০০ জন রোগীর মধ্যে পাঁচ-ছয়টা রোগী খারাপ হয়।
আমার কথা হলো, যে যেই কাজটাই করবে সেখানে সবচেয়ে ভালো করতে হবে। সেই সঙ্গে কিছু মানবিকতা যুক্ত থাকতে হবে। ধরেন, এখানে আমি ফ্রি, মাঝামাঝি নাকি উচ্চমূল্যে কাজ করবো, এটা আমার নিজস্ব বিষয়। আমাদের দেশের অধিকাংশ রোগী গরিব। আমি যদি মূল্য কম নির্ধারণ করি, সেখানে মানবিকতা যুক্ত থাকবে। কোনো বিষয়ে মূল্য না নিলেও মানবিকতা হবে। যার মধ্যে মানবিকতা নেই, তাকে কেউ স্মরণ করে না।
ধরেন, হাজী মোহাম্মদ মহসীন অনেক ধনাট্য ব্যক্তি ছিলেন। তার সময়ে আরও অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি ছিলেন, আমরা তাদেরকে স্মরণ করি না কিংবা নামও জানি না। আর আমরা হাজা মহসীনকে স্মরণ করি, এই কারণে তার সমৃদ্ধি শুধু নিজের জন্য ছিল না। তিনি সমাজের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন এবং মানবিকতা প্রদর্শন করেছেন। কর্মের সাথে মানবিকতা থাকলে সবাই আমাকে স্মরণে রাখবে।
অনেকেই জানতে চান, কিডনি প্রতিস্থাপনে টাকা না নিলে আমি কিভাবে চলি? সিকেডি হাসপাতাল একটি প্রতিষ্ঠান। এখানে যে শুধু কিডনি প্রতিস্থাপন হয়, তা নয়। এখানে প্রচুর স্ক্রোল সার্জারি হচ্ছে, এই হাসপাতালে প্রায় ১২ হাজারে উপরে কিডনি স্ক্রোল সার্জারি হয়েছে। ফুটো করে, লেজার করে ও ল্যাপরোস্কপি করে কিডনির পাথর নিয়ে আসি। এখানে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার ক্রাশ হয়েছে। প্রচুর প্রোসের সার্জারি হচ্ছে, ক্যান্সার সার্জারি হচ্ছে, এগুলোতে টাকা নেওয়া হয়। যদিও করপোরেট হাসপাতালের মতো করে নেই না। অল্প করে নেই, যার একটি অংশ আমি ট্রান্সপ্ল্যান্ট খাতে খরচ করি। এভাবে সফলতা আর মানবিকতা মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই।
এমইউ
-
৩০ এপ্রিল, ২০২৩
-
১৫ মার্চ, ২০২৩
-
১৯ জানুয়ারী, ২০২৩
-
১৮ অক্টোবর, ২০২২
-
৩১ মে, ২০২২
-
১৪ নভেম্বর, ২০২১
-
২১ অক্টোবর, ২০২১