বেতন নেই ১০ মাস, দুশ্চিন্তায় অসুখে ভুগে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মীর মৃত্যু

মেডিভয়েস রিপোর্ট: ১০ মাস বেতন-ভাতা না পেয়ে অর্থাভাবে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ (সিওমেক) হাসপাতাল শিশু বিকাশ কেন্দ্রের এক কর্মীর মৃত্যু হয়েছে। আজ বুধবার (৭ মে) সকাল নয়টায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মেহেরজান বেগম মেরি (২৮) নামের চার মাসের অন্তঃসত্তা এই নারী মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কেন্দ্রটির পরিচ্ছন্নকর্মী ছিলেন।
ওসমানী মেডিকেল কলেজ শিশু বিকাশ কেন্দ্রের শিশু মনোবিজ্ঞানী সাদিয়া আরিফিন রুনা মেহেরজান বেগমের মৃত্যুর বিষয়টি মেডিভয়েসকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মেহেরজান বেগম সিলেট সদর উপজেলার কান্দিগাঁও ইউনিয়নের বাসিন্দা। সেখান থেকেই নিয়মিত শিশু বিকাশ কেন্দ্রে যাতায়াত করতেন তিনি। তার দিনমজুর স্বামী দীর্ঘদিন অসুস্থতায় ভুগছেন। এ ছাড়া ছয় বছরের একটি ছেলে এবং ছয় মাসের একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে মেহেরজানের। চার মাসের অন্তঃসত্তাও ছিলেন তিনি।
মূলত, গত বছরের জুন মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প চালু ও থোক বরাদ্দের আশ্বাস দেওয়া হলেও ১০ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না সারাদেশের ৩৫টি কেন্দ্রের শিশু স্বাস্থ্য চিকিৎসক, শিশু মনোবিজ্ঞানী ও ডেভেলপমেন্ট থেরাপিস্টসহ ১৭৫ জন কর্মী।
শিশু মনোবিজ্ঞানী সাদিয়া আরিফিন রুনা বলেন, ২০০৯ সালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মেহেরজান বেগম এখানে কর্মরত। তার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। ছেলেটির কগনিটিভ ডিলে বা বুদ্ধিগত জটিলতা রয়েছে। ছয় মাস আগে তার একটি কন্যা সন্তান হয়েছে। সম্প্রতি কনসিভও করেছে। কিন্তু ১০ মাস ধরে বেতন নেই। বাড়ি থেকে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের গাড়ি ভাড়া প্রতিদিন ৮০-৯০ টাকা চলে যায়। তার যাতায়াত ভাড়া, শিশুর ভরণপোষণ এবং অসুস্থ স্বামীর খরচ—সব মিলিয়ে তিনি অনেক চাপে ছিলেন। তার ভাড়া যোগানোই অনেক কষ্ট হয়ে যেত।
সাদিয়া আরিফিন বলেন, ‘মেহেরজান বেগম গত চার-পাঁচদিন যাবত জ্বরে ভুগছিলেন। সম্ভবত অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছিলেন। দুশ্চিন্তাগ্রস্তও ছিলেন। গতকাল অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে আমরা হাসপাতালে ভর্তি করি। আজ সকালেই মারা গেলেন। এর আগে অন্য কোনো শারীরিক অসুখ আমরা দেখিনি।’
জানা গেছে, প্রায় সাত মাস ধরে স্বামী অসুস্থ হওয়ায় সংসারের দায়ভার পুরোটাই মেহেরজানের কাঁধে চলে আসে। প্রায় ১৫ হাজার টাকা বেতনে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের পরিচ্ছন্নকর্মীর চাকরি করতেন তিনি। কিন্তু বেতন বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তাকে।
শিশু মনোবিজ্ঞানী সাদিয়া আরিফিন রুনা বলেন, ‘এসব কারণে আমাদের কাছে থেকে তাকে টাকা নিতে হতো। টাকা-পয়সা চাইতেও লজ্জা পেতেন। এমনকি দ্বিতীয় শিশু হওয়ার সময় গর্ভাবস্থায়ও কাজ করেছেন। সে সময় মাত্র ২০ দিন মতো ছুটি কাটিয়েছেন। এ কয়দিনও তার অনুপস্থিতিতে আরেকজনকে বেতন দিয়ে রেখেছিলেন। এর পর থেকেই ছোট বাচ্চাটাকে নিয়েই অফিস করতেন। প্রায়ই জিজ্ঞাসা করতেন, কবে বেতন হবে? আরও অনেকের কাছে কর্জ করে চলেছে। তিনি টাকা নিলেই বলতেন—বেতন হলে দিয়ে দিব, কিন্তু তা পারতো না। ১০ মাস হয়ে গেছে, পারেনি।’
প্রকল্প চালু এবং বকেয়া বেতন-ভাতা প্রসঙ্গে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই শিশু মনোবিজ্ঞানী বলেন, ‘দিবে দিবে বলছে, কিন্তু দিচ্ছে না তো। এর আগে ফেনীতে একজন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে স্ট্রোক করে মারা গেছেন। আর কতদিন? কবে হবে? ও (মেহেরজান) হয়তো অসুস্থ ছিল, হয়তো অনেকগুলো জটিলতা ছিল তার, কিন্তু আমাদেরকে বলতে পারেনি। কারণ ধার-কর্জ করে চলছিল, হয়তো ওর লজ্জা লেগেছে, ভেবেছে আর কত নিব?’
তিনি আরও বলেন, ‘স্পষ্টত, তার কোনো অসুখ-বিসুখ ছিল না। চার-পাঁচদিন যাবত জ্বর। এর মধ্যে পরশু দিন আমাকে বলেন, ম্যাডাম আমি তো কনসিভ করে ফেলেছি, অ্যাবর্শন করাবো। ওষুধ খাবে বলছিলেন। আমি বলেছি, একা একা ওষুধ খাইয়েন না, ডাক্তার দেখিয়ে খান। এর মধ্যেই আজকে মারা গেল।’
প্রসঙ্গত, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া ১০ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অপারেশন প্ল্যানের আওতায় ৩৫ শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বেতন-ভাতা দূরে থাক, তাদের চাকরি আছে কি নেই—সে বিষয়েও স্পষ্ট কোনো বক্তব্য নেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এসব স্বাস্থ্যকর্মীর এক বছরের বেতনের জন্য থোক বরাদ্দের আবেদন করা হয়েছিল অনেক আগেই। তবে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে বলে জানা গেছে। বেতন-ভাতা বন্ধ হওয়ার পর একাধিক সহকর্মীর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার খবরে হতাশ হয়ে পড়েছেন শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরই মধ্যে অর্থাভাবে দিনাতিপাত করে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের এক কর্মীর মৃত্যু হলো।
এদিকে চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বকেয়া বেতন-ভাতাসহ চার দফা দাবি তুলে ধরেছিলেন শিশু বিকাশ কেন্দ্রের চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা। আড়াই মাস পেরিয়ে গেলেও এসব বিষয়ে কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়নি। দাবিগুলো হলো—শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিগত মাসের প্রাপ্য বকেয়া বেতন ও ভাতা অবিলম্বে পরিশোধ করতে হবে, শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোকে রেভিনিউ বাজেটের অন্তর্ভুক্তি বা সরকারি বিশেষ সেবাদানকারী গুরুত্বপূর্ণ জরুরি সেবা হিসাবে চালুর বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে, শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তাদের চাকরির অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে এবং বিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশু ও প্রতিবন্ধী শিশুদের সেবার মান উন্নয়নের জন্য শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোর আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন করতে হবে।
অপরদিকে গত সোমবার (৫ মে) শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সকল জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন। প্রয়োজনে কেন্দ্রগুলোকে রেফারেল ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে এসে রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনার সুপারিশও করা হয়েছে।
মূলত, স্নায়ু-বিকাশগত সমস্যা রয়েছে এমন শিশুদের নিয়ে কাজ করে শিশু বিকাশ কেন্দ্র। ২০০৮ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নির্দেশনায় শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লায়লা জামান খানের প্রচেষ্টায় শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রকল্পটি সেক্টর কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরের বছর আগস্ট মাসে পাঁচটি কেন্দ্রের মাধ্যমে সর্বপ্রথম এই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০১০ ও ২০১৪ সালে পাঁচ করে ১০টি কেন্দ্র বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালের মার্চে আরও ২০টি কেন্দ্র এই প্রকল্পে যুক্ত হয়। এই ৩৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্রের মধ্যে সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৪টি এবং জেলা সদর হাসপাতালে ১১টির কার্যক্রম চলমান আছে।
জানা গেছে, প্রতিটি কেন্দ্রে একজন শিশু স্বাস্থ্য চিকিৎসক (চাইল্ড হেলথ ফিজিশিয়ান), একজন শিশু মনোবিজ্ঞানী (চাইল্ড সাইকোলজিস্ট) ও একজন ডেভেলপমেন্টাল থেরাপিস্ট রয়েছেন। এ ছাড়া একজন করে পরিচ্ছন্ন কর্মী থাকেন। এর বাইরে প্রথম ১৫টি কেন্দ্রে একজন অফিস ম্যানেজারও আছেন। সব মিলে ৩৫টি কেন্দ্রে চাকরি করেন ১৭৫ জন। এ ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে এই প্রকল্পে মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে রয়েছেন আরও ১১ জন, এর মধ্যে তিনজন সিনিয়র ইনস্ট্রাক্টর। সর্বশেষ তথ্যমতে, মোট ১৮৬ জনের মধ্যে শূন্যপদ রয়েছে ৩৭টি।
গত বছরের জুনের একটি হিসেবে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের আগস্ট মাস থেকে ৩৫টি কেন্দ্রে প্রায় দুই লক্ষ ৩৭ হাজার ৯৩৪ শিশু স্নায়ু-বিকাশজনিত সমস্যার সেবা গ্রহণ করেছে। শিশু বিকাশ কেন্দ্রে চিকিৎসা পেশাজীবীদের একটি সমন্বিত দল স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর একই সাথে একই সেটিংসে সকল বিশেষায়িত সেবা প্রদান করছে। নিজ জেলায় মাত্র ১০টাকায় শিশুরা এই সেবা নিতে পারে। সমাজের নিম্ন আর্থসামাজিক শ্রেণি থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে এই শিশু বিকাশ কেন্দ্র। দেশে প্রতিবন্ধিতার হার কমিয়ে সুস্থ নাগরিক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এই কেন্দ্রগুলোর।
এনএআর/
-
০৬ মে, ২০২৫
স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন
জেলা সদর ও মেডিকেল হাসপাতালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার সুপারিশ
-
১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
-
১৬ নভেম্বর, ২০২৪