জীবন বাঁচিয়ে দেয় মৃত্যু
আজ ইব্রাহিমের মৃত্যুর এক বছর পূর্ণ হলো। কবর জেয়ারত করতে গিয়ে দেখলাম, ওর কবরের উপর ফুল গাছটা ওর সমান হয়ে গেছে। পুরো ঘর মাতিয়ে রাখা বাচ্চাটার কবর একেবারেই নিস্তব্ধ হয়ে আছে।
গত এক বছর আগে হঠাৎ একদিন ইব্রাহিমের খুব জ্বর আসলো। চার দিন ধরে জ্বর, সামান্য চোখ ফুলে আছে, পেটটা ও বোধ হয় একটু ফুলা ফুলা। ডায়াগনোস্টিকে টেস্ট করিয়ে দেখলাম, প্লাটিলেট নেমে গেছে আট হাজারে মাত্র।
ভেবেছিলাম, ডেঙ্গু জ্বর হবে হয়তো। ছুটে গেলাম ঢাকায়; পাল্টে যায় ধারণা। ডাক্তাররা অনুমান করে বসলো, ইব্রাহিমের ব্লাড ক্যান্সার।
চারদিন পর টেস্টের রিপোর্ট হাতে পেলাম, একুয়েট লিউকোমিয়া হয়েছে অর্থাৎ ব্লাড ক্যান্সারই।
শুরু হলো অচেনা-অজানা এক কেমোথেরাপির চক্র। দু'বছর ন'মাস বয়সের এই বাচ্চার শরীরে যেতে থাকে বিষাক্ত কেমো।
ইব্রাহিম কান্না করে, চেঁচামেচি করে, চিৎকার দেয়, খেতে চায় না, সেলাইন ইঞ্জেকশনে চলে খুব নিষেধাজ্ঞা আর তার মুখে ভরতি বিরক্তির চাপ।
তবুও মাঝেমাঝে অভিমান ভেঙে বলে, মামা! বারান্দায় যাবো।
বারান্দায় গিয়ে বৃষ্টি দেখি, জোরে জোরে বাজ পড়ে, বিদ্যুৎ ও চমকায়। কিন্তু সে আর এখন এইগুলোতে ভয় পায় না। তার সমস্ত ভয় এখন ইঞ্জেকশন, সেলাইন আর রক্ত দেওয়া-নেওয়াতে।
ওই বারান্দা দিয়ে খুব কাছ থেকে বুড়িগঙ্গা নদীও দেখা যায়। মানুষ নৌকায় করে এপার-ওপার যায়। আর আমরা ভাবি, কবে সুস্থ হয়ে বাড়ি যাবো।
তখন ইব্রাহিমকে জিজ্ঞেস করি, বাড়ি যাবা?
সে বলে, না; এইখানেই থাকবো।
তাকে বলি, আল্লাহ'কে বলো, আল্লাহ আমাকে সুস্থ করে দেন।
সে বলে- না' আমি বলবো না।
মৃত্যু কাছাকাছি আসলে মানুষ তীব্র অভিমান করে। ইব্রাহিমও করতো।
এইভাবে হাসপাতালে কেটে গেলো পঁয়তাল্লিশ দিন!
প্রথম ধাপের তিনটা কেমো কমপ্লিট হয়েছে, দুটো আছে এখনো বাকি। আর দশ দিন গেলেই আমরা ছুটি পাবো। কিন্তু ইব্রাহিম খুব বেশি ভালো নেই।
তৃতীয় কেমোথেরাপি দেয়ার পর থেকেই ইব্রাহিম পেট ব্যথা পেট ব্যথা বলে চিৎকার দেয়। সেটার জন্য বাড়তি ওষুধও চলছে।
রাত একটায় ইব্রাহিমের বায়না, আবারো বারান্দায় যাবে। রাত নয়টায় ও একবার গিয়েছে আমার সাথে। একদম নিরিবিলি রাত; ইব্রাহিমও নিরব হয়ে আছে।
তাকে আমি বলি, আল্লাহকে বলো- আল্লাহ আমাকে সুস্থ করে দেন।
সে আবার বললো- না, আমি বলবো না, আমি সুস্থ হবো না।
আমার খুব দুঃখ হতে লাগলো। মনে হলো, সে এই সব কিছু জেনে-শুনেই বলছে। কিছুক্ষণ পর রুমে চলে গেলাম। সামান্য পর পর কান্না করছে আর মুখে বলছে পেট ব্যথা।
রাত দুইটা বাজলো। ইব্রাহিম ওর আম্মুকে বলছে, আম্মু তোমার হাত কই? হাত দিয়ে আমাকে ধরো।
ওর আম্মু ওকে ওভাবেই ধরে ঘুমালো।
রাত সাড়ে তিনটা! ওর আম্মুর গলায় জোরে জোরে দুইবার ইব্রাহিম, এই ইব্রাহিম শুনলাম। উঠে জলদি লাইট দিয়ে দেখি ইব্রাহিমের মুখ থেকে লালা পড়ছে আর চোখ দুটো দাড় করিয়ে রেখেছে। শরীরে বিলকুল নড়াচড়া নেই।
আমি ওভাবেই ইব্রাহিমকে কোলে নিয়ে আপুর হাত ধরে বললাম, ওকে এখুনি ইমারজেন্সি নিয়ে যেতে হবে।
আপুর শরীর ছেড়ে দিয়েছে, আমি আন্দাজ করতে পারছিলাম। কিন্তু আমি চাইছিলাম না যে, আপু এই সময়ে জ্ঞান হারিয়ে না ফেলে। কিন্তু সেটাই হলো!
আমার হাতের উপর দিয়ে আপু মেঝেতে শুয়ে পড়লো।
ডান কাঁধের উপর নিলাম ইব্রাহিমকে, বাম হাতে অজ্ঞান আপু। আমার চোখ বন্ধ হলে ওই মুহূর্তটা এখনো ভেসে উঠে।
ওই রাতেই ইব্রাহিমের ব্রেন স্ট্রোক হয়ে যায়। সেই রাতের পর ইব্রাহিমের আর জ্ঞান ফিরেনি। দুই দিন অচেতন অবস্থায়ই ধীরে ধীরে তার নিঃশ্বাস নেমে যায় শূন্যের কোটায়।
আমরা তখনো হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটতে থাকি তাকে নিয়ে বাঁচানোর জন্য; কিন্তু তার প্রচণ্ড যন্ত্রণার অভিমান আর স্রষ্টার ডাক মেলতে দেয়নি তার চোখ একবারের জন্যও।
ইব্রাহিম আমাদের জন্য একটা পরীক্ষা ও শিক্ষা ছিল। তার শেষ কষ্টের জীবনকে একমাত্র মৃত্যুই পেরেছে বাঁচিয়ে দিয়ে যেতে।
সৃষ্টিকর্তা তাকে জান্নাতে বহুগুণ ভালো রাখুক এবং জান্নাতেই তার বাবা-মায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখুক।
আমার যেসকল বন্ধু ও প্রিয়জনদের দ্বারা ইব্রাহিমের জন্য ১৩ ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা হয়েছে, বিশেষ করে তাদের পরিবার-পরিজনকে সৃষ্টিকর্তা এমন কঠিন রোগ থেকে হেফাজত করুক। (আমিন)