২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০৮:৪০ পিএম

‘বাবা-মা রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় হলে বাচ্চা বধির হতে পারে’

‘বাবা-মা রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় হলে বাচ্চা বধির হতে পারে’
জন্মগত বধির এক শিশুকে ইশারায় ভাষা শেখাচ্ছেন তার স্বজন। ছবি: সংগৃহীত

সাখাওয়াত হোসাইন: ভোলা জেলার বাসিন্দা শাকিল আহমেদ। তিনি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আকিব, সামিয়া, আরাফাত ও নাহিদ নামের চার সন্তানের জনক। নাহিদের বয়স এখন ছয় বছর। অন্যান্য শিশুদের মতো তার মধ্যে নেই চাঞ্চল্য। ঠিকমত সে কথাবার্তা বলতে পারে না। কারণ জন্মগতভাবে কানে শুনতে পান না।

জানতে চাইলে শাকিল আহমেদ মেডিভয়েসকে বলেন, চার-পাঁচ মাস বয়স থেকে অন্যান্য শিশুরা যেমন বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে, নাহিদ তেমন কথা বলতো না, আমরা ভেবেছিলাম আরও কয়েক মাস পর থেকে সে কথা শুরু করবে। এরপর যখন দেড় বছর পেরিয়ে গেল, তখনও কথা বলা শুরু করলো না। তখন চিকিৎকের কাছে নেওয়া হলে তিনি জানান, নাহিদ জন্মগতভাবে বধির। আমরা ভেবেছিলাম, জন্মগত বধিরতার কোনো চিকিৎসা নেই। এজন্য উন্নত চিকিৎসার জন্য আর কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়নি।

তিনি আরও বলেন, এরপর থেকে দিন যত যায় আমাদের জ্বালা-যন্ত্রণা তত বাড়তে থাকে। কারণ সে খাওয়া-দাওয়া কখন কি করবে কিছুই বলতে পারে না। তাকে ইশারা দিয়ে সব কিছু করানো লাগে। পরিবারের সবাই মিলে তাঁর সেবা করা লাগে।

বধিরতা কেন?

নানাবিধ কারণে একজন মানুষ কম শুনতে পারে বা বধির হতে পারে। এর মধ্যে বহিঃকর্ণের কিছু রোগ, উচ্চ-আওয়াজে গান না শোনা, মধ্যকর্ণের প্রদাহ, কান পাকা রোগ, আঘাতজনিত সমস্যা, উচ্চমাত্রার শব্দ, রক্তজনিত সমস্যা, বয়সজনিত, কর্মক্ষেত্রের শব্দদূষণের মাত্রা বেশি, ব্রেনের রোগ এবং জন্মগতসহ কারণে বধিরতার সৃষ্ট হয়।

জন্মগত বধিরতার কারণ জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কর্মসূচি পরিচালক ও নাক-কান-গলা (ইএনটি) বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম জহুরুল হক মেডিভয়েসকে বলেন, ‘মায়ের কিছু রোগের কারণে গর্ভস্থিত বাচ্চা বধির হতে পারে। গর্ভাবস্থায় মা রুবেলা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে, মা অপুষ্টিতে ভুগলে বাচ্চা গর্ভের শিশুও বধির হতে পারে। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় অথবা জন্মের পর মায়ের বিভিন্ন ওষুধ সেবনেও শিশুর বধিরতা হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, মায়ের কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে বাচ্চা প্রসবের সময় জন্মগতভাবে শিশু বধির হতে পারে। প্রসবের সময়কাল দীর্ঘ হলেও বাচ্চা বধির হতে পারে। জন্ম নেওয়ার সময় আঘাতপ্রাপ্ত হলে। জন্ম পরবর্তী সময়ে বাচ্চার গারো জন্ডিস বা ম্যারিন জাইটিস—এসব কারণে বধির হতে পারে। এছাড়া বাবা-মা কাছের বা রক্ত সর্ম্পকীয় আত্মীয় হলে বাচ্চা বধির হতে পারে।

বধিরতার সংজ্ঞা

বধিরতা মানে হলো, না শোনা বা কম শোনা। কম শোনার মাত্রা নির্দিষ্ট পর্যায়ে গেলে একজন ব্যক্তিকে বধির হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। সে অনুযায়ী তার সঙ্গে সহায়ক ব্যবহার করতে হবে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জহুরুল হক বলেন, ‘যে কম শোনাটা দৈনন্দিন জীবনে কাজ করতে বাধাগ্রস্ত করে, সেটাকে বধিরতা বলা হয়।’

বাচ্চাদের বধিরতা বোঝার উপায়

অধ্যাপক ডা. জহুরুল হক বলেন, চার-পাঁচ মাস বয়স থেকে বাচ্চাদের কথা তৈরি হয়। ওই সময় তারা বাবলিং সাউন্ড করে এবং দু বা একটি শব্দ করে বাবা, মা, দাদা, বলে। পর্যায়ক্রমে এক বছরের গিয়ে বাচ্চারা দু বা চারটা শব্দ বলতে পারে। তার পরে সে তার প্রয়োজনীয় শব্দগুলো উচ্চারণ করতে থাকে। কষ্ট বা ক্ষুধার কথা ভালো লাগার কথাগুলো বলতে থাকে। এগুলো বাচ্চার মা একটু মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে সহজেই বুঝতে পারেন। আর বাচ্চার এক বছর বয়সের আগেই মা যখন বুঝতে পারেন, তার বাচ্চা ভালো শুনছে না। সে জন্য বাচ্চার মা যখনই মনে করবেন তার বাচ্চা ভালো শুনছে না। তখনই বাচ্চাকে নিয়ে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে সামাজিক কুসংস্কার রয়েছে, কোনো বাচ্চা কম শুনলে বা কথা না বলতে পারলে কোনো মুরব্বিকে জানালে, তখন তারা বলে অনেক বাচ্চা একটু দেরিতে কথা বলে। এসব কারণে বধিরতা জটিল পর্যায়ে চলে যেতে পারে। বাচ্চাকে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে কানে শুনানোর ব্যবস্থা করতে না পারলে বাচ্চার স্কিল ডেভেলমেন্ট করা যাবে না। তবে যেসব শিশু জন্মগত বধির, তাদেরকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে বাচ্চাকে ককলিয়ার ইমপ্যান্ট করা হয়। এতে বাচ্চা আস্তে আস্তে কথা বলতে পারে। পাঁচ বছরের বেশি হয়ে গেলে অনেক সময় ককলিয়ার ইমপ্যান্ট করেও বাচ্চা কথা বলানো সম্ভব হয় না।’

বধিরতার চিকিৎসা এবং খরচ

চিকিৎসার মাধ্যমে জন্মগতসহ যেকোনো বধিরতা থেকে সুস্থ হওয়া সম্ভব জানিয়ে অধ্যাপক ডা. জহুরুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশ অনেক এগিয়ে গেছে। জন্মগত বধিরদের কথা শোনানোর জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ২০১০ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রোগ্রাম হাতে নেওয়া হয়েছে। যেটা ‘ককলিয়ার ইমপ্লান্ট’ নামে পরিচিত। এটি সর্বপ্রথম বিএসএমএমইউতে শুরু হয়। এ প্রোগ্রামের অধীন গত ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৬৩ জনের কানে অপারেশন করে ওই ধরনের যন্ত্র বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আরও চারটি জায়গায় সরকারিভাবে এ ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়। ককলিয়ার ইমপ্লান্টের মাধ্যমে জন্ম বধির শিশুরা কথা বলতে পারছে, শুনতে পারছে, খেলাধূলা করতে পারছে এবং স্কুলে যেতে পারছে। সামাজিকভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারছে।’

তিনি আরও বলেন, করোনাকালীন সময়েও ১০০ জন শিশুর ইনার এয়ারে ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট বসানো হয়েছে। তার পরবর্তীতে এদের থেরাপিও চলছে।

সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালে বধিরতার চিকিৎসার খরচ তুলে ধরে অধ্যাপক জহুরুল বলেন, সরকারিভাবে বধিরতার চিকিৎসায় ৯৯ ভাগ তহবিল থেকে দেওয়া হয়। কানের চিকিৎসায় যে ইনারিয়ার ডিভাইস স্থাপন করা হয়, এটি বিশ্বের মাত্র চারটি কোম্পানি উৎপাদন করে। আমাদের দেশে তিনটি কোম্পানির ডিভাইস পাওয়া যায়। এছাড়া বেসরকারিভাবে বধিরতার চিকিৎসা করাতে প্রায় ৬-১৬ লাখ টাকা পর্যন্ত লাগে।

প্রাপ্ত বয়সে কোনো কারণে বধিরতায় আক্রান্তদের চিকিৎসা খরচ কম এবং সহজ বলে জানান তিনি।

বধিরতা রোধে করণীয়

বধিরতা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য অভিশাপ এবং বধিরতা রোধে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. জহুরুল হক বলেন, যেসব কারণে মানুষ বধির হয়, এ জাতীয় সব কিছু থেকে বিরত থাকতে হবে। কলকারখানা এবং ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করেন, তাদের মাঝে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিশুদের শ্রবণক্ষমতা স্ক্রিনিং কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। হিয়ারিং ডিভাইস এবং থেরাপি সহজলভ্য করতে হবে। কানে সমস্যা হলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে। অটোটক্সিক ওষুধের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

সামাজিকভাবে বধিরতা বন্ধে সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি আরও বলেন, যেকোনো বড় ধরনের রোগ শুধুমাত্র চিকিৎসার মাধ্যমে রোধ সম্ভব নয়। এর সাথে সাথে সামাজিক আন্দোলনও প্রয়োজন। এর অংশ হিসেবে বধিরতা সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা প্রয়োজন। কারণ বধিরতা এমন একটা রোগ যেটা কখনও দেখা যায় না। একটা লোক পঙ্গু বা অন্ধ হলে মানুষ দেখে বুঝতে পারে। কিন্তু একটা লোক বধিরতার কারণে তিনি কথাও বলতে পারছেন না। এটা দেখে বের করা যায় না। বধিরতা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হুমকি স্বরূপ।

কত লোক বধিরতায় আক্রান্ত?

জাতীয় এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯.৬ শতাংশ মানুষ বধিরতায় ভোগেন। বিভিন্ন মাধ্যমে সৃষ্ট শব্দ দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষ মৃদু থেকে প্রকট মাত্রায় বধিরতায় ভুগছেন। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশু ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৬২৯ জন। প্রতি লাখ শিশুর মধ্যে চার হাজার ৭৪২ জন কানের কোনো না কোনো সমস্যায় ভুগছে।

এ দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় শতকরা ৫ শতাংশ অর্থাৎ ৪৬ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের অক্ষমতা সৃষ্টিকারী বধিরতার কারণে শ্রবণহীনতায় ভুগছেন। এর মধ্যে ৪২ দশমিক ৮ কোটি (৪২ কোটি ৮ লাখ) প্রাপ্তবয়স্ক ও ১৫ বছরের নিচে ২ দশমিক ৩ কোটি (২ কোটি ৩ লাখ) শিশু রয়েছে। এছাড়া চিত্তবিনোদনজনিত কারণে ১২ থেকে ৩৫ বছর বয়সি ১ দশমিক ১ বিলিয়ন অর্থাৎ ১১০ কোটি মানুষ শব্দ দূষণের শিকার হচ্ছেন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় ৯০ কোটি মানুষ বিভিন্ন বধিরতাজনিত সমস্যায় ভুগবেন।

 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
‘ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ অনুসন্ধান করুন’

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের গালমন্দ নয়: প্রধানমন্ত্রী

‘ছেলেরা কেন পিছিয়ে, কারণ অনুসন্ধান করুন’

অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের গালমন্দ নয়: প্রধানমন্ত্রী

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক