গর্ভাবস্থায় রুবেলায় সংক্রমিত হলে শিশুর ভয়াবহ পরিণতির শঙ্কা
মেডিভয়েস ডেস্ক: রুবেলা বা রুবিওলা হলো মোরবিলি ভাইরাসঘটিত অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি রোগ। এটি অনেকটা কোভিডের মতোই আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি কাশির ড্রপলেট থেকে ছড়ায়। এর সাথে হামের কিছু মিল আছে। যেমন, সংক্রমণের ফলে শরীরে লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি দেখা দেয়। একে জার্মান হাম বা তিন দিনের হামও বলা হয়।
রুবেলার সবচেয়ে ভয়ের দিকটি হল আপনি এতে আক্রান্ত হলেও শুরুতে কিছুই টের পাবেন না। কারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগে ভাইরাসটি রোগীর দেহে সাত থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সুপ্তাবস্থায় থাকতে পারে।
এটি যদিও খুব জটিল রোগ নয় তবে কোনও মা গর্ভাবস্থায় সংক্রমিত হলে এর পরিণতি শিশুর জন্য ভয়াবহ হতে পারে। এ ছাড়া শিশুরা আক্রান্ত হলে এটি তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
লক্ষণ
ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের তথ্য মতে, রুবেলার কিছু সাধারণ লক্ষণ রয়েছে।
১. লাল বা গোলাপি ফুসকুড়ি, যা সামান্য উঁচু হয়। তবে সংক্রমণের পর ফুসকুড়ি দেখা দিতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগে। ফুসকুড়ি কানের পিছনে শুরু হয় এবং পরে মাথা, ঘাড় ও শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা কঠিন হতে পারে, তবে শরীরের চামড়া ধরে দেখলে রুক্ষ বা আঁশযুক্ত বোধ হতে পারে
২. মাথা ও ঘাড়ের পেছনের গ্রন্থি ফুলে যাওয়া এবং ব্যথা হওয়া, কানের পিছনের লিম্ফ নড পিণ্ডর মতো ফুলে যাওয়া
৩. জয়েন্টে ব্যথা, বিশেষ করে; আঙ্গুল, কব্জি বা হাঁটুতে ব্যথা
৪. জ্বর
৫. হাঁচি-কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়া
৬. মাথাব্যথা, গলা ব্যথা
৭. শরীরে কালশিটে
৮. চোখ-মুখ ফুলে যাওয়া, চোখ চুলকানো, চোখ লাল হয়ে যাওয়া
৯. শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা
১০. ক্ষুধা মন্দা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা
চিকিৎসা
রুবেলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ নেই। চিকিৎসকরা সাধারণত উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। রুবেলা মূলত মাঝারি ধাঁচের রোগ। ভাইরাসটি প্রথমে শ্বাসনালীতে সংক্রমিত হয়, এরপর রক্তের মাধ্যমে দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
যা কোনো চিকিৎসা ছাড়াই সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়।
১. তবে রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় লক্ষণ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে হবে
২. প্রচুর বিশ্রাম নিতে হবে এবং এই সময় পরিশ্রমের কাজ না করাই ভালো
৩. স্বাভাবিক খাবারদাবারের পাশাপাশি রোগীকে প্রচুর পানি ও তরল জাতীয় খাবার খেতে দিতে হবে
৪. খাবারের তালিকায় ভিটামিন ‘এ’ ও ‘সি’ যুক্ত ফল রাখা গেলে ভালো হয়
৫. জ্বর হলে ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর বার বার মুছে জ্বর কমানোর চেষ্টা করতে হবে
৬. প্রতিদিন গোসল করাতে হবে
৭. কোনো ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে
৮. চোখের উপর চাপ সৃষ্টি হয় এমন কাজ এড়িয়ে চলতে হবে। যেমন; লম্বা সময় মোবাইল ব্যবহার করা অথবা ছোট অক্ষরে লেখা পড়া
গর্ভাবস্থায় রুবেলা
বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে রুবেলার উপসর্গ খুব একটা জটিল হয় না। কিন্তু কেউ যদি গর্ভবতী অবস্থায় আক্রান্ত হন তবে রুবেলা অনাগত শিশুর ক্ষতি করতে পারে:
১. এতে মায়ের গর্ভপাতের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়
২. শিশুর জন্মের পরে তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে: চোখে ছানি পড়া, গ্লোকমা, দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া, ত্রুটিপূর্ণ চোখের গঠন, অন্ধত্ব
৩. শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া বা বধিরতা
৪. জন্মগত হার্টের জটিলতা
৫. মস্তিষ্কে সমস্যা, মাথার আকার ছোট বা মানসিক ভারসাম্যহীনতা
রুবেলা ভাইরাসের কারণে হওয়া এসব জন্মগত ত্রুটি কনজেনিটাল রুবেলা সিনড্রোম বা সিআরএস নামে পরিচিত। গর্ভাবস্থায় যত শুরুর দিকে সংক্রমণ হবে, ঝুঁকি তত বেশি। সিআরএস প্রতিরোধে কার্যকর কোনও চিকিৎসা নেই। তবে গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ পরে যদি গর্ভবতী রুবেলা আক্রান্ত হন তবে সিআরএস হওয়ার ঝুঁকি তেমন থাকে না।
২০ সপ্তাহের মধ্যে কোনো গর্ভবতী নারী রুবেলা আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এলে তাকে ইমিউনোগ্লোবিউলিন দেওয়া হয়ে থাকে।
প্রতিরোধ
রুবেলার যেহেতু সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। তাই রুবেলাকে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা খুব জরুরি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ বলছে, রুবেলা প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকরী উপায় হলো, হাম-মাম্পস-রুবেলা (এমএমআর) টিকার দুই ডোজ টিকা প্রয়োগ। এই টিকা রুবেলা প্রতিরোধে নিরাপদ এবং অত্যন্ত কার্যকর। সব বয়সেই এই টিকা নেওয়া যায়।
বাংলাদেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির অধীনে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি রুবেলা প্রতিরোধেও টিকা দেওয়া হয়। টিকার প্রথম ডোজ সাধারণত শিশুর নয় থেকে ১৫ মাসের মধ্যে দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয় শিশুর সাড়ে তিন থেকে ছয় বছর বয়সের মধ্যে। এ ছাড়া প্রাপ্তবয়স্করা এই টিকা নিতে পারেন। সাধারণত প্রথম ডোজ নেওয়ার কমপক্ষে এক মাস থেকে তিন মাস পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়। বিশেষ করে গর্ভধারণের আগে মেয়েরা যথেষ্ট রুবেলা প্রতিরোধী কিনা দেখে নিতে হবে।
যদি কারও রক্তের অ্যান্টিবডি পরীক্ষায় আইজিজি পজিটিভ আসে, তাহলে বুঝতে হবে, তিনি আগে রুবেলায় আক্রান্ত হয়েছেন। তার শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে। এজন্য টিকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে আইজিজি নেগেটিভ আসা মানে তিনি আগে আক্রান্ত হননি, ভবিষ্যতে আক্রান্ত হতে পারেন। সেক্ষেত্রে টিকা নিয়ে নিতে হবে। গর্ভধারণের আগে টিকা নেওয়াই বেশি নিরাপদ। চেষ্টা করতে হবে টিকা নেওয়ার এক মাসের মধ্যে গর্ভবতী না হতে। তবে কেউ যদি গর্ভাবস্থায় দেখেন রক্ত পরীক্ষা নেগেটিভ এসেছে তাহলে সন্তান জন্ম দেওয়ার পর টিকা নিতে পারেন। এতে শিশু দুধ পানে সমস্যা হবে না। গর্ভকালীন সময়ে মাকে সাবধান থাকতে হবে যেন এই রোগের সংক্রমণ না হয়।
এই টিকা রুবেলার বিরুদ্ধে আজীবন সুরক্ষা প্রদান করে। টিকার কারণে অনেক দেশে রুবেলা সংক্রমণ বিরল এমনকি অস্তিত্বহীন।
রুবেলার সংক্রমণ এড়ানোর উপায়
রুবেলার লক্ষণ দেখা দেওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকে এবং লক্ষণ দেখা দেওয়ার পাঁচ দিন পর পর্যন্ত এই রোগের সংক্রমণ ছড়াতে থাকে। এই রোগ মূলত হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায়। সে কারণে...
১. অসুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এড়িয়ে চলতে হবে
২. আপনি যদি নিজে সংক্রমিত হন এবং যেহেতু সংক্রমণের প্রভাব কিছু লোকের জন্য গুরুতর হতে পারে, তাই চেষ্টা করতে হবে আপনার মাধ্যমে যেন রোগটি না ছড়ায়
৩. ফুসকুড়ি দেখা দেওয়ার পরে পাঁচ দিনের জন্য স্কুল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, বাজার, ধর্মীয় উপাসনালয় বা জনসমাগম হয় এমন জায়গায় যাওয়া বন্ধ রাখতে হবে
৪. একটু পর পর হাত সাবান পানি দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে ধুয়ে নিতে হবে
৫. নাকে, চোখে, মুখে হাত দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে
৬. কাশি বা হাঁচির সময় টিস্যু ব্যবহার করে ব্যবহৃত টিস্যু ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হবে
৭. আক্রান্ত ব্যক্তির বাসন-কোসন, তোয়ালে, জামাকাপড় বা বিছানা আলাদা রাখতে হবে
৮. আগে টিকা নেয়া না থাকলে রুবেলা প্রাদুর্ভাবের এলাকায় যাওয়ার আগে টিকা নিতে হবে
৯. যাদের ফুসকুড়ি আছে বা অজানা অসুখ থাকতে পারে বলে মনে হচ্ছে, তাদের সাথে শারীরিক যোগাযোগ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে
আপনি যদি মনে করেন, আপনি এমন কারো সংস্পর্শে এসেছেন যার রুবেলার লক্ষণ আছে, যেমন ফুসকুড়ি, সেইসাথে গর্ভাবস্থায় যদি আপনার শরীরে ফুসকুড়ি হয়, তাহলে সরাসরি চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সূত্র- বিবিসি