৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ১১:৪৬ এএম

গ্রামে কর্মরত চিকিৎসকদের দুর্গম ভাতা দেওয়া উচিত

গ্রামে কর্মরত চিকিৎসকদের দুর্গম ভাতা দেওয়া উচিত
ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করার পর ২০০৩ সালে স্বাস্থ্য ক্যাডার হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো। কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করা এ চিকিৎসক দেশের একাধিক স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে রেখেছেন দায়িত্বশীলতার ছাপ। বর্তমানে আছেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় প্রধান (ল্যাব) ও উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে। কর্মচঞ্চলতার দীর্ঘ সময়ে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য প্রশাসনে এরই মধ্যে দিয়েছেন দক্ষতা ও আন্তরিকতার পরিচয়। সম্প্রতি মেডিভয়েস মুখোমুখি হয়েছিল এ মেধাবী চিকিৎসকের। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে দিয়েছেন অভিজ্ঞতালব্ধ নানা পরামর্শ। পাঠকদের সামনে সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো।  

মেডিভয়েস: আপনার ব্যক্তিগত ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেছি। মমেকের ২৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলাম। আমাদের সময়ে মেডিকেলে সেশনজট অনেক বেশি ছিল, যেটা এখন আর নেই। এখন নতুন প্রজন্ম জানবেও না, রাজনৈতিক কোলাহল, সেশনজট ও হতাশা কি জিনিস? আমাদের সাথে অনেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আমাদের ব্যাচের একজন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। মেডিকেল থেকে পাস করার পর সবাই যা করে আমিও তাই করলাম। একা একা বাসায় পড়ে বিসিএস পরীক্ষা দিলাম, কোনো পরীক্ষাতে কখনও অসফল হইনি। ২১তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে সরকার বললো—তহবিলে পর্যাপ্ত টাকা নেই, এখন নিয়োগ দেওয়া যাবে না। দুই বছর পর আমাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হলো। ২০০৩ সালে চাকরিতে যোগদান করলাম। প্রথম পদায়ন ছিল, কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায় বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের বাড়ির পাশে। অনেকেই বলতো এটা পানিশমেন্ট পোস্টিং—কথাটা সত্য। আমাদের চিকিৎসকদের মধ্যে কি একটা মনোভাব আছে জানি না! অনেকেই গ্রামে বেড়ে ওঠেন এবং পড়াশোনা করেন, তারা আবার গ্রামে চাকরি করতে অনিহা প্রকাশ করেন। এতে অসুবিধা যেটা হয়, নির্দিষ্ট সংখ্যক চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মী না থাকলে সীমিত সংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীর উপর চাপটা বেশি থাকে। 

হাওড় এলাকায় থাকতে আমি অনেক কাজ করেছি। চলে আসার মানুষের অতল ভালোবাসায় এটা উপলব্ধি করলাম। মিঠামইন থেকে আমি বগুড়া শহীদ জিয়া রহমান মেডিকেল কলেজে বদলি হলাম। তারপর এফসিপিএস পার্ট-ওয়ান, এমডি পার্ট-ওয়ান পাস করলাম। পাস করার পর তখন বেতন ছিল খুবই কম। আমাদের বেতন ছিল চার হাজার তিনশত টাকা। যখন ইনডোর মেডিকেল অফিসার (আইএমও) ছিলাম, তখন বেসিক বেতন ছিল ছয় হাজার আটশত টাকা। এখন তো সেই তুলনায় বেতন অনেক বেশি। যদিও এখন দ্রব্যমূল্যের দামও বেশি। এরপর লিয়েন নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাই। কিছু দিন পর দেশের টানে আবার ফিরে আসি। চাকরির ছয়বছরের মাথায় ষষ্ট গ্রেড পেয়ে যাই। তখন এটা ছিল রীতিমত অবিশ্বাস্য। 

এরপর আমাকে সরাসরি শ্রীমঙ্গলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) পদে দেওয়া হলো। এফসিপিএস এবং এমডিটা সম্পন্ন করার তীব্র ইচ্ছা ছিল। মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য প্রশাসনে চলে গেলাম, এরপর আর সেই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসতে পারলাম না। এর প্রথম কারণ ছিল কাজের চাপ। পরেরটা কাজের প্রতি ভালোবাসা। তখন কিভাবে সময় পার হত, টেরও পেতাম না। শ্রীমঙ্গলে তিন বছর থাকার পর আমাকে বদলি করা হলো কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে। এরপর পদায়ন পেয়ে চলে গেলাম জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানে। ইউএইচএফপিও হওয়ার আগেই পঞ্চম গ্রেড পাই। এরপর আমাকে পদায়ন করা হলো নেত্রকোনো জেলা সদর হাসপাতালে। সেখানে ছিলাম তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে। এরপর জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানে আমাকে আবার পদায়ন করা হয়।

মেডিভয়েস: আপনি বেশ দুর্গম ও গ্রাম্য পরিবেশে কাজ করেছেন, যেখানে অনেকেই যেতে চান না। বর্তমানে পরিবেশটা কেমন? এখনও কি নিরাপত্তাহীনতা ও সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতা রয়েছে?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: সুযোগ বলতে কয়েকটা জিনিস, যা সবাই চায়। প্রথমত নিরাপদ আবাসন, দ্বিতীয়ত কর্মক্ষেত্রে সম্মান ও নিরাপত্তা, তৃতীয়ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, চতুর্থ ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা। এগুলোর অভাবে তখন মিঠামইনে কেউ চাকরি করতে চাইতো না। এ ছাড়া সবাই চান, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অর্থাৎ অনেক বেশি উপার্জন। সারাদেশেই যেহেতু গড় আয় বেড়েছে। মানুষ এখন চিকিৎসকদের একটু টাকা-পয়সা দেয়। তখন সেসব জায়গায় মানুষ খুব একটা দিতো না বা পারতো না। তাদের মানসিকতা হলো সরকারি চিকিৎসকদের বিনা পয়সায় দেখতে হবে। অফিসিয়াল টাইমের বাইরে চিকিৎসকের যে একটা ব্যক্তিগত জীবন রয়েছে, এটা অনেকেই বুঝতে চান না। সেসব জায়গায় এখন পরিবর্তন হয়েছে। বিশেষ করে মিঠামইনে যাতায়াত ব্যবস্থার পরিবর্তনটা হয়েছে স্বপ্নাতীত।

মেডিভয়েস: সব চিকিৎসকদের একটা পর্যবেক্ষণ হলো—তরুণরা পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ডিগ্রিতে চলে আসায় তৃণমূলের জায়গাটা কোয়াকদের দখলে। এখন দেশে অনেক চিকিৎসক আছেন, ফলে এভাবে কি চিন্তা করা যায় যে, পোস্ট গ্রাজুয়েশনের চিন্তা বাদ দিয়ে গ্রামে একজন ভালো জিপি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবো?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: চমৎকার একটি প্রশ্ন। ৯০ ভাগ রোগীর চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন এমবিবিএস স্তরের পাশাপাশি ইন্টার্নশিপ যদি খুব ভালো করে করা হয়, তাহলে ৯০ ভাগ রোগী দেখার কোনো সমস্যা হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমার কাছে মনে হয়, আমাদের একটু ঘাটতি রয়ে গেছে। পড়াশোনা করি, জ্ঞান অর্জন করার জন্য। কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো দক্ষতা অর্জন, যা ইন্টার্নশিপ অবস্থায় করা উচিত। সেগুলো হলো: যোগাযোগ, শারীরিক ও চিকিৎসার দক্ষতা অর্জন। যেমন, একজন সড়ক দুর্ঘটনার রোগী আসলো, এমবিবিএস স্তরের চিকিৎসকের সে চিকিৎসা দেওয়ার যোগ্যতা থাকা উচিত। আজকাল চিকিৎসকরা এফসিপিএস-এমআরসিপি করতে চায়। এগুলো করতে গিয়ে তারা যে সময়টা পড়াশোনায় ব্যয় করেন, সেটা যদি ইন্টার্ন অবস্থায় দক্ষতা অর্জনে কাজে লাগাতেন, তাহলে ওই যোগ্যতা দিয়েই উপজেলায় ভালো চিকিৎসা দিতে পারতেন। উইলিয়াম ওসলার এবং হ্যারিসন একটা কথা বারবার বলতেন, মেডিসিন শিক্ষাটা শুধু বইয়ের কাছে গিয়ে শেখা যায় না, রোগীর কাছে গিয়ে শিখতে হয়। আমাদের আবারও উচিত উইলিয়াম ওসলার, ডেভিডসন ও হ্যারিসনসহ বিখ্যাত চিকিৎসকদের নৈতিক কথাগুলো খুব ভালো করে পড়া। 

রোগীরা উপজেলায় কোয়াকদের কাছে চিকিৎসা গ্রহণের পর বিশেষজ্ঞদের কাছে যান, জেনারেল প্রাক্টিশিয়ানের (জিপি) কাছে যেতে চান না। এর একটা কারণ হলো: আমাদের জিপিরা এখনও যোগাযোগে খুব দক্ষতা অর্জন করতে পারেননি। আমাদের চিকিৎসক এবং বাইরের দেশের চিকিৎসকদের মধ্যে এই জায়গাটায় বেশ পার্থক্য রয়েছে। দেখুন, আমরা মনে করি—বই পড়ে পড়ে পাস করাই ভালো চিকিৎসক হওয়ার শর্ত। কিন্তু বিদেশে শিখানো হয়, রোগীর চোখের দিকে তাকানো, মুখভঙ্গি, হাতের ভঙ্গি...। সেখানে একজন চিকিৎসক রোগীর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন কিনা, তার ওপর মার্কিং হয়। আমাদের দেশে এগুলোর ঘাটতি রয়ে গেছে—যিনি শেখেন এবং যিনি শেখান উভয়ের মাঝেই।

মেডিভয়েস: একজন তরুণ চিকিৎসক ইন্টার্ন অবস্থায় ১৫-২০ হাজার টাকা বেতন পান, যা খুবই কম। এত কম টাকায় ভালো স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব না। যারা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তারাও খুশি নন, এজন্য তারা শেখাচ্ছেন না। ব্যাপারটা কি শুধু টাকার উপর নির্ভরশীল, না অন্য কিছু জড়িত?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: টাকার উপর কিছুটা নির্ভরশীল তো বটেই। আমরা যখন ইন্টার্ন ছিলাম। তখন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তাদের মূল বেতন ছিল চার হাজার তিনশত টাকা। তখন আমাদেরকে দেওয়া হতো পাঁচ হাজার টাকা করে। সে হিসাবে একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার বেসিকের ২০ ভাগ বেশি বেতন দেওয়া হতো আমাদেরকে। যেহেতু এখন একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার প্রারম্ভিক মূল বেতন ২২ হাজার টাকা,  সে হিসাবে একজন ইন্টার্ন চিকিৎসককে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা ভাতা দেওয়া উচিত। কারণ একজন মানুষ তার প্রতিদিনের খরচের বিষয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারলেই মন মিশিয়ে কাজ করতে পারেন। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা মনে করেন, শিক্ষার্থীরা পোস্ট গ্রাজুয়েশনে গিয়ে শিখবে। অথচ শেখা উচিত এমবিবিএস স্তরে। এমবিবিএস স্তরের একটা সিলেবাস রয়েছে, বই রয়েছে। যিনি পরিপূর্ণ শিখান না, তিনি ঠিকমত দায়িত্ব পালন করেন না। শিখান না বলতে আমি (সহকারী অধ্যাপক, অধ্যাপক ও সহকারী রেজিস্ট্রার) কথা বলতে চাচ্ছি এবং ইন্টার্নরাও ওইভাবে শিখার আগ্রহবোধ করেন না। আরেকটি ব্যাপার হলো: বিদেশে যারা শিখেন, তারা খুব নম্র ও ভদ্র। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে কেমন যেন একটা উচ্চমার্গীয় ভাব রয়ে গেছে যে, আমরা কারও কাছে যাবো না, শিখতে চাইবো না। যিনি শিখতে চান তার নম্র হওয়া উচিত। প্রাচীনকালের একজন বিদ্যান ব্যক্তি বলেছেন, যিনি শেখাবেন, তারও নম্র হওয়া উচিত।

মেডিভয়েস: সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, অনেক চিকিৎসক অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স করাচ্ছেন। জিপি, ইসিজি এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উপর কোর্স। এসব কোর্সে ব্যাপক সংখ্যক চিকিৎসকের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে সবার মধ্যে শেখার আগ্রহ রয়েছে। অনলাইনে শেখাটাকে কিভাবে দেখছেন? অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ বাইরের দিকে ঝুঁকছে, তাহলে কি আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা দিতে ব্যর্থ? 

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: প্রথম কথা হলো—যেহেতু তারা অনলাইনে শিখছে,  আমার তো মনে হচ্ছে, বেশিরভাগের ইচ্ছা হলো ডিগ্রি নেওয়ার। আমার ধারণা, যারা শিখতে চাচ্ছেন—তারা এফসিপিএস বা এমআরসিপিএস পরীক্ষায় যেন খুব সহজে পাস করতে পারেন। যদি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য শেখেন—এটা খুবই ভালো। তবে অনলাইনে শেখার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো একজন শিক্ষকের কাছে সরাসরি শেখা। এর চেয়েও অনেক ভালো হলো প্রশিক্ষণ নেওয়া। আমি যদি তিনটা ভাগে ভাগ করি। তাহলে বলবো, কোনো রকম না শেখার চেয়ে অনলাইনে শেখা ভালো। অনলাইন শিক্ষার চেয়ে একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে আরও ভালো। তার চেয়ে ভালো হলো, ডেভিডসন বলতেন এবং চাইতেন, হাতে কলমে শেখা—সেটা। ইন্টার্ন অবস্থায় শিখার সুযোগ অনেক বেশি। তারা হয়তো চাইছেন, পরবর্তীতে প্রশিক্ষণ নিয়ে এ শূন্যতা পূরণ কবেন। এটা অবশ্যই ভালো, খারাপভাবে দেখার সুযোগ নাই। আমার মনে হয়, ছাত্র জীবনে সময় অপচয় না করে শেখার কাজে লাগালে নিজের প্রভূত উন্নতি হবে। 

মেডিভয়েস: সময় অপচয়ের অন্যতম কারণ কি এটা যে পাস করার পর বিসিএস হতে হবে, তাই এর প্রস্তুতি জড়িয়ে যাওয়া? আমরা দেখছি, দেশে অনেক চিকিৎসক, অথচ সে তুলনায় নিয়োগ কম। বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত অনেক চিকিৎসক ভালো মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। এ নিয়ে আপনার মতামত জানতে চাই?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: আমাদের দেশে কাজের চেয়ে চিকিৎসকের সংখ্যা অনেক, তবে বেশি শব্দটি আমি বলতে চাই না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি দশজন রোগীর জন্য প্রতি শিফটে একজন চিকিৎসক প্রয়োজন। যদি ২৫০ শয্যার একটি হাসপাতালে ২৫০ জন রোগী থাকে। প্রতি শিফটে ২৫ জন চিকিৎসক ইনডোরে থাকবেন। সে হিসাবে চার শিফটে ১০০ জন মেডিকেল অফিসার থাকা দরকার। অথচ ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ইনডোর মেডিকেল অফিসার আছেন দুই বা তিনজন। আর প্রতিটি জেলা হাসপাতালে চাইলেই ১০০ চিকিৎসকের পোস্ট তৈরি করা যায়। পদ সৃজন না করার কারণ চিকিৎসকদের মধ্যে একটা হতাশা রয়েছে। সেটা থেকে সরকার বের হতে চাচ্ছে। চিকিৎসকরা বেশি শিখবেন, ডিগ্রি অর্জন করবেন। আমার মনে হয়, চিকিৎসকদের হতাশা থেকে উত্তরণটা বেশি জরুরি।

মেডিভয়েস: এত বেশি চিকিৎসক রয়েছে, তাদেরকে গ্রামমুখী করে বেসরকারিভাবেও কোনো পদ্ধতি বের করা যায় না? 

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: সারা বিশ্বে একটা নিয়ম চালু রয়েছে। অথচ বিশ্বজনীন এ পদ্ধতি আমার দেশে নাই বললেই চলে। সেটা হলো: জিপি সিস্টেম। এটাকে আমেরিকায় বলে ফ্যামিলি মেডিসিন। কোনো রোগী শুরুতেই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে পারবেন না, যতক্ষণ না তাঁকে একজন জিপি দেখেন। জিপি রেফার করলে তিনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে পারবেন। আমার দেশে এখনও সে পদ্ধতি চালু হয়নি। এ কারণে লাফ দিয়ে মানুষ চলে যান প্রফেসরের কাছে, গিয়ে দেখবেন ভিজিট এক হাজার বা বারোশ’ টাকা। আর তখনই তিনি চিকিৎসকের সমালোচনা শুরু করে দেন। আমাদের দেশে যদি জিপিরা খুব দক্ষ হন। রোগীদের সঙ্গে আন্তরিক যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন, এক জায়গায় অনেকদিন থাকতে পারেন, আর এর সুবাদে সুনাম অর্জন করতে পারেন, অবশ্য এজন্য অনেক সময় লাগবে। এর পাশাপাশি এ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠায় সরকার যদি আন্তরিক সহযোগিতা করে, তাহলে দেশে চমৎকার একটি জিপি পদ্ধতি চালু হতে পারে। এতে চিকিৎসক এবং রোগী উভয়েই উপকৃত হবেন।

মেডিভয়েস: ঢাকায় অবস্থানরত সরকারি চিকিৎসকরা বেসিকের ৫৫ ভাগ বাসা ভাড়া পান আর উপশহরে ৪৫ ভাগ। বোঝাই যাচ্ছে, ঢাকায় টাকা বেশি, যদিও ঢাকায় খরচও বেশি। কিন্তু যারা জেলায় যাচ্ছেন তারাতো সব দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত। এসব বিষয় সামনে আসা দরকার?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: এ নিয়ে অবশ্যই চিন্তা করা উচিত। এত দিন যারা করেননি, তারা ভুল করেছেন। সংবিধানে একটা কথা রয়েছে, পিছিয়েপড়া মানুষকে সেবার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। পিছিয়েপড়া মানুষগুলো গ্রামাঞ্চলের। যেসব চিকিৎসক তাদের সেবা দিতে যাবেন, তাঁদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য দুর্গম ভাতা চালু করা উচিত। এ বিনিয়োগ চালু করলে সরকার অনেক বেশি ফল পাবে। এ ধরনের ভাতা চালু করা উচিত।

মেডিভয়েস: সরকারি চাকরিতে প্রবেশের অল্প সময়ের মধ্যেই চিকিৎসকরা হতাশ হয়ে যান, এর পেছনে কী কী কারণ আছে বলে মনে করেন?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: একজন মানুষের মৌলিক প্রয়োজন হলো—একটা আবাসন, সুন্দর অফিস, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা এবং নির্ধারিত সময়ের পর পদায়ন। একজন চিকিৎসক যখন দেখেন, অন্য বিভাগের কর্মচারীদের বাসাটা খুব সুন্দর, তার বাসাটা ভাঙা; এতে তার উৎসাহ কমে যায়। যখন দেখেন তারই মতো প্রবেশনারি অফিসারের অফিসটা খুব চমৎকার। তার সাথে একজন পিয়ন আছে, সুন্দর বাহন আছে, অথচ তাঁর বিপরীতে নিজের রুমটা ভাঙা, বসার চেয়ার নেই, তখন তিনি কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। কয়েক বছর পর যখন অন্য বিভাগের একজন সহকর্মী পদায়ন পেয়ে ষষ্ট গ্রেডে চলে যান আর তিনি দিন-রাত পড়াশোনা করে ডিগ্রি অর্জন করেও পদায়ন পাচ্ছেন না। তখন তাঁকে হতাশা ঘিরে ধরে। শুধু হতাশাই না, বরং তার সঙ্গে সেসব জুনিয়র এবং সহকর্মী থাকেন—তারাও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ তৎপর হলে অবশ্যই এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

মেডিভয়েস: স্বাস্থ্য ক্যাডারে কর্মরতদের প্রত্যাশা অনুযায়ী পদায়ন না পাওয়ার পেছনে কী কারণ আছে বলে মনে করেন?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া যোগ্য ব্যক্তি হলেন, যারা সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন, কারণ তারা আমার চেয়ে অভিজ্ঞ। আমরা চাকরি করছি, ভুক্তভোগীরা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি মনে করি, এগুলো অবশ্যই পরিবর্তন করা সম্ভব। সরকার যদি ডিভোটেড লোকগুলো বাছাই করে নিয়ে আসে, মন-প্রাণ দিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অনেক লোকই পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে আমি বলতে চাচ্ছি, পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য।

মেডিভয়েস: গত ৭/৮ বছর ধরে একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। তরুণ স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের অনেকেই ডিজিএইচএসে পদায়ন নিচ্ছেন এবং অনেকেই অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন। আপনারা তো অনেক আগে থেকেই এ বিষয়গুলো বলে আসছেন। এখন সিনিয়র ও তরুণ অফিসারদের মধ্যে সমন্বয় কি যথাযথভাবে হচ্ছে?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: অনলাইন সিস্টেম চালু এবং আমাদের তরুণ অফিসারদের এগিয়ে আসার কারণে যোগাযোগটা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। তবে আরও আধুনিকায়ন হওয়া দরকার। আমরা এখনও দেখছি, যারা ডিজি অফিসে কাজ করেন এবং যারা প্রশাসনে কাজ করেন তাদের কাজের চাপটা অনেক বেশি। তারা যে একটু সময় বের করে অন্য কাজের উন্নয়নে সময় দিবেন—তা পারছেন না।

ডিজি অফিসে অনেক মেডিকেল অফিসার আছেন। সেখানে আরও অনেকগুলো বিভাগ খোলা উচিত। যেমন: হিউমেন রিসোর্স, শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণের ব্যাপারে আলাদা ডিরেক্টরি থাকা উচিত। যেখানে ডিরেক্টর থাকবেন, সেখানে কয়েকজন উপ-পরিচালক থাকবেন, সেখানে সহকারী পরিচালক থাকবেন। মেডিকেল অফিসারও থাকবেন। 

মেডিভয়েস: স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন অর্জন দেখে আমরা আশা করতে পারি হেলথ পদ্ধতিতে একটা পরিবর্তন আসবে? আপনার কাছে এমন কোনো পর্যবেক্ষণ আছে?

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: আমি আশাবাদী, এটা সত্য। কারণ আমি স্বাস্থ্য ক্যাডারের কয়েকজন মানুষকে দেখেছি। যারা এ নিয়ে অনেক বেশি ভাবেন এবং কাজ করেন। আপনি হয়তো সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়োগ বিধিমালা ২০১৮ দেখে থাকতে পারেন। সেখানে লেখা আছে, তিন বাহিনীর প্রধান নিয়োজিত হবেন তিন বছরের জন্য। এখন দেখছি, পুলিশ বাহিনীর প্রধানকেও নিয়োগ দেওয়া হয় তিন বছরের জন্য। একজন অফিসার তিন বছরের কম সময় পদে থাকলে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারেন না, বাস্তবায়নও করতে পারেন না। বুঝে শুনে উঠতেই ছয় থেকে সাত মাস চলে যায়। আমি মনে করি, আমাদের স্বাস্থ্য ক্যাডারেও এক একজন কর্মকর্তা যিনি অফিস প্রধান হবেন, তাকে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেওয়া উচিত এবং তাকে কিছু লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া উচিত। তিনি যখন নিশ্চিত হন যে, তিন বছর এখানে থাকতে পারবেন। তখন তিনি নিশ্চিন্তে কাজটা করতে পারেন। ওই কর্মকর্তা যখন জানবেন, তিন বছর পর তার কাজের উপর মূল্যায়ন হবে এবং পদায়ন হবে। তখন তিনি নিঃসন্দেহে নিবেদিত হয়ে কাজ করবেন। 

মেডিভয়েস: স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগ দেওয়া তরুণ মেডিকেল অফিসারের জন্য আপনার পরামর্শ জানতে চাই? 

ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো: আমাদের দেশে চাকরিকে অনেকেই বাংলা শব্দ চাকরের মতো মনে করেন। এটি ভুলে যেতে হবে, বরং এটাকে মনে করতে হবে সেবা। আমাদের সংবিধানে বা সরকারি চাকরির বিধিমালাতে কোথাও চাকরিকে জব বলা হয়নি, বলা হয়েছে সেবা। তার মানে এটা সেবা। তারা যেন নিজেদেরকে চাকর মনে না করেন। তারা যেন মনে করেন, তারা দেশকে সেবা দিতে যাচ্ছেন, জনগণের সেবা দিতে যাচ্ছেন। একজন ক্লাস ওয়ান অফিসারকে আমরা খনি থেকে তোলা মণিপদ স্বর্ণের মতো দেখি। সেখানে ধাতুমল থাকে, স্বর্ণ থাকে—তা পরিষ্কার করতে হয়। সুতরাং যেসব চিকিৎসক সরকারি চাকরি করবেন, তাদেরকে আমি ধাতুমলের মতো মনে করি। তাদের মধ্যে অনেক ভালো গুণ আছে। অনেকের মধ্যে স্বর্ণের মতো যোগ্যতা আছে, কারও রৌপ্যের মতো। পাশাপাশি তাদের মধ্যে ধাতুমল বা কিছু অপদ্রব্যও আছে। এজন্য তাদেরকে খুব ভালো করে প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত, যেন তাদের সুন্দর গুণাবলীগুলো ভালোভাবে বিকশিত হয় এবং খারাপ গুণাবলীগুলো ঝরে পড়ে যায়। সরকারের প্রতি আমার প্রথম দাবি, তাদেরকে যেন ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তরুণ চিকিৎসকদের প্রতি পরার্মশ হলো, তাঁরা যেন অবশ্যই হতাশ না হন। হতাশা জীবনটাকে কুড়ে কুড়ে খেয়ে ফেলে। জীবনটা কোনো স্থির জিনিস নয়, এটি চলমান। জীবন সবসময় সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। সুতরাং তারা হতাশ না হয়ে কাজ করে যাবেন। তাহলে তারা অবশ্যই মানুষের ভালোবাসা অর্জন করতে পারবেন। আমি অনেকের কথাই বলতে পারবো, যারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন এবং মানুষের প্রচণ্ড ভালোবাসা পাচ্ছেন। আমরা যদি অন্তর দিয়ে মানুষের সেবা করি আল্লাহও খুশি হবেন, জনগণও খুশি হবেন এবং সরকারও খুশি হবেন। 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
করোনা ও বার্ধক্যজনিত অসুস্থতা

এক দিনে চিরবিদায় পাঁচ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক