অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক
স্কিন অ্যান্ড সেক্সুয়াল মেডিসিন স্পেশালিস্ট
এফসিপিএস, এফআরসিপি (যুক্তরাজ্য), ডিডিভি (অস্ট্রিয়া)
২৫ এপ্রিল, ২০২১ ১০:৪২ পিএম
করোনাকালে বয়ে যাক সৌহার্দ্যের হাওয়া
চরম বিপদে ফায়র সার্ভিস কর্মীদের আত্মত্যাগ আমরা টেলিভিশনে দেখতে দেখতে শ্রদ্ধায় অন্তর ভরে যায়। কিছু দিন আগে সেই টেলিভিশনেই, এক বাস হাইওয়ের পাশের খাদে পড়ে ডুবে যেতে থাকলে, শত নিথর দর্শকের মধ্যে এক তরুণ পুলিশ কনস্টেবলকে সাত-পাঁচ বিবেচনার আগেই সেই ডোবায় ঝাপ দিতে দেখেন দেশের অগনিত মানুষ। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দলবদ্ধ মানুষেরা উদ্ধার কাজে নামেন এবং সকলকে রক্ষা করেন।
ঢাকা মেডিকেলে একজন নিউরোসার্জন যখন একইভাবে সাত বা আট ঘন্টা দাঁড়িয়ে নাওয়া-খাওয়া ছাড়া দিনের পর দিন মাথায় কোপ খাওয়া অচেনা রোগীকে নিস্বার্থভাবে সেবা ও সম্পুর্ন বিনামূল্যে অপরেশন করেন। তারাও অন্তর থেকে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেন।
বতর্মান পুলিশ প্রধান অনেক শিক্ষিত মানুষ। আমাদের এক আন্তর্জাতিক স্ক্রিন সার্জারির অনুষ্ঠানে সরকারের বড় মন্ত্রীর সঙ্গে তিনি এক কৃতজ্ঞ রোগী হয়ে আসেন। তিনি বিউটি ফিকেশন নিয়ে খুবই চমৎকার এক প্রস্তুতিহীন বক্তৃতা করেন হোটেল লা মেরিডিয়ানে। অ্যাসথেটিক ডার্মাটোলজি সোসাইটির পক্ষে আমার জন্যে নির্ধারিত একটি ক্রেস্টও আমাকে প্রদান করেন।
গতকাল সারারাত কাজ করে বাড়ি ফেরার পথে করোনার একজন বড় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় কাওরান বাজারে। চরম বিব্রত ডাক্তার সাহেব পাঁচ থেকে সাত মাইল হেঁটে বাসায় যান। এটা ছিল এক হৃদয়বিদারক ঘটনা।
চিকিৎসক সারাটা রাত এক অতিরিক্ত খারাপ হয়ে পড়া তাঁর অজানা অচেনা, এক রোগীকে বাঁচাবার জন্য লড়াই করতে করতে ভোর করে ফেলেছিলেন। ট্রাফিক তাঁর কোনো কথা শুনতে চায় নি। একটা অ্যাম্বুল্যান্স থেকে কোনো চিকিৎসককে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীর কোনো দেশে সম্ভবত এই প্রথম জানলাম।
প্রায় ১৫০ জনের বেশি মেধাবী চিকিৎসক প্রাণ দিয়েছেন। একমাত্র জনগণের জন্যে ডেডিকেটেড চিকিৎসা করতে গিয়ে। বিনিময়ে কিছুই তাঁরা পাননি। পরিবারও আর্থিক অনুদান পায়নি।
এখন দেশে করোনা বিষয়ক ক্রিটিক্যাল বিশেষজ্ঞের অভাব। কারণ এদের বিপুল অংশ চিকিৎসাকালে নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। এ ত্যাগ তুলনাহীন। পুলিশ প্রধান সকলের আস্থার প্রতীক। আমি মনেকরি তাঁর আজান্তেই চিকিৎসকদের এমন অশ্রুতিপুর্ন বিড়ম্বনা হচ্ছে। আর এসবে সরকারের ভাবমূর্তির নিদারুণ ক্ষতি অবধারিত।
প্রত্যাশা করি চিকিৎসক ও তাঁর গাড়ি চালকদের যেন স্বচ্ছন্দে কাজ করার আদেশ নিম্নস্থরে যথার্থভাবে পৌছাবে। যেন সকল কাগজপত্র থাকা শর্তেও সম্পূর্ন ইচ্ছাকৃতভাবে একজন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে বিড়ম্বনার ঘটনা আর না ঘটে।
মুক্তিযুদ্ধে রাজারবাগে এই পুলিশেরই পূর্বপুরুষেরা দ্বিধাহীনভাবে নিজ জীবনের তোয়াক্বা না করে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। সেই তাঁরা একজন জীবন উৎর্সগ করা বীর বিক্রম-কন্যাকে গেজেটের প্রথম শ্রেনীর (চিকিৎসককে প্রদত্ত) অধিকার ভঙ্গ করে ইচ্ছকৃত ভাবে ‘মুভমেন্ট পাস’ দেখতে চেয়েছেন। অশ্নীল মন্তব্য করছেন।
পুলিশ কি বুঝেন না, এই ভীতিকর সময়ে একজন মহিলা চিকিৎসক সন্তানদের বাসায় রেখে কেন হাসপাতালে যান? তিনি আপনার-আমার মা-বাবা, প্রিয় সন্তানকেই চিকিৎসা দিতে যাচ্ছেন। পুলিশের কি কর্তব্য নয়, চিকিৎসকদের বাধার বদলে, শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর পথ সুগম করা?
আমার কন্যা ইউনাইটেড হাসপাতালে করোনা বিভাগের স্পেশালিস্ট। সে জানালো এই মাত্র সে পুলিশের সদ্য সাবেক আইজি বা অ্যাডিশনাল আইজি জনাব খোদা বকসসহ অসুস্থ রোগীদের সারারাত জেগে চিকিৎসা প্রদান ও নজরদারী করে সকালে বাসায় ফিরল। তাঁর বাচ্চারা সবাই খুব ছোট। সপ্তাহের তিন রাত সে মুহূর্তের জন্য চোখ বুজতে পারে না। আর করোনায় আক্রান্ত হবার ভয় তো থাকলই।
আসার পথে সে পুলিশের ফাঁড়িতে পড়ে। একজন পুলিশ ইনস্পেক্টর তাঁকে দেখে ও তাঁর পরিচয়পত্র দেখে তাৎক্ষণিক ছেড়ে দেন এবং কোভিড থেকে সাবধানে থাকার আন্তরিক উপদেশ দেন। সে খুব আপ্লুত বোধ করে। ভাবি বিচিত্র পৃথিবীতে কত মন্দ ও ভালোর সমাবেশ।