ডা. রাসেল চৌধুরী

ডা. রাসেল চৌধুরী

এমবিবিএস, বিসিএস (স্বাস্থ্য), এমডি (শিশু)
শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ


০১ অক্টোবর, ২০২০ ১০:৩৫ এএম

মানবিক চিকিৎসকের প্রতিচ্ছবি সৈয়দ আতিকুল হক

মানবিক চিকিৎসকের প্রতিচ্ছবি সৈয়দ আতিকুল হক
অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসের ঘটনা। হঠাৎ করেই আম্মা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একেবারে শয্যাশায়ী অবস্থা। আম্মা প্রায় দশ বছর ধরে পলি আর্টিকুলার সেরোপজেটিভ রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে ভুগছিলেন। সাথে ফ্যাটি লিভার, ডায়াবেটিস, ডিসলিপিডেমিয়াও ছিল। 

আমার সরাসরি শিক্ষক একজন নামকরা মেডিসিন অধ্যাপক আম্মার চিকিৎসা করছিলেন। মেথোট্রেক্সেট, মেটফরমিন, রসুভাস্টাটিন পাচ্ছিলেন আম্মা। মোটামুটি ভালো ছিলেন। একটা সময় লিভার এনজাইম বেড়ে যাওয়ায় স্যার ওষুধগুলোর ডোজ বাড়িয়ে কমিয়ে দিলেন কিন্তু আম্মার রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ব্যথামুক্ত অবস্থা বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় রেমিশ। স্যার তখন একজন রিউমাটোলজিস্ট'র কাছে রেফার করলেন, তিনিও আমার শিক্ষক। কিন্তু তিনি নানাবিধ ডিএমএআরডি, স্টেরয়েড দিয়ে চিকিৎসা করেও কোনো সুফল আনতে পারেননি। আম্মা দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন।

প্রতিদিন সকালে মর্নিং স্টিফনেসের কারণে আমি কোলে করে আম্মাকে উঠে বসাতাম। আমার অসম্ভব কর্মঠ মা চোখের সামনে পুরোপুরি ব্যথায় যন্ত্রণায় শয্যাশায়ী। মাত্র ছয় মাস আগে আমার হার্টের বাইপাস সার্জারি হয়েছে। আম্মা আমার সবচেয়ে বড় অবলম্বন। অথচ চোখের সামনে আম্মার এই অবস্থা দেখে বেদনায় কষ্টে আমি রীতিমতো বিধ্বস্ত।

এই সময় হঠাৎ জানতে পারি, আমার মেডিকেল কলেজ ব্যাচমেট জাহিদ বিএসএমএমইউতে রিউমাটোলিজিতে এমডি করছে। একদিন ওকে ফোন করার পর, ও সব শুনে প্রথমে শাহীন স্যারের কাছে নিয়ে গেল। শাহীন স্যার সব শুনে আম্মাকে সৈয়দ আতিকুল হক স্যারের আন্ডারে বিএসএমএমইউতে ভর্তি হয়ে যেতে বললেন।

সেই প্রথম আতিক স্যারের সাথে আমার দেখা। স্যার দেখেই বললেন, বায়োলজিকাল এজেন্ট বহু আগেই দেওয়া উচিত ছিল। অথচ এটার কথা আগে কেউই আমাকে বলেননি। ফাইব্রোস্ক্যান এ ফ্যাটি লিভারের প্রদাহ বা ন্যাশ স্টেজ ফোর  ছিল। কিন্তু আম্মা যেহেতু ওভারওয়েট ছিলেন ছিলেন এবং তখন ফাইব্রোস্ক্যান টেকনিশিয়ানরা করতো, তাই রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহ ছিল। ফ্যাটি লিভার স্টেজিং বোঝার জন্য আতিক স্যার তাই লিভার বায়োপসি ও করতে বললেন। হেপাটোলজিস্ট শাহীনুল আলম স্যারের অধীনে করা বায়োপসি রিপোর্টে আসলো ফ্যাটি লিভার (এনএফএএলডি) স্টেজ ওয়ান। তখন আতিক স্যার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান করলেন রিটোক্সিম্যাব অথবা টোসিলিজুমাব। কিন্তু দুটোই যথেষ্ট ব্যয়বহুল। বন্ধু জাহিদকে বলার পর আতিক স্যারের মোবাইল নম্বর দিয়ে স্যারের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে বললো। 

শুক্রবার সকালে ভয়ে ভয়ে স্যারকে মেসেজ পাঠালাম, পরামর্শ চাইলাম, আমি এখন দুটো বায়োলজিকাল এজেন্টের ভেতর কোনটা নিলে আর্থিকভাবে সামর্থ্যের ভেতরে আম্মার সুচিকিৎসা করতে পারবো।

আমাকে অবাক করে দিয়ে স্যার নিজেই ফোন করলেন। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে দুটো ওষুধের ব্যাপারেই বুঝিয়ে বললেন। একদম ক্লাসে শিক্ষক যেভাবে ছাত্রকে বোঝান, সেভাবেই। আমি তখন রিটোক্সিম্যাব নেবার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম। পরের সপ্তাহেই রিটোক্সিম্যাব (ব্র‍্যান্ড নাম ম্যাবথেরা) নেবার জন্য আম্মাকে আবার ভর্তি করালাম। তখন জানলাম, স্যারের অনুরোধে রোশ বাংলাদেশ ঔষধ কোম্পানি একটি ডোজের দামে দুটো ডোজ দিচ্ছে। অর্থাৎ ৫ লাখ টাকার ওষুধ আম্মা পেলেন মাত্র ২.৫ লাখ টাকায়।

ম্যাবথেরা ইঞ্জেকশন প্রথমদিন দেবার ঘটনা। স্যার খুব সকাল বেলায় আম্মাকে দেখে গেলেন। এই ওষুধটার লিটারেচারে লেখা আছে, ব্লাড প্রেশার কমে যাওয়া বা হাইপোটেনশন একটা সাইড ইফেক্ট। কিন্তু সেটাকে আমি এবং এটেন্ডিং ডক্টর এড্রেস করতে ভুলে গেছি। এ রকম তো প্রায় সব ঔষধেই লেখা দেখি। তাই গুরুত্ব দেইনি। পরের দিন এসে আম্মাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে স্যার যখন শুনলেন, ঔষধ পুশ করার ৬ ঘণ্টা সময়ে ১ ঘণ্টা পরপর ব্লাড প্রেশার চেক হয়নি, তখন স্যার হেসে আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, হাসপাতালের চিকিৎসক আর পুত্র চিকিৎসক দুজনই নির্দেশনা মানতে ব্যর্থ হয়েছেন।

এই প্রেশার চেক করার গুরুত্ব বুঝেছিলাম ১৫ দিন পরে ২য় ডোজ ম্যাবথেরা দেবার সময়। সেদিনে ১ ঘণ্টা ঔষধ দেবার পরই আম্মা অস্থির হয়ে গেলেন, ব্লাড প্রেশার ৭০/৪০ এ নেমে এলো। অবশ্য কিছুক্ষণ বন্ধ থাকার পর নরমাল স্যালাইন দিয়ে প্রেশার ঠিক হবার পর ম্যাবথেরা পুরো দেয়া গিয়েছিল। ২য় ডোজ দেবার দিন সকালে স্যারকে মেসেজ দিয়েছিলাম। স্যার সুন্দর করে রিপ্লাই দিলেন, সেদিন স্যার বিসিপিএস যাচ্ছেন, তাই তখনকার রিউমাটোলিজি ফেজ বি স্টুডেন্ট শোয়েব ভাইকে সব বলে দিয়েছেন।

যাই হোক, স্যার এগ্রেসিভ ট্রিটমেন্ট শুরু করলেন। ১ মাস পরেই আম্মা পুরোপুরি আগের মতো হাঁটাচলা শুরু করলেন। যেকোনো সমস্যায় স্যারকে মেসেজ পাঠালেই ফিরতি মেসেজে সমাধান দিয়ে দিতেন।

স্যার বিএসএমএমইউতে রিউমাটোলিজিক্যাল রোগগুলোর চিকিৎসা হিসেবে রিটোক্সিম্যাব পাওয়া রোগীদের জন্য ম্যাবথেরা ক্লিনিক চালু করেছিলেন। ১/২ মাস পরেই শোয়েব ভাই ফলোআপ ডেটের মেসেজ পাঠাতেন।

রিউমাটোলিজিস্ট হলেও মেডিসিনের সব বিষয়ই স্যার একদম লেটেস্ট নলেজ, গাইডলাইন মনে রাখতেন। তাই রিউমাটোলিজর জটিল সব রোগের সমন্বিত চিকিৎসা স্যার করতে পারতেন। খেয়াল রাখতেন ছোট ছোট সব সাইড এফেক্ট, এমনকি দীর্ঘমেয়াদি এই সমস্ত রোগের সাইকিয়াট্রিক জটিলতা নিয়েও।

আজ প্রায় ৬ বছর পরেও আমি যতবার আম্মাকে দেখি দুই নাতিকে নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন, হাঁটছেন, ঘুরছেন, বসছেন, উঠছেন আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি আতিক স্যারের সদাহাস্যোজ্জ্বল মুখ।

শুধু এই রোগীরাই নন। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের রোগীদের ভিড় স্যারের বিএসএমএমইউ রুমে লেগেই থাকতো। কেউ স্যারকে এসএমএস করলেই স্যার একটা এপয়ন্টমেন্ট টাইম দিতেন এবং সেই সময় মেইনটেইন করতেন। এ রকম আর কোনো চিকিৎসক বাংলাদেশে আছেন কিনা আমি জানি না।

এবার আসি সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায়। আমার স্ত্রী তিথি যখন এপ্রিলে করোনায় আক্রান্ত হলো তখন করোনা চিকিৎসা নিয়ে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এর অন্যতম হলো হাইডোক্সিক্লোরকুইন।

যেহেতু বাংলাদেশে এই ওষুধের সবচেয়ে বেশি ক্লিনিক্যাল ইফেক্ট স্যারের জানা, তাই স্যারকে মেসেজ পাঠালাম। স্যার বিস্তর স্টাডির রেফারেন্স দিয়ে সেটার অকার্যকারিতা বুঝিয়ে বললেন।

তখন করোনা পজিটিভদের আইসোলেশন টাইম নিয়েও নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য চারদিকে। তাই তিথির করোনা আইসোলেশন পিরিয়ড নিয়েও স্যারকে মেসেজে জিজ্ঞেস করেছিলাম। স্যার উনার এক নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণে ১ দিন পর ফোন করে দেরির জন্য স্যরি বলে নানারকম রেফারেন্স দিয়ে পরামর্শ দিলেন।

দিন কয়েক আগে আবার স্যারকে মেসেজ পাঠালাম। আম্মা সাইক্লোস্পোরিন সিরাপ সকালে ও রাতে দুইবেলায় পেতেন। কিন্তু আম্মা চাচ্ছেন একবেলায় খেতে কারণ সিরাপটার মুখ খোলা কষ্টকর। স্যার ফিরতি মেসেজে জানালেন, একবেলায়ই পুরো দিনের ডোজ খাওয়া যাবে। সাথে অবশ্যই এর স্বপক্ষে লিটারেচার রেফারেন্স।

এতক্ষণ যারা ধৈর্য ধরে এই লেখা পড়েছেন, অনেকেই ভাবছেন হয়তো স্যার বুঝি আমার পূর্ব পরিচিত বা আত্মীয় বা আমি স্যারের ছাত্র। তিনটির কোনোটিই নন। স্যার কোনোদিন আমাকে সামনা সামনি দেখলে চিনবেনও না। তবুও স্যার আমার পরিবারের প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।

শুধু আমি নই, স্যারের চারপাশের মানুষরা জানেন কতটা অসাধারণ একজন মানুষ তিনি। স্যারের ডিপার্টমেন্টে বোধ হয় পোস্ট গ্রাজুয়েশনে পাশের হার সবচেয়ে ভালো। এমনকি অন্য ডিপার্টমেন্টের রেসিডেন্টরাও স্যারের আন্ডারের সময়টুকু নিয়ে সবসময় সুখস্মৃতিতে মেতে থাকেন। কিংবদন্তি চিকিৎসক হিসেবে দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও স্যারের সম্মান সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এখোনো স্যার একজন স্বামী, একজন বাবা কিংবা সহপাঠীদের বন্ধু হিসেবে যে রকম অসাধারণ জীবন যাপন করেন, সেটার তুলনা বোধ হয় সারা বাংলাদেশে নেই।

অথচ স্যার চাইলেই ব্যক্তিগত উপার্জনের দিক দিয়ে দেশের প্রথিতযশা সকল চিকিৎসককে হারিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু সেটার চেয়ে মানবিক চিকিৎসক হওয়াটাকেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। সেজন্য নিজের চেম্বারের পাশেই স্যারের ছাত্র ছাত্রী তরুণ বিশেষজ্ঞ রিউমাটোলজিস্টদের প্রেকটিসের সুযোগ করে দিয়েছেন, এটাও এদেশে একমাত্র উদাহরণ। ধানমন্ডিতে মাঝে মাঝে যখন স্যারকে সাদামাটা গাড়িতে সাধাসিধে চলাফেরায় দেখি, তখন আর অবাক হই না।

গতকাল স্যার বিএসএমএমইউ থেকে অবসর নিয়েছেন। স্যারের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিএসএমএমইউ মেডিসিন ফ্যাকাল্টি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ রত্নকে হারিয়ে ফেললো।

স্যারের জন্য অফুরান শুভকামনা। কিংবদন্তি চিকিৎসক হয়তো এদেশে অনেকেই আছেন, অনেকে বিখ্যাত হয়েছেন কিংবদন্তি শিক্ষক হিসেবে, আবার অনেকে আছেন অনুকরণীয় বন্ধুবৎসল হিসেবে, কিন্তু এসমস্ত গুণের সমন্বয়ে তৈরি একজন সৈয়দ আতিকুল হক স্যারের সমতুল্য এদেশে একজনও নেই। 

স্বাস্থ্যের সকল প্রকল্প মূল কার্যক্রমে নিয়ে আসার পরিকল্পনা

সেক্টর কর্মসূচি ছাড়াই স্বাস্থ্যের এক বছর, ২৫ হাজার কর্মীর চাকরি অনিশ্চয়তায়

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
নম্বরের কথা চিন্তা করে পড়াশোনা করিনি: ডা. জেসি হক
এমআরসিপিতে বিশ্বসেরা বাংলাদেশি চিকিৎসক

নম্বরের কথা চিন্তা করে পড়াশোনা করিনি: ডা. জেসি হক