ডা. ফাহমিদা শিরীন নীলা
এমবিবিএস; বিসিএস (স্বাস্থ্য), এফসিপিএস (গাইনি এন্ড অবস্)
ফিগো ফেলো (ইতালি)
গাইনি কনসালটেন্ট,
পপুলার ডায়াগনোস্টিক সেন্টার, বগুড়া
কালচারাল সেক্রেটারি, ওজিএসবি, বগুড়া
১১ নভেম্বর, ২০২২ ০৪:১১ পিএম
মেনোপজে হাড় ক্ষয় এড়াতে চাই সচেতনতা
প্রথমেই একটা কথা জেনে রাখা উচিত, মেনোপজ কোনো রোগ বা সমস্যা নয়। এটি নারী জীবনের একটি অধ্যায়। বর্তমানে মানুষের আয়ুষ্কাল বেড়ে যাওয়ায় নারীদের এক তৃতীয়াংশই চলে গেছে মেনোপজের আওতায়। আর ঠিক এ কারণেই আমাদের এ বিষয়ে সচেতনতাটা হয়ে পড়েছে জরুরি।
মেনোপজ কেন হয়, তা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। এ সময় মূল যেটি ঘটে তা হল, শরীরে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ কমে যাওয়া। আর এতেই ঘটতে থাকে যত ধরনের বিপত্তি। এর মধ্যে সবচেয়ে অধিক যে বিপত্তিটি আমাদের মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেটি হলো, হাড়ের ক্ষয়।
সাধারণভাবে হাড়ের ঘনত্বের কথা যদি বলি, তাহলে নারী তার বিশ থেকে ত্রিশের মাঝামাঝি বয়সে এ দিক থেকে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে থাকে। এরপর আস্তে আস্তে পঁয়ত্রিশের দিক থেকে এটা কমতে থাকে।
হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ে কিসে?
আমরা প্রথমেই জেনে নিই, হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ে কিসে? অনেক অনেক কারণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কারণ হলো- বয়স বেড়ে যাওয়া, পারিবারিক ইতিহাস, ভিটামিন ডি ঘাটতি, ক্যালসিয়ামের ঘাটতি, ধূমপান, এলকোহল গ্রহণ, কম ওজন ও জীবনযাত্রার স্টাইল ইত্যাদি।
মেনোপজের সাথে হাড় ক্ষয়ের সম্পর্ক
এখন আসি আসল কথায়। মেনোপজের সাথে হাড় ক্ষয়ের কি সম্পর্ক? সাধারণভাবে হাড়ের ক্ষয় রোধে ইস্ট্রোজেনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। মেনোপজে যেহেতু মাত্রাতিরিক্তভাবে ইস্ট্রোজেন কমে যায়, তাই বেড়ে যায় হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি। একদিকে নতুন হাড়ের টিস্যু তৈরি হওয়া বন্ধ হয়ে যায়, অন্যদিকে পুরনো হাড়ের টিস্যুর স্থাপত্যশৈলীর অবনতি ঘটতে থাকে। সামগ্রিক হাঁড়ের পুরুত্ব কমতে থাকে যার ফলশ্রুতিতে হাড় হয়ে উঠে ভঙ্গুর। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন বেড়ে যায় হাড় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি।
মেনোপজে অধিক ঝুঁকিতে যেসব অঙ্গ
মেনোপজে সবচেয়ে বেশি ভাঙার ঝুঁকিতে থাকে কব্জি, হিপ ও স্পাইনের হাড়। আমরা আশপাশে বয়স্ক মহিলাদের অনেককেই কুঁজো হয়ে লাঠির উপরে ভর করে হাঁটতে দেখি। এর মূল কারণই হলো, পিঠের স্পাইনের হাড় ক্ষয়।
ভয় পেয়ে গেলেন? না, ভয়ের কিছু নেই। যদি আমরা সময়মত সচেতন হই, তাহলে এই ভয়কে সহজেই অনেকাংশে জয় করতে পারবো।
হাড় ক্ষয় রোধে কিছু টিপস
১. আমরা বেশীরভাগ মেয়েই সারাজীবন নিজের শরীরটাকে উপেক্ষা করি। ভেবে রাখি, বয়স হোক তখন না হয় যত্ন নেবো। না, এটা আমাদের ভুল ধারণা। এই যে আমি আপনি আমরা সারাজীবন নিজের শরীরে একটু একটু করে ঘাটতি তৈরি করছি, এটাই একদিন বড় আকার ধারণ করে হাড় ক্ষয়ের মতো ভয়ানক সমস্যা উপহার নিয়ে আসবে আমাদের জীবনে। পিরিয়ডের সময়, সন্তান ধারণ, সন্তান প্রসব, সন্তানের লালন-পালন দুগ্ধদানের সময় আমাদের শরীর থেকে ক্যালসিয়াম বা অন্যান্য মিনারেল চলে যাচ্ছে, আমরা সেটা কখনোই আমলে নেই না। ফলে ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে হাড়ের ঘনত্ব। সুতরাং, সময় মতো নিজের শরীরের ঘাটতি পূরণ করুন।
-পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। উদাহরণস্বরূপ দুধ বা দুধের তৈরি পণ্য, যেমন- দই, পুডিং, চিজ, মিষ্টান্ন, সিরিয়াল ইত্যাদি, সবুজ শাক-সব্জি, মাছ বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, সয়াবিন, শস্যদানা, বাদাম, বীজের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ক্রাইসিসের সময়গুলোতে যেমন- গর্ভধারণ কিংবা ব্রেস্ট ফিডিংয়ের সময়গুলোতে সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা জরুরি।
-হাড়ের জন্য ভিটামিন ‘ডি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য সানবাথ (রোদ পোহানো) করুন। সকাল বিকেলের হালকা রোদ নয়, বরং কিছুটা কড়া রোদে দিনের অল্প কিছু সময় ব্যয় করুন। এতে আপনার শরীরের চামড়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ‘ডি’ উৎপন্ন করবে। সাথে ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাবার খেতে পারেন।
- ভিটামিন ‘কে’ সমৃদ্ধ খাবার খান। যেমন- সবুজ শাকসব্জি, গাজর, বাঁধাকপি, পাতাকপি, পালংশাক, দুধ, ডিম, কলিজা, সিরিয়ালস, লেটুস, পার্সলে, টমেটো, এভোকাডো, আলুবোখারা, ব্লুবেরী, ব্ল্যাকবেরি ও কিউই ইত্যাদি।
২. হজম প্রক্রিয়া সচল রাখার জন্য সময় থাকতেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। তা না হলে আপনি যত সমৃদ্ধ খাবারই খান না কেন, হজমের অভাবে তা কিছুই আপনার শরীরের কাজে আসবে না।
৩. জীবনযাপন পদ্ধতি বা লাইফস্টাইলে পরিবর্তন আনুন। নিয়মিত হাঁটা, ব্যায়াম ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরটা সচল রাখুন। এতে হাড় মজবুত হবে। বাড়বে হাড়ের ঘনত্ব।
৪. স্ট্রেস বা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা পরিহার করুন। মনে রাখবেন, স্ট্রেস আপনার হজমে সমস্যা সৃষ্টি করবে। কর্টিসল নামক এক ধরনের হরমোন নিঃসরণ করবে, যা আপনার গ্রহণ করা ক্যালসিয়াম হজমে বাঁধা সৃষ্টি করবে।
৫. কিছু জিনিস আপনার খাদ্যতালিকা থেকে পরিহার করুন, যেগুলো কোনো না কোনোভাবে আপনার রক্তে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। যেমন- ক্যাফেইন, সিগারেট, এলকোহল ও অধিক লবনযুক্ত খাদ্য ইত্যাদি।
৬. অনেকেই কিছু ওষুধ লম্বা সময় ধরে গ্রহণ করেন, যেগুলো পক্ষান্তরে হাড় ক্ষয়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে স্টেরডেয়ের কথা। এ ছাড়া এসিডিটির জন্য যেসব ওষুধ সাধারণত আমরা খাই, যেমন- ওমিপ্রাজল, পেন্টোপ্রাজল, ইসোমেপ্রাজল, রেনিটিডিন, ফেমোটিডিন, এন্টাসিড ইত্যাদি। এ ছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য যে ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়, যেমন- ডিপো প্রোভেরা, ব্রেস্ট ক্যান্সারের ওষুধ, অতিমাত্রায় থাইরয়েড হরমোন রিসপ্লেসমেন্ট ড্রাগস, খিঁচুনি বা মুড পরিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত এন্টিসাইকোটিক ড্রাগস, ডাইইউরেটিস যেমন ফ্রুসেমাইড (ল্যাসিক্স/ফুসিড), ক্যান্সার কেমোথেরাপি, হেপারিন, কিছু এন্টিহাইপারটেনসিভ এবং এন্টিডায়াবেটিক ড্রাগস, নারকোটিকস, যেমন- মরফিন ইত্যাদি ওষুধসমূহ ক্যালসিয়াম এবজরপসনে বাঁধা দিয়ে হাড়ের ক্ষয়ে সাহায্য করে। সুতরাং, দীর্ঘ সময় ধরে কোন ওষুধ গ্রহণ করলে সেটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অবশ্যই আপনার ডাক্তারের কাছে জেনে নিন।
৭. উদ্বেগের বিষয় হলো, কিছু খাবার যেগুলোতে অক্সালেটস বা অক্সালিক এসিড আছে সেগুলোও ক্যালসিয়াম হজমে বাঁধা দেয়। যেমন- পালং শাক, রেউচিনি, মটরশুঁটি, গমের ভূষি ও মিষ্টি আলু ইত্যাদি। এমনকি এই তালিকায় চকলেটের নামও আছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত চিনিও ক্যালসিয়াম অধিক মাত্রায় নিষ্কাশন করে, সুতরাং এটিও পরিতাজ্য।
অবশিষ্ট কিছু কথা। মেনোপজ নারীর জীবনের শেষ অধ্যায় হলেও শুরু থেকেই এ সম্পর্কে জানুন, সচেতন হোন, সতর্ক হোন। তাহলেই দেখবেন খুব স্বাভাবিকভাবেই এর জটিলতাগুলো এড়িয়ে উপভোগ করতে পারছেন আপনার জীবনের শেষ অধ্যায়টুকু। মেনোপজ আসার আগেই হাড়ের স্বাস্থ্যের ব্যাপারে যত্নবান হোন। লাঠির উপরে ভর করে নয়, জীবনের শেষ দিনগুলো নিজের উপরে ভর করে চলুন।
শুরু থেকে শেষ অবধি জীবনের একেকটা অধ্যায় একেক রকম সুন্দর। সচেতন হোন, উপভোগ করুন নারী জীবনের প্রতিটি অধ্যায়। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।