ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ

প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও একুশে পদকপ্রাপ্ত চিকিৎসক।

 


১৭ অক্টোবর, ২০২৩ ১০:৪৯ এএম

ডেঙ্গু রোগীকে স্টেরয়েড কেন দেবেন, কখন দেবেন?

ডেঙ্গু রোগীকে স্টেরয়েড কেন দেবেন, কখন দেবেন?
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বলে রোগীকে শকের দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না, গুরুতর মনে হলে বা এর আগেই স্টেরয়েড দিন। অবাক করা বিষয় হলো, শকে চলে গেলেও অনেকে স্টেরয়েড দিতে চান না। ছবি: আব্দুল লতিফ সাদ্দাম

ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্ত বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই মৃত্যু বাড়বে। এডিস মশাবাহিত ভাইরাসটিতে চলতি বছর মৃত্যুর সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ইতিমধ্যে এগারশ’ অতিক্রম করেছে। গত বছর মাত্র ২৮১ জন মারা গিয়েছিল, আক্রান্ত ছিল ৬২ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু এবার আক্রান্তের সংখ্যা এরই মধ্যে দুই লাখেরও বেশি। ‍মৃত্যু ও আক্রান্তের হার ক্রমাগতভাবে বাড় থাকায় বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীরা যথেষ্ট সচেতনতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসা দিচ্ছেন, যা যা করা দরকার তার সবটুকুই করছেন। সমস্যা হলো, ডেঙ্গু জ্বর শুধু শহরে সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে গেছে। গ্রামে এতো চিকিৎসার সুযোগ নেই, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ নেই, অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতালে যাওয়ারও সুন্দর ব্যবস্থা নেই। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টও সুন্দরভাবে হচ্ছে না। ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা ঘিরে বিতর্ক, পরস্পর দোষারোপের পাশাপাশি আছে নানা অভিযোগও।

তবে এ ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে শকে যাওয়া বা শকে যাওয়ার মতো রোগীদের স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ নিয়ে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ আছে, একেকজন একেকটা দেন। এটা কোনো অসুবিধা নয়। সমস্যা হলো, স্টেরয়েড প্রয়োগ নিয়ে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন রকম বক্তব্য এবং মতভেদ আছে। অধিকাংশ চিকিৎসকই স্টেরয়েড ব্যবহার না করার পক্ষে।

একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি মনে করি, রোগী গুরুতর হলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে জীবন রক্ষায় স্টেরয়েড প্রয়োগ করা উচিত। এর নামই হলো জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। অর্থাৎ এটা ওষুধই। এটা কখন দেওয়া হয়, উত্তর হলো—মরণাপন্ন রোগীকে। সুতরাং এ নিয়ে বিতর্ক হওয়া নিষ্প্রয়োজন।

এর পরও অনেকে এটা নিয়ে বিতর্ক করেন। কেউ এটা প্রয়োগ করেন, কেউ করতে চান না। অধিকাংশ চিকিৎসকেরই বক্তব্য হলো, দেওয়া উচিত না, দিলে ক্ষতি (পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া) হবে। আমার কথা হলো, কোন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই? এন্টিবায়োটিক থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এমনকি প্যারাসিটামলেরও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া কোনো ওষুধই নেই।

স্টেরয়েড কখন প্রয়োগ করা হয়?

এখন আসুন, স্টেরয়েড প্রয়োগের সময় ও প্রাসঙ্গিকতায়। আমরা বিশেষ প্রয়োজনেই একজন রোগীকে এ জাতীয় ওষুধ দিই। তাহলে রোগী গুরুতর পর্যায়ে চলে যাচ্ছে দেখেও কেন বসে থাকবো? অনেক ভয়াবহ রোগী, যার প্রেসার পাওয়া যাচ্ছে না, পালস পাওয়া যাচ্ছে না, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, হাত-পা ঠাণ্ডা—এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কোনো রকম কালক্ষেপণ করা যাবে না। এ সময় অবশ্যই স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। এতে তাদের জীবন রক্ষা পাবে। এ ব্যাপারে আমার প্রায় দুই যুগের অভিজ্ঞতা তাই বলে।

সম্ভব হলে সতর্কতার অংশ হিসেবে গুরুতর পর্যায়ে চলে যাওয়ার আগেই রোগীকে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেওয়া উচিত, এটা তার সুস্থতার জন্য অধিকতর বেশি সহায়ক।

এ ব্যাপারে হয়তো কারও অভিজ্ঞতা খারাপও হতে পারে। তবে আমার অভিজ্ঞতা হলো, রোগীর অবস্থা বুঝে ‘ডেক্সাম্যাথাসন’ ইনজেকশন শিরাপথে ১২ ঘণ্টা, আট ঘণ্টা বা ছয় ঘণ্টা ব্যবধানে দেওয়া হলে ভালো সাড়া পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্যান্য চিকিৎসাও চলবে, এগুলো বাদ দিতে বলছি না।

স্টেরয়েড প্রয়োগের আরেকটি সুবিধা হলো, এটি ডেঙ্গু রোগীর প্ল্যাটিলেট দ্রুত বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে প্ল্যাটিলেটও দেওয়া লাগে না। যদিও প্ল্যাটিলেট প্রাকৃতিকভাবেই বাড়ে। তবুও স্টেরয়েড দিলে আমার মনে হয়, আরেকটু দ্রুত বাড়ে। এটি প্রয়োগ করলে রোগীর ভালো লাগে, জ্বর কমে যায়, মাথা ব্যথা, শরীর ব্যথা, গিরায় গিরায় ব্যথা কমে যায়, রোগীর রুচি বৃদ্ধি পায়। শ্বাস কষ্ট, পেটফোলা কমে আসে। সর্বোপরি রোগী ভালো বোধ করেন এবং তার মনোবল বাড়ে।

এ ছাড়া গুরুতর অনেক ডেঙ্গু রোগীর ফ্লুইড লিকেজ হয়, অর্থাৎ শিরা বা ধমনী থেকে প্লাজমা বের হয়ে আসে, পেটে পানি আসে, বুকে পানি আসে। এই সময় স্টেরয়েড দিলে এগুলো শোষণ হয়ে যায়। সুতরাং এটা রোগীর জন্য খুবই সহায়ক। 

অন্য রোগের মতো ডেঙ্গুতেও স্টেরয়েড দেওয়া উচিত 

স্টেরয়েড প্রয়োগ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেক রোগের বেলায় কিন্তু এ জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে মাসের পর মাস, এমনকি বছরের পর বছর। যে যুক্তিতে অন্য রোগীদের প্রয়োগ করা যায়, একই যুক্তিতে সংকটাপন্ন ডেঙ্গু রোগীদেরও এটা দেওয়া যাবে। এতে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

কিন্তু চোখের সামনে রোগী মরে যাওয়ার দৃশ্য দেখার পরও স্টেরয়েড দেবো না—এটা হতে পারে না। আমার কথা হলো, ভয়াবহ রোগীদের জীবন রক্ষায় এই সুযোগটি গ্রহণ করতে তো কোনো সমস্যা নেই। এটা তো নির্দিষ্ট চিকিৎসা না, বরং এটা আমরা রোগের লক্ষণের আলোকে (সিম্পমেটিক), সহায়ক (সাপোর্টিভ) হিসেবে দিয়ে থাকি। এভাবে দেওয়া হলে অনেক রোগীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।

প্রয়োগ করলেও অনেকে প্রকাশ করছেন না

অনেক চিকিৎসক স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ প্রয়োগ করলেও বলেন না। এ নিয়ে বিতর্ক থাকায় প্রয়োগের বিষয়টি তারা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেন। আমার মনে হয়, রোগীর অবস্থা খারাপ মনে হলে অবিলম্বে, নির্দ্বিধায় এটা দেওয়া উচিত। আমি কয়েক হাজার রোগী দেখেছি, যাদেরকে দিয়েছি, সবাই ভালো আছেন।

রোগী একবার শকে চলে গেলে তো বাঁচানো কঠিন। আমি যদি একটু আগেই দিই, তাহলে অসুবিধা কোথায়, যাতে শকে যাওয়ার উপক্রম না হয়? অনেকে বলেন, স্টেরয়েড দিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। কিন্তু শকে তো রোগী প্রায় মরণাপন্ন, সেখানে আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রশ্ন কোথা থেকে আসে? হাস্যকর একটি কথা প্রচলিত আছে, রোগী মারা গেলেও চোখটা রক্ষা পেয়েছে। আমার কথা হলো, একজন রোগী মারা গেলে তার চোখ বাঁচিয়ে লাভ কী? চোখের আগে তো রোগীকে বাঁচাতে হবে। সুতরাং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে রোগীকে শকের দিকে ঠেলে দেওয়া ঠিক হবে না, গুরুতর মনে হলে বা এর আগেই স্টেরয়েড প্রয়োগ করা উচিত।

কেউ কেউ বিষয়টি অনেক পরে প্রকাশিত হওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এ নিয়ে সন্তোষজনক ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত কথা বলা সমীচীন নয়। ব্যাপক সংখ্যক রোগী ভালো হওয়ার ফলাফল আমার কাছে প্রকাশযোগ্য মনে হয়েছে।

অনেক দেশে ডেঙ্গু রোগীকে স্টেরয়েড প্রয়োগ

পৃথিবীর অনেক দেশে ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকায় রোগীদের স্টেরয়েড দেওয়া হচ্ছে; তা হয়তো ট্রায়াল পর্যায়ে আছে, তবে দেওয়া হচ্ছে। বাইরের অনেক দেশের চিকিৎসকদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা জানিয়েছেন, তাদের স্টেরয়েড প্রয়োগের ফলাফল খুবই ভালো। ফলে তারা নির্দ্বিধায় দিচ্ছেন। সুতরাং আমি মনে করি, এটা নিয়ে একদিকে গবেষণা হতে পারে, অন্য দিকে মরণাপন্ন রোগীদের জীবন রক্ষায় অব্যাহত থাকুক।

ডেঙ্গু রোগীদেরকে আমরা গতানুগতিক চিকিৎসা দিচ্ছি। মৃত্যুর মিছিল তো থামছে না, সুতরাং সেখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে সাহসী উদ্যোগ নিয়ে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে এটা প্রয়োগ করা যেতে পারে। জটিল রোগীর বেলায় সময় ক্ষেপণ না করে স্টেরয়েড প্রয়োগ করা হলে রোগী ভালো হয়ে যাবে।

অসংখ্য রোগীকে চিকিৎসকরা বছরের পর বছর, মাসের পর মাস স্টেরয়েড দিয়ে থাকেন। সতুরাং ডেঙ্গু রোগীর বেলায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ অন্যান্য ক্ষতির আশঙ্কা করার প্রয়োজন নেই। কারণ এটা দীর্ঘ মেয়াদি না, বরং সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য দেওয়া হবে। ২/৩ দিনে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই, তেমন কোনো জটিলতা দেখা দেবে না। এতে অধিকাংশ রোগী আরোগ্য লাভ করবে।

এএনএম/এএইচ 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  ঘটনা প্রবাহ : জীবন রক্ষায় স্টেরয়েড
প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য নীতিমালা সংশোধনের দাবি

টেস্ট রিপোর্টে স্বাক্ষর প্রদান অন্তর্ভুক্তি চান বায়োকেমিস্টরা

বিভিন্ন ব্লকের সামনে নতুন ব্যানার

বিএসএমএমইউর নাম ‘বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’

প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য নীতিমালা সংশোধনের দাবি

টেস্ট রিপোর্টে স্বাক্ষর প্রদান অন্তর্ভুক্তি চান বায়োকেমিস্টরা

বিভিন্ন ব্লকের সামনে নতুন ব্যানার

বিএসএমএমইউর নাম ‘বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়’

বিশ্ব ক্যান্সার দিবস পালনে নানা কর্মসূচি

দেশে প্রতি লাখে ক্যান্সার আক্রান্ত ১০৬, বিএসএমএমইউর গবেষণা

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত