মানসিক সংকটাপন্নদের উপেক্ষায় বাড়ছে আত্মহত্যা

আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবারই সচেতন হওয়া জরুরি। মহামারি আকার ধারণ করা এ ‘অসুখ’ থেকে সুরক্ষায় একে অন্যের আবেগ-উচ্ছ্বাস, সুখ-দুঃখে মনোযোগ বাড়াতে হবে। কারণ আমাদের চারপাশের অনেকে অনুভূতিগুলো বলার ক্ষেত্র না পাওয়ায় উদ্বেগ, দুঃখ ও হতাশা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার নির্মম পথ বেছে নেয়। এ মিছিল ক্রমাগতভাবেই বাড়ছে।
এ ব্যাপারে একটি বিষয় আমাদের সবার কাছেই পরিষ্কার থাকা জরুরি, আর তাহলো- আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য অসুখ বা অবস্থা। এই বার্তাটি যদি সবার মধ্যে পৌঁছে দেওয়া যায়, তাহলে আমাদের (মনোরোগ বিশেষজ্ঞ) কাজ অর্ধেক সম্পন্ন হয়ে যাবে।
এই আত্মহত্যার প্রবণতা যে কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তা একটি পরিসংখ্যানের দিকে নজর দিলেই বোঝা যাবে। একাধিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, করোনায় বছরে যতজন মানুষ মারা গেছে, তার চেয়ে ৪-৬ গুণ বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। অথচ করোনা নিয়ে আমাদের কত সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ, প্রস্তুতি, টিকাদান কর্মসূচিসহ আরও কত কর্মসূচি যে হাতে নেওয়া হয়েছে, তার কোনো শেষ নেই।
করোনায় আক্রান্ত হওয়াটা (জ্বর-কাশি) পরিবারের সদস্যদের নজরে পড়ছে। স্বজনেরা তাকে হাসপাতালে নিচ্ছে, চিকিৎসকগণ দেখতে পারছেন। ফলে করোনা নিয়ে আমরা প্রতিরোধের জায়গাটা তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছি। বিপরীতে আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তি যেমন তার মনের সংকটের কথা বলেন না, অন্যদিকে পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে গুণগত সময় দেন না। সাহস করে যারা মনের সংকটের খবর দেন, তাদেরকে ‘ভান করছে’ অথবা ‘মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছে’, ইত্যাদি বলে তাচ্ছিল্য করা হয়। আর এ পথ ধরে আত্মহত্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ছে, এটা মহামারিকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এক বছরে আত্মহত্যা বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার
গত ২০১৯ সালে দেশে আত্মহত্যার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার, সেটা ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। এক বছরের ব্যবধানে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। এটা রীতিমত মহামারী রূপ নিয়েছে। আমাদের এই জায়গাটা আলোচনায় নিয়ে আসতে হবে।
আত্মহত্যা বিষয়টা এমন না যে, এটা সাম্প্রতিক সময়ে খুব হচ্ছে। এটা যুগের পর যুগ ধরে হয়ে আসছে। কিন্তু এই সময়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে পুরো পৃথিবীকে নাড়া দেওয়া করোনাভাইরাস। এই মহামারি পুরো পৃথিবীকে একেবারে স্তব্ধ করে দিয়ে গেছে। পড়াশোনা থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, মানসিক সব জায়গায় এর প্রভাব পড়েছে।
মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে বিষয়টা এতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থেকে শুরু করে সব কিছুতে এর আঘাত লেগেছে। কেউ চাকরি হারিয়েছে, কারও পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, কোনো পড়াশোনা করা মেয়ের হয়তো বিয়ে হয়ে গেছে। বাসার একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হয়তো ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন, হয় তো তার চাকরিটা চলে গেছে। বাসার গৃহবধূর ওপর এসব সমস্যা হয়তো বেশ আঘাত হেনেছে। যে কারণে পারিবারিক কলহ বেড়ে গেছে।
প্রতিটি জায়গায় এবং আমাদের সার্বিক সামাজিক অবস্থাকে এই যে করোনার ধাক্কা, এটা আত্মহত্যার ক্ষেত্রে অনেকখানি প্রভাব ফেলছে।
মেডিকেল শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে বিষণ্ণতা
মেডিকেল শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যায় ঝুঁকে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ আছে। আত্মহত্যা করার পেছনে ৯০-৯৫ ভাগ কারণ হলো মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি। এর মধ্যে ৮০ বা ৯০ ভাগ কারণ হচ্ছে বিষণ্ণতা। মেডিকেল শিক্ষার্থীরা অধিকাংশ সময়ই বিষণ্ণতায় ভুগে।
কারণ, পড়াশোনার জন্য প্রতিনিয়ত তাদের চাপে থাকতে হয়। মেডিকেলে প্রতিদিনই কোননা কোন আইটেম থাকে, যেটা ২৫ মার্কের হয়ে থাকে। ৩ মাস পর একটা কার্ড, ২ বছর পর প্রফেশনাল পরীক্ষা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া বলতে সাধারণত যা বোঝায়—ঘুরে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া, আনন্দ-ফুর্তি করে বেড়ানো, এটা আসলে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে হয় না। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পড়াশোনার চাপটা স্কুল কলেজের মতোই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকে বাধ্য হয়েই মেডিকেলে পড়তে আসে। তাকে মেডিকেলেই পড়তে হবে, হয়তো পরিবার থেকে এমন চাপ থাকে। কিন্ত নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পড়াশোনার এত চাপ সামলানো অনেকের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
আবার অন্যদিকে বুয়েট কিংবা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেখানে গ্রাজুয়েশন শেষ হয় চার বছরে, সেখানে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নিসহ ছয় বছর লেগে যায়। একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর বুয়েটে পড়ুয়া বন্ধু যখন গ্রাজুয়েশন শেষ করে স্মার্ট বেতনে চাকরি করে তখন হয়তো ওই শিক্ষার্থীকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন কিভাবে সম্পন্ন করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হয়। একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার আগেই তার বন্ধুটির চাকরিতে এক বছরের অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। আবার পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে গিয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে অনারারি করতে হয়। এর ফলে চাপটা দিন দিন বাড়তে থাকে।
যে বয়সে তার একটা সুন্দর সংসার থাকার কথা, বাচ্চা থাকার কথা সে বয়সে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে হয়। নানাবিধ চাপ থাকা সত্ত্বেও তাদের পড়াশোনা ঠিকমতো চালিয়ে যেতে হয়। কারণ পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করা ছাড়া তারা কিছু করতে পারেন না। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের এই জায়গায় এসে বাবা-মা’র ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। কিন্ত সবার বাবা-মা তো আর অথনৈতিকভাবে সামর্থ্যবান না, তাই পরিবার থেকে সবাই আর্থিক সহযোগিতা পায় না। ফলে অনেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে গিয়ে গভীরভাবে হতাশ হয়, আবার অনেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে না পেরে হতাশায় ভোগেন।
মেডিকেল শিক্ষার্থীরা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, মানসিকভাবে তারা অনেক শক্ত বলেই হয়তো তাদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান কম। অন্যথায় এ সংখ্যাটা আরও বেশি হতে পারতো। আড্ডা দেওয়া কিংবা আনন্দ-ফুর্তি করা বাদ দিয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা যে পড়তে বসে, এটাই হয়তো তাদেরকে মানসিকভাবে আরও শক্ত করে তোলে। তবে যারা আত্মহত্যা করে তারা শুধু মেডিকেল শিক্ষার্থীই নয়, ডাক্তারদের মধ্যেও আত্মহত্যা, বিষণ্ণতা, হতাশার প্রবণতা অনেক বেশি।
যে কারণে মেয়েরা অধিক আত্মহত্যাপ্রবণ
মেয়েদের আত্মহত্যা করার পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে বাল্য বিবাহ। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে একটি মেয়ের যখন পড়াশোনায় আগ্রহ বৃদ্ধি পায়, তখনই হয়তো তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। অল্প বয়স্ক হওয়ায় অনেক মেয়ে বেশিরভাগ সময়ই শ্বশুরবাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। আবার অল্প বয়সে বাচ্চা নেওয়ার জন্য তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। এসব কিছু একসাথে সামলাতে গিয়ে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এর বাইরে অনেক মেয়ে আছে যারা শিক্ষিত কিন্তু তাদের কোনো চাকরি নেই কিংবা শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও চাকরি করতে দেওয়া হচ্ছে না, ফলে তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নারীদের আত্মহত্যা করার অন্যতম কারণ।