১১ মার্চ, ২০২১ ১২:০৪ এএম

কিডনি রোগীদের যত দুর্ভোগ, করণীয় নিয়ে কী ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা?

কিডনি রোগীদের যত দুর্ভোগ, করণীয় নিয়ে কী ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা?
ছবি: সংগৃহীত

সাখাওয়াত হোসাইন: রাজধানী ডেমরার বাসিন্দা মো. শরিফুল ইসলাম। পেশায় শিক্ষক। বয়স ৬১ বছর। মাত্র কয়েক মাস হলো অবসরগ্রহণ করেছেন তিনি। যৌবনকাল থেকে তাঁর ইচ্ছা দেশ-বিদেশে ঘুরে ঘুরে অবসর সময় কাটাবেন। ইদানিং তাঁর শরীরে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাঁর খাওয়ায় অরুচি, বমি বমি ভাব এখন নিত্য দিনের সঙ্গী। এজন্য তিনি পরামর্শ করেন রাজধানীর একটি হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কাজল ইসলামের সাথে। ডা. কাজল তাঁকে কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে বলেন। তিনি ডা. কাজলের পরামর্শ অনুযায়ী সায়েদাবাদের আল কারিম হাসপাতালে কিডনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখান। তাঁকে বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা  দেওয়া হয়েছে।

পরীক্ষায় ধরা পড়লো তার দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। পরে তাকে দশদিন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে রাখা হয়। এরপর তার শরীরের অবস্থা একটু উন্নতি হয়। তবে এখন তিনি স্বাভাবিকভাবে হাটা চলা করতে পারছেন না। চিকিৎসক তাকে পরামর্শ দিয়েছে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হবে অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো বা কিডনি প্রতিস্থাপন করাতে হবে। কিছুদিন পর তার কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার একবছর পূর্ণ হবে।

চাকরি জীবনে যত টাকা কামিয়েছেন এখন বাবার কাছ থেকে পাওয়া বাড়ি ছাড়া সব কিছু চিকিৎসার পেছনে খরচ হয়ে গেছে জানান শরিফুল। নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরতে গিয়ে শরিফুল ইসলাম মেডিভয়েসকে বলেন, ‘কিডনি রোগ আমার টাহা পইসা সব নিয়া গেছে।’

তিনি বলেন, ‘ডায়ালাইসিস করাতে মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার মত খরচ হয়। চিকিৎসার পেছনে সব টাহা শেষ হয়েছে। আর কিডনি প্রতিস্থাপন করতে ৬ লাখ টাকার মত প্রয়োজন; এখন এত টাহা জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার দুই ছেলের বড়জন ইঞ্জিনিয়ার আমার চিকিৎসা খরচ আর সংসার চালাতে খুব কষ্ট হয়। আগামীর প্রত্যেকটা দিন যেন বিভীষিকাময় মুহূর্ত।’

কিডনি রোগীদের চিকিৎসা

এ রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। দেশে এ ধরনের রোগীর জন্য মাত্র দুরকম চিকিৎসা পদ্ধতি চালু রয়েছে। ডায়ালাইসিস অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো।  দ্বিতীয় পদ্ধতি হলো- কিডনি প্রতিস্থাপন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি-বেসরকারি ৪৩টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হয়। আর সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।

দেশের কিডনি রোগীর ১০ ভাগকে সরকারিভাবে ডায়ালাইসিস দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে বিএসএমএমইউর প্রোভিসি (প্রশাসন) ও কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মুহম্মদ রফিকুল আলম মেডিভয়েসকে বলেন, প্রাথমিক ভাবে কিডনি রোগ শনাক্ত করা গেলে এ রোগের চিকিৎসা দেওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। অসচেতনতার কারণে দিন দিন কিডনি রোগীর বেড়ে যাচ্ছে। সাত থেকে আট ভাগ রোগী চিকিৎসার অভাবে ঝরে পড়ে যায়।

রোগীর পক্ষে একা এ রোগের চিকিৎসা খরচ বহন করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মুহম্মদ রফিকুল আলম বলেন, ‘বিভিন্ন দেশে এ রোগের চিকিৎসার জন্য বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসে। বিশ্বের অনেক দেশে স্বাস্থ্যবীমা চালু রয়েছে। এ রোগের সেবা দেওয়ার জন্য প্রাইভেট সেক্টর বা অন্যান্য এনজিওগুলো এগিয়ে আসা প্রয়োজন।  আর দেশে সরকারিভাবে সব কিডনি রোগীদের সেবা দেওয়া সম্ভব নয়’।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মেডিভয়েসকে বলেন, ‘এই রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল, সবাই সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। এই রোগের চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে ফ্রি চিকিৎসা ব্যবস্থাসহ রোগীর খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।  রোগীরা এই রোগের চিকিৎসা খরচ বহন করতে পারে না। সরকার যতদিন এ চিকিৎসার দায়ভার গ্রহণ না করবে ততদিন মৃত্যুর মিছিল ভারি হতেই থাকবে।’

চিকিৎসা খরচ

কিডনি অকেজো হওয়া একজন রোগীকে সপ্তাহে দুই বা তিনবার পর্যন্ত ডায়ালাইসিস করাতে হয়। একবার ডায়ালাইসিস করাতে সরকার নির্ধারিত ফি ২২০০ টাকা। আর বিএসএমএমইউতে প্যাকেজ প্রোগ্রামের মাধ্যমে এক লাখ ৬০ হাজার টাকায় কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায়।

কিডনি রোগীর পরিসংখ্যান

দেশের বেসরকারি কিডনি জরিপ সংস্থা ‘কিডনি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ‘দেশে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি কোনো না কোনো কিডনি জটিলতায় ভুগছেন৷ আর আক্রান্তদের মধ্যে ৪০ হাজারের কিডনি পুরোপুরি অকেজো হচ্ছে প্রতিবছর। ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগী চিকিৎসা সুবিধা পায়। আর কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা দেড়শ জনেরও কম৷’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পৃথিবীতে অসংক্রামক রোগের যে মৃত্যুহার, তার মধ্যে কিডনি রোগের অবস্থান ১১তম। বিশ্বের প্রায় ৮৫ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের কিডনি রোগে আক্রান্ত। প্রতি বছর ২৪ লাখ মানুষ কিডনি ডিজিজ বা দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। আর প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ লোক আকস্মিক কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে ১৭ লাখ রোগী অকালে মৃত্যুবরণ করেন।

কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপায়

কিডনি রোগীদের প্রধান অংশই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অনিয়ন্ত্রিত ও দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস কিডনি বিকলের অন্যতম কারণ। অধ্যাপক রফিকুল আলম বলেন, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের রোগ ধরা পড়ার সময় থেকেই সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশে কিডনি রোগী বাড়ার পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে৷ তার মধ্যে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, খাদ্যে ভেজাল ও ব্যাথানাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার  ও নেফ্রাইটিসজনিত কিডনি রোগও রয়েছে৷

তিনি বলেন, কোমল পানীয়, ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করতে হবে।  যেকোনো ওষুধ খাওয়ার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।  প্রয়োজনের বেশি ভিটামিন সি খাওয়া যাবে না।  পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে।  অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

তিনি বলেন, মানব দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ কিডনি, যা সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর হয়ে গেলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। পরিপূর্ণ বিকল হওয়া ছাড়াও কিডনির নানা ধরনের রোগ হয়। অথচ সচেতনতা অবলম্বন করলে এ রোগ অনেকাংশে ঠেকানো সম্ভব।

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : কিডনি
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক