সংযুক্ত শিক্ষকে চলছে নীলফামারী মেডিকেল, মান নিয়ে দুশ্চিন্তায় সংশ্লিষ্টরা
আসাদুল ইসলাম দুলাল: প্রয়োজনের আলোকে পদ সৃজন না হওয়ায় নীলফামারী মেডিকেল কলেজে চরম শিক্ষক সংকট নিয়ে চলছে পাঠদান। অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক না থাকায় সহকারী অধ্যাপক ও লেকচারার দিয়ে চলছে অধিকাংশ বিভাগ। কোনো কোনো বিভাগে একজন শিক্ষকও নেই। ফলে সপ্তাহে একাধিক দিন পার্শ্ববর্তী জেলার মেডিকেল কলেজ থেকে শিক্ষক এনে ক্লাস চালানো হয়।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন পাঠদান দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিখন কার্যক্রমের ব্যাপক ঘাটতির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।
সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে স্থাপিত হয় নীলফামারী মেডিকেল কলেজ। এর প্রতিটি ব্যাচে রয়েছে প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী। তবে শিক্ষকের শূন্যতা নিয়েই এগিয়ে চলছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মেডিকেল কলেজের প্রতিটি বিভাগে একজন অধ্যাপক, ২৪ জন সহযোগী অথবা সহকারী অধ্যাপক ও ৬০ জন লেকচারার থাকবেন। তবে এর বিপরীতে নীলফামারী মেডিকেলে ১২টি বিভাগে অধ্যাপকের ১২টি পদের বিপরীতে দুই জন, সহযোগী অথবা সহকারী অধ্যাপকের ২৪ পদের বিপরীতে ১৬ জন এবং লেকচারার ৬০টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র পাঁচ জন শিক্ষক।
কলেজ সূত্রে জানা গেছে, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও লেকচারার পদে অ্যানাটমি, বায়োকেমিস্ট্রি, ফিজিওলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, প্যাথলজি, মাইক্রোবায়োলজি, মেডিসিন, সার্জারি ও গাইনিকোলজিস্ট বিভাগের বিভিন্ন পদে ৮৪ জন শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষক রয়েছে ২৬ জন। সে হিসাবে প্রায় ৭০ ভাগ জনবল শূন্যতা রয়েছে কলেজটিতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক পদ শূন্য; তবে লেকচারার পদে পাঁচ জনের বিপরীতে রয়েছে কর্মরত আছেন একজন। ফার্মাকোলজি বিভাগে অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও লেকচারার পদ শূন্য। ফিজিওলজি বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও লেকচারার পদ শূন্য; তবে একজন সহকারী অধ্যাপক কর্মরত আছেন।
একজন অধ্যাপক নিয়ে চলা প্যাথলজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও লেকচারারের পদ শূন্য। গাইনিকোলজি বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক নেই, লেকচারার পদ শূন্য; তবে তবে একজন সহকারী অধ্যাপক কর্মরত আছেন।
অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও লেকচারার পদশূন্য পেডিয়াট্রিক বিভাগ চলছে একজন সহকারী অধ্যাপক দিয়ে।
শুধুমাত্র একজন সহযোগী অধ্যাপক নিয়ে চলছে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ; এতে অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও লেকচারার পদ শূন্য। মেডিসিন বিভাগ চলছে দুই জন সহকারী অধ্যাপক দিয়ে; সেখানে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও লেকচারার পদশূন্য। সার্জারি বিভাগ তিনজন সহকারী অধ্যাপক দিয়ে চলছে; তবে বিভাগটিতে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও লেকচারার পদ শূন্য। এ ছাড়া অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদশূন্য কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগে রয়েছেন একজন লেকচারার, শূন্য রয়েছে চারটি পদ।
বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে একজন সহকারী অধ্যাপক ও একজন সহযোগী অধ্যাপক থাকলেও অধ্যাপক পদ শূন্য; পাচঁ পদের বিপরীতে রয়েছে একজন লেকচারার। অ্যানাটমি বিভাগে অধ্যাপক একজন ও একজন সহকারী অধ্যাপক থাকলেও সহযোগী অধ্যাপক পদ শূন্য; তবে বিভাগটিতে পাঁচ জনের বিপরীতে দুই জন লেকচারার কর্মরত আছেন।
ব্যাপক সংখ্যক পদের শূন্যতার বিষয়ে জানতে চাইলে নীলফামারি জেলা বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ও মেডিকেল কলেজের পেডিয়াট্রিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. দিলীপ কুমার রায় মেডিভয়েসক বলেন, ‘আমাদের এখানে এখনো পদ সৃষ্ট হয়নি। এখানে যারা (শিক্ষক) আছেন, তার ওএসডি হিসেবে যুক্ত আছেন। এখানে শিক্ষকের ব্যাপক সংকট রয়েছে। তবে পদ সৃষ্ট হলে শিক্ষক সংকট সমাধান হবে। অনেকবার চেষ্টা করেও শিক্ষক আনা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে আমরা আবেদন করেছি।’
নীলফামারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. রবিউল ইসলাম শাহ মেডিভয়েসকে বলেন, সব বিষয়ের শিক্ষক আছে, শুধু দুইটি বিষয়ের (ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি) নেই। এই দুইটি বিষয়ের শিক্ষক কোনো মেডিকেলে নেই। তবে ঢাকা মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ছাড়া রংপুরে, বগুড়া ও দিনাজপুরে, রাজশাহীসহ অনেক মেডিকেল কলেজে এই দুটি বিষয়ের শিক্ষক নেই।
এই দুই বিষয়ে শূন্যতার কারণ জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘এ দুটি বিষয়ের উপর ক্যারিয়ার গড়তে চায় না এবং পড়াশোনা করতে চায় না শিক্ষার্থীরা। কারণ, পোস্টমর্টেমের ভয় থাকে। ফলে এই বিষয়ের শিক্ষক পাওয়া যায় না। শূন্যতা পূরণে আমি রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে সপ্তাহে দুই দিন করে শিক্ষক এনে ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে করে ক্লাস দুটি চালানো হচ্ছে।’
শিক্ষক সংকট বিষয়ে ডা. রবিউল ইসলাম শাহ বলেন, একটি মেডিকেলের কার্যক্রম শুরু হলে পর্যাপ্ত শিক্ষক থাকবে। এখনও পোস্ট ক্রিয়েট হয়নি। তবে এটা শেষের দিকে, হয়তো সামনের মাসে নিয়োগ হবে, এটা হলে পদায়নও শুরু হবে। এখন যারা কলেজে আছেন, তারা সবাই সংযুক্ত হিসেবে আছেন। তারা ওএসডি ঢাকায় আর কাজ করছে এখানে। এজন্য শিক্ষক কম। তাছাড়া আর সমস্যা নেই।
শিক্ষক নিয়োগ সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যক্ষ বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে সিনিয়র শিক্ষক পদায়ন হয় এবং অধিদপ্তর থেকে লেকচারার নিয়োগ করা হয়। এখনও নতুন চারটি মেডিকেল কলেজের পোস্ট ক্রিয়েট হয়নি। এই সকল মেডিকেলে সংযুক্তির মাধ্যমে কাজ চালানো হচ্ছে। আমার পদায়ন ডিজি অফিসে, চাকরি করছি এই মেডিকেল কলেজে। এতে একটু সমস্যা থাকে। যেমন: বেতন দেরিতে হয়। অনেকে আতঙ্কিত হয়ে কাজ করতে রাজি হন না। এজন্য শিক্ষক সংকট। পদসৃজনের প্রক্রিয়াটা প্রায় দুই বছর যাবৎ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ফাইল গেছে, এটা পাস হলেই নিয়োগ হবে।’
এ তিনি আরও বলেন, স্বাস্থ্য শিক্ষা দপ্তর থেকে সরবরাহ দিতে পারছে না। ক্যারিয়ারসম্পন্ন জনবল পাওয়া যাচ্ছে না। আর যাদের পাওয়া যাচ্ছে, তারা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে কাজ করছেন। তবে যারা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে কাজ করছেন, তারা স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগে আগ্রহী নন। এ ছাড়া ঢাকার বাইরের মেডিকেল হওয়া পাশাপাশি পদ সৃজন না হওয়ায় এ জটিলতা। এ ছাড়া নতুন মেডিকেল কলেজ হওয়ায় স্থায়ী কাঠামো হয়নি।
প্রফ পরীক্ষার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ১ম প্রফের ও ২য় প্রফের শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো সমস্যা হয়নি। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রফের শিক্ষার্থীদের সমস্যা হতে পারে।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. এ কে এম আহসান হাবিব মেডিভয়েসকে বলেন, ঢাকার বাইরে সরকারি মেডিকেল কলেজে প্রায়ই শিক্ষক সংকট দেখা যায়। শিক্ষক তৈরি করতে সময় লাগে। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে শিক্ষক কতজন থাকবে তার একটি নীতিমালা রয়েছে। একটি বিভাগে সাত জন শিক্ষক থাকতে হবে। সিনিয়র শিক্ষক ১:২৫ এবং জুনিয়র শিক্ষক ১:১০ অনুপাতে থাকবে। প্রতিটি ব্যাচে ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকলে নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি বিভাগের জন্য ৫ জন লেকচারার এবং দুই জন অধ্যাপক বা সহকারী অধ্যাপক লাগবে। এ রকম একটি রেশিও অনুসরণ করা হয়।
তিনি আরও বলেন, নীলফামারী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ জরুরি ভিত্তিতে শিক্ষক সংকটের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে বা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন করলে এ বিষয়ের সুরাহা হবে। এতে যেসব মেডিকেলে অতিরিক্ত শিক্ষক আছেন, সেখান থেকে আপদকালীন সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য শিক্ষক দেওয়া যেতে পারে।
এমইউ