অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ
ভাইস চ্যান্সেলর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮ নভেম্বর, ২০২১ ০৮:২৩ পিএম
শেবাচিমের ৫৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং স্মৃতি কথা
শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) বাংলাদেশের দক্ষিণের বিভাগীয় শহর বরিশালের দক্ষিণ আলেকান্দা এলাকায় অবস্থিত চিকিৎসা বিষয়ক উচ্চশিক্ষা দানকারী একটি প্রতিষ্ঠান। সরাসরি সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠানটি ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়; যা বর্তমানে দেশের একটি অন্যতম প্রধান চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি পুরানো আটটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মধ্যে অন্যতম।
১৯৬৪ সালের ৬ নভেম্বর এই মেডিকেল কলেজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরে ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন এর নাম ছিল বরিশাল মেডিকেল কলেজ যা পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে বরিশালের মহান নেতা শের-ই-বাংলা (বাংলার বাঘ) নামে খ্যাত আবুল কাশেম ফজলুল হকের নামে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ নামকরণ করা হয়। এদেশের চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণা এবং জনগণের স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক উন্নতিকল্পে দক্ষিণ বাংলার আপামর জনসাধারণের জন্য নির্মিত বরিশাল মেডিকেল কলেজ আজ থেকে ৫৩ বছর আগে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম শুরু করে। শুধু স্বাস্থ্যসেবাই নয় জনসেবা আর সমাজ বিনির্মাণেও এই মেডিকেল কলেজের আছে অসামান্য ইতিহাস। ৬৯ এর গণআন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ৯৬ এর ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের আন্দোলন এবং ১/১১ পরবর্তী সকল গণঅসন্তোষ্ট ও আন্দোলনসমূহে এই মেডিকেল কলেজ ও এখানে অধ্যায়নরত অনেক ছাত্রছাত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সর্বজনবিদিত।
মাত্র ৫০ জন ছাত্র নিয়ে যে মেডিকেল যাত্রা শুরু করেছিল সেখানে এখন প্রতিবছর দুইশত’র অধিক ছাত্র-ছাত্রী এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয়। এই বিদ্যাপীঠ হতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে প্রায় ১০০০ চিকিৎসক দেশ বিদেশে কর্মরত আছে। প্রায় ২ হাজার ৫০০ চিকিৎসক স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে দেশ বিদেশে শিক্ষকতায় ও গবেষণায় জড়িত আছে। সামগ্রিকভাবে এ দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে যে পরিমাণ মানসম্পন্ন চিকিৎসক প্রয়োজন তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এই মেডিকেল কলেজ থেকে উঠে আসে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানের কথা চিন্তা করে দেশব্যাপী থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মাণ করে মানুষের মৌলিক অধিকার তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি তিনি চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণিতে উন্নতি করে তাদের মর্যাদাকে আরও উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যান। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে যে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছেন, তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসা অর্জন করার পাশাপাশি অনেক দেশে এটা মডেল হিসেবে গৃহীত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৮ হাজার পাঁচশত কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে।
প্রতিটি চিকিৎসকের জীবনে তার মেডিকেল ক্যাম্পাস যেন তার আঁতুড়ঘর। সেই ঘরে তার জন্ম হয়, তারপর একদিন হয়তো স্ফুলিঙ্গের মতো উড়ে যায়। আরও বিশাল থেকে বিশালতার ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সেই ঘরের গন্ধ, আলো-বাতাস আর ভালবাসা সে বয়ে বেড়ায়। সময় বাড়ে, চামড়া ঝুলে পড়ে, চুলে পাক ধরে, অনুভূতি আরও প্রগাঢ় হয়। আমৃত্যু ভালবাসার এ জাল ছিন্ন হয় না।
জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আনন্দময় সময় পার করেছি বরিশাল মেডিকেল কলেজে। ১৯৭৫ সালে বরিশাল মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই।অসাবধানে গুরুতর একটি ভুল করি। বাবা যাবার সময় বললেন, পানির দেশে গিয়ে বিপদে পড়বো কিনা! আমি বলে ফেলি সমস্যা হবে না। আমি কি আর ছোট আছি নাকি? বাবা মনোকষ্ট পেলেন, বুঝতে পারলাম। তখন বুঝিনি এখন বুঝতে পারি ছেলে-মেয়ে যত বড়ই হোক না কেন মা-বাবার কাছে কখনোই বড় হয় না।
বরিশাল মেডিকেলে গিয়ে দেখি বিশাল দালান-কোঠা। কোনটার কাজই তখন শেষ হয়নি। কোথায় যাই, কার কাছে যাই। আমাকে রিসিভ করলেন তখনকার সেক্রেটারি। বললেন, সিনিয়র কারও সাথে রুম শেয়ারে থাকতে। কর্ণেল আনোয়ার আমার রুমমেট ছিলেন। যিনি পরবর্তীতে বিগ্রেডিয়ার জেনারেল হয়ে অবসর গ্রহণ করেন। অনেক ভাল-ভাল শিক্ষকের সান্নিধ্য পাই। যেমন সিদ্দিকুল্লাহ স্যার, নায়েব আলী স্যার, শাহ আবদুর রহমান স্যার, আমিনুল আসলাম স্যার, আনিস স্যার, আজিজুর রহমান স্যার (গাইনি), এনাটমির ক্যাপ্টেন সিরাজুল ইসলাম ও ইউনুস আলী স্যার প্রমুখ।
একবার ময়মনসিংহে এডুকেশনের উপর সেমিনার হবে। প্রতি ব্যাচ থেকে একজন করে প্রতিনিধি যাবে। সিদ্দিকুল্লাহ স্যার কেনো জানি আমাকে নির্বাচন করলেন। পরে আমি অবশ্য হারুন স্যারের কাছে কার্ড ফাইনালে অনার্স পাই। তরুণ শিক্ষকরা আমাদের খুব ভালবাসতেন। লুৎফর রহমান এবং অর্থোপেডিক্সের মোর্শেদ সাহেব প্রভাষক ছিলেন। লুৎফর রহমান সাহেব অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হয়ে অবসরে গেছেন।
হোস্টেল ডাইনিংয়ের পাতলা ডাল, ভর্তা আর মোল্লার কেন্টিনের নাস্তা পরোটা, ডিম ভাজি মনে পড়ে। মোল্লা সাহেব আর বেঁচে নেই কিন্তু তার চেহারা এখনও মনে পড়ে। আরেকটা আকর্ষন ছিল হোস্টেলের মাসিক ফিস্ট। বেশ ভালো ভালো খাবার থাকত ফিস্টে। শেষ হতো মিষ্টি আর পান দিয়ে। আমরা এ দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকতাম।
আবদুর রহমান স্যার আর আমিনুল ইসলাম স্যারের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁর খুব সহজ উদাহরণ দিয়ে পড়াতেন আর প্রতি পনের মিনিট পর পর ছোট একটি কৌতুক বলতেন যাতে ছাত্ররা একঘেয়েমি অনুভব না করে। বর্তমানে আমিও ক্লাসে এ অনুশীলন করি। কলেজে বক্তৃতা দিতাম। সবাই আমার বক্তৃতা পছন্দ করত। একদিন আমার বক্তৃতার পর আর কেউ বক্তৃতা দিচ্ছেনা। তখন হালিম সাইদা নামের আমার ক্লাসমেট বক্তৃতা দিলে সবাই বলল মহিলা শারফুদ্দিন বক্তৃতা দিচ্ছে।
আমরা খেলাধুলা করতাম। দৌড়ে পুরস্কার পেয়েছিলাম। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জয় লাভ করে একমাত্র সমাজ কল্যাণ সম্পাদক হলাম। টিআইএমএ ফারুক ভাইয়ের উদ্যোগে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতি প্রায় সারা বছর সক্রিয় থাকত। তিনি বিসিপিএসের সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেছেন। দলমত নির্বিশেষে সবাই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। প্রতি বছর ইফতার মাহফিল, ঈদ পুনর্মিলনী এবং পিকনিক হয়। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের অনেক পরের ব্যাচের ছাত্ররা এলেও দলমত নির্বিশেষে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি। সবার সহযোগিতায় ‘প্রাক্তন ছাত্র সমিতি ট্রাস্ট’ করা হয়েছে। এখানে সবার সদস্য হওয়া উচিত। যেকোন সমস্যা সমাধানে একসাথে কাজ করতে হবে। ঐক্যের বিকল্প নাই। স্মৃতির আয়নায় যখন সেই সময়ে নিজের অবয়ব দেখতে পাই বুকের ভিতর ব্যাখ্যাতীত এক আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজে থেকে পাস করা চিকিৎসক, যিনি দেশে বা বিদেশে আছেন তাঁরা সকলেই সুনামের সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ, উপধ্যক্ষ, পরিচালকসহ ডিন ও চেয়ারম্যান হিসাবে অনেকেই দৃঢ়তার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব হিসাবে এই মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যক্তি হওয়ায় আমি গর্বিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসাবেও এই মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যক্তি হওয়ায় আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও গর্বিত। চক্ষু চিকিৎসক সমিতি, অর্থোপেডিক্স, গাইনি, সার্জারি, ইএনটি ও বিসিপিএসসহ বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশন ও সোসাইটিতে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকবৃন্দ সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। এই মেডিকেল কলেজের একজন হিসাবে পরিচয় দিতে আমরা গর্ববোধ করি। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে এই মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকগণ অধিক হারে স্নতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে দেশের সকল মেডিকেল কলেজে তাদের অবস্থানকে আরও সুসংহত করবেন।
কত আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের সাথে মিশে আছে এই ক্যাম্পাস, ক্যাম্পাসে কাটানো সেই সোনালী দিনগুলোয় কী এক মায়া জড়িয়ে আছে। অমলিন সেই স্মৃতি হৃদয়ের মনিকোঠায় জাগ্রত থাকবে আমৃত্যু।