ডা. সিফাত ই সাইদ

ডা. সিফাত ই সাইদ

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহকারী অধ্যাপক,
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ, বিএসএমএমইউ।


২০ মে, ২০২৩ ০৩:৩৬ পিএম

শিশুর ডিভাইস আসক্তি প্রতিরোধে যা করবেন 

শিশুর ডিভাইস আসক্তি প্রতিরোধে যা করবেন 
ডিভাইস আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ হলেও শিশুর ক্ষেত্রে স্ক্রিন যতটা কম ব্যবহার করবেন, ততই মঙ্গল।

অতিরিক্ত স্ক্রিন দেখা শিশুদের বিকাশ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কিন্তু এই যুগে ডিভাইস ছাড়া কি একটা শিশুকে বড় করা যায়? হয় তো যায়, তবে তা খুবই কঠিন একটি কাজ। ধরে নিচ্ছি, এই কঠিন কাজটি বেশিরভাগ বাবা-মায়ের পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিটি শিশু কম-বেশি স্ক্রিন দেখছে। এই স্ক্রিন দেখার কারণে তারা ডিভাইসে আসক্ত হতে পারে, ফলে শিশুর মানসিক বিকাশে নানা ধরনের জটিলতা হতে পারে। তাই কোন নিয়মানুযায়ী স্ক্রিন দেখলে শিশুকে আসক্তি থেকে দূরে রাখা যাবে, সেই বিষয়ে এই লেখাটি।

আমি পেশায় একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ এবং শিশু মনোরোগবিদ্যা আমার অত্যন্ত আগ্রহের বিষয়। একই সাথে আমি একটি শিশুর মা। এই দুইটি অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে নিচের বাস্তবভিত্তিক কিছু পরামর্শ তুলে ধরা।

১. শিশুকে স্ক্রিন দিবেন, কিন্তু ইন্টারনেট অফ রাখবেন। এই কাজটি অত্যন্ত জরুরি। কারণ ইন্টারনেট অন থাকলে, শিশু ক্রমাগত স্ক্রল করে এক ভিডিও থেকে অন্য ভিডিওতে চলে যায়, এবং প্রায়ই এমন কিছু কনটেন্ট দেখে ফেলে, যা একেবারেই তার বয়স উপযোগী নয়। ক্রমাগত স্ক্রল করার কারণে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতাও তার কমতে থাকে। তাই শিশু একেবারে ছোট থাকতেই এই ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। ইন্টারনেট অন করার সময় wifimobile data এর আইকনগুলো শিশুর সামনে টিপবেন না। একবার যদি সে দেখে ফেলে, কোন বাটন চাপলে ইন্টারনেট অন হয়, তখন সে নিজেই wifi অন করে দেখা শুরু করবে। শিশুদের বোকা ভাববেন না।

২. বাবা-মায়েরা বলতে পারেন, ইন্টারনেট না থাকলে শিশু মোবাইল বা ট্যাবে কি দেখবে? আপনি তার বয়স এবং আমাদের সংস্কৃতির সাথে উপযোগী কিছু কনটেন্ট বা ভিডিও ডাউনলোড করে দিবেন, সেই ভিডিওগুলোই দেখবে। এক মাস পর পর আগের ভিডিও ডিলিট করে নতুন ভিডিও ডাউনলোড করুন নতুবা সে বিরক্ত হয়ে যাবে।

৩. শুধু ইউটিউব না দেখিয়ে তাকে খেলার ছলে শেখায় এ রকম কিছু app ব্যবহার করতে দিন। যেমন: Khan academy kids, ABC kids, Piano Kids. এতে তার ভিডিওর প্রতি আসক্তি তৈরি হবে না।

৪. আপনার মোবাইলের পাসওয়ার্ড বা প্যাটার্ন লক শিশু যেন না জানে, সেই বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকুন। এজন্য তাদের সামনে মোবাইলে পাসওয়ার্ড বা প্যাটার্ন দিবেন না। কোনোভাবে সে যদি জেনে ফেলে, তাহলে পাসওয়ার্ড বা প্যাটার্ন লক পরিবর্তন করুন।

৫. শিশু যখন স্ক্রিন দেখবে, তখনও তার সাথে Interact করুন। সে যেন একদৃষ্টে নিবিড় মনোযোগের সাথে স্ক্রিন না দেখতে পারে। এটাকে বলা হয় Processed Screen Time. যেমন: সে ‘ম্যারি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্ব’ এর ভিডিও দেখছে, আপনি তাকে বলুন, বাহ! কি সুন্দর একটা ভেড়া, ওর নাম কি? ওর গায়ের রঙ কি?

৬. স্ক্রিন দেখার সময় তার আশপাশে থাকার চেষ্টা করুন। আপনি একরুমে কাজ করছেন, শিশু আরেক রুমে বসে নিবিষ্টভাবে স্ক্রিন দেখছে, এটি যেন না হয়। একেবারেই অপারগ হলে তাকে এই সময় টিভি দেখতে দিন, মোবাইল বা ট্যাব নয়।

৭. শিশুকে তার নিজস্ব ডিভাইস দিবেন না। অর্থাৎ মোবাইল, ট্যাব ও আই প্যাড একান্তই তার নিজের, আর কেউ সেটা ব্যবহার করে না—এমনটা যেন না হয়। কোথাও বেড়াতে গেলে সার্বক্ষণিক তাকে ডিভাইস দিয়ে রাখবেন না। প্রকৃতির সাথে মিশতে দিন, অন্যান্য বাচ্চাদের সাথে মিশতে দিন।

৮. শিশুকে টিভি, মোবাইল ও ট্যাব দেখার আগেই সময় বেঁধে দিন এবং সেটা সঠিকভাবে মেনে চলুন। আপনি যদি তাকে বলেন, তোমাকে আধা ঘণ্টার জন্য এসব ডিভাইস দিলাম, তাহলে ঠিক আধাঘণ্টা পরেই এটা ফেরত নিন। ফেরত নেওয়ার সময় শিশু দিতে চাইবে না, কান্নাকাটি করবে, আরো একটু সময় চাইবে, তাতে গলে যাবেন না।

৯. অনেক শিশু আছে স্ক্রিন না দেখলে কিছুতেই খায় না। তাঁদেরকে নিজের হাতে মাঝে মাঝে খাবার খেতে দিন। খাবার হয়তো অল্প খাবে, কিন্তু তার সু-অভ্যাস গড়ে উঠবে। এক বেলা স্ক্রিনসহ খাওয়ালে অন্য বেলায় স্ক্রিন ছাড়া খাওয়ানোর চেষ্টা করুন।

১০. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সবার শেষে বলছি। সেটি হলো, শিশুদের স্ক্রিন আসক্তি কমাতে প্রথমে বাবা-মায়ের ডিভাইস আসক্তি কমাতে হবে। একটি শিশু যদি তার বাবা-মাকে দিনের বেশিরভাগ সময় ডিভাইস ব্যবহার করতে দেখে, তাহলে সে নিজেও তাই করবে। আপনি শিশুকে যা শেখাতে চান, আপনি নিজে আগে তা করুন।

ডিভাইস আমাদের অতি ব্যস্ত জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, কিন্তু শিশুর ক্ষেত্রে যতটা কম সম্ভব স্ক্রিন ব্যবহার করবেন, ততই মঙ্গল। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে গুণগত সময় কাটানোর কোনো বিকল্প নেই।

প্রসঙ্গত, উপরের সবগুলো পয়েন্ট স্বাভাবিক বিকাশের শিশুদের জন্য প্রযোজ্য। যেসব শিশুরা কথা দেরিতে বলছে (স্পিচ ডিলে), চোখে চোখে তাকায় না, অন্য শিশুদের সাথে interact করে না, ডাকলে ঠিকভাবে সাড়া দেয় না, তাদের জন্য স্ক্রিন টাইম শূন্যতে নিয়ে আসতে হবে।

মনে রাখবেন, ডিভাইস বা স্ক্রিন human interaction এর বিকল্প নয়। শিশুকে প্রচুর সময় দিবেন, তার সাথে খেলবেন, কথা বলবেন, ছড়া শোনাবেন, গান শোনাবেন। তাকে ধর্ম শিক্ষা দিন, আমাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করান, তাকে বাসার বাইরে মাঝে মাঝে খেলাধুলা করতে নিয়ে যান। 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত