ডা. সাবির মঞ্জুর খান

ডা. সাবির মঞ্জুর খান

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

৮, সেন্ট মনিকা ওয়ে, ব্লেয়ার অ্যাথল,

এনএসডাব্লু ২৫৬০,অস্ট্রেলিয়া।

মোবাইল: +61 432 347 703

ইমেল: [email protected]


২০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১ ০৬:৫০ পিএম

‘যতদিন বেঁচে আছি দেশের ক্যান্সার রোগীদের পাশে থাকতে চাই’

‘যতদিন বেঁচে আছি দেশের ক্যান্সার রোগীদের পাশে থাকতে চাই’
প্রতিকী ছবি।

আমি অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী একজন ডাক্তার। মূলত পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞ হিসাবে কাজ করেছি এদেশে। সে যাইহোক, বিগত তিনবছর যাবৎ আমি ক্লোন ক্যান্সারে ভুগছি।

২০১৮ সালের মার্চ মাসে যখন আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে যেটা আমার Sigmoid Colon-এ ছিল তখনই সেটা স্টেজ ফোর ছিল এবং পেরিটোনিয়াম ও স্প্লিনে মেটাস্টেসিস ছিল। ফলে প্রচলিত সার্জারীর (Resection) মাধ্যমে আমাকে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি।

আমাকে পরে সিডনীর Royal Prince Alfred Hospital-এ রেফার করে Total Peritonectomy & HIPEC (Hyperthermic Intraperitoneal Chemotherapy) করার জন্য। It is basically a hyperthermia therapy used in combination with surgery in the treatment of advanced abdominal cancers. In this procedure, warmed anti-cancer medications are infused and circulated in the peritoneal cavity for a short period of time.

অপারেশনটা করতে আমার জন্য সময় লাগে ১০ ঘন্টার উপর। সকাল ৮টায় শুরু করে সন্ধ্যা ৬টার পর শেষ হয়। এটা মূলত একটি Cytoreductive surgery যার মধ্যে আমার Total Peritonectomy সাথে Rt. Hemicolectomy, Hemicolectomy, Anterior Resect করা হয়। বলা যায়, আমার Large intestines বলতে গেলে নেই। রিকভার করে উঠতে আমার প্রায় দুই সপ্তাহ লাগে।

আমার অপারেশনটা হয় ২০১৮ সালের মে মাসের ২২ তারিখে। এরপর Adjuvant chemotherapy শুরু হয় Oxaliplatin, Irinotecan, Fluorouracil (5FU) and Leucovorin যা FOLFOX নামে পরিচিত। জানুয়ারীর মাঝামাঝি শেষ হয়। পুরো কোর্সে Oxaliplatin-এর কামড় আমার শরীর সহ্য করে উঠতে পারেনি। ফলে ৮টার বদলে ৪টা নিয়েই ক্ষান্ত দিতে হয়। বাকীগুলো শেষ হয়। অবশ্য 5FU ছিল কোলন ক্যান্সারের টার্গেটেড কেমো।

জুলাই ২০১৯ সালে আবার আমার abdominal wall- Mets দেখা দেয়। এরপর শুরু হয় রেডিয়েশন এবং পরে Chemotherapy FOLFIRI. শরীর আল্লাহর রহমতে টলারেট করে যাচ্ছিল ভালভাবেই। রেডিয়েশন ও কেমোও ঠিকভাবে রেসপন্ড করছিল। জুনের দিকে যখন পরপর দুইটা স্ক্যানে ক্যান্সারমুক্ত দেখা গেল এবং ক্যান্সার মার্কারও যখন দীর্ঘদিন স্বাভাবিক দেখা গেল তখন সিদ্ধান্তে আসা হলো যে, কিছুদিন অর্থাৎ মাসখানেক কেমো বন্ধ রেখে দেখা যাক।

একমাসের জায়গায় দুইমাস পরে আমি আমার পেলভিসে ও ব্যাকে ব্যথা অনুভব করতে থাকলাম যা তীব্র না হলেও স্বস্তিদায়ক ছিলনা এবং এ ব্যথার অনুভূতিটাই কেন যেন ভাল লাগছিলনা। সাথে সাথে অনকোলজিস্টদের সাথে যোগাযোগ করলাম এবং তারা তড়িৎ আমাকে দেখলেন। একটা কথা না বললেই নয়, অস্ট্রেলিয়া আসবার পর এই ১৫ বছরে এখানে একজন Practising doctor না হয়েও এখানকার ডাক্তাররা আমাকে (আমার ধারণা অন্য ডাক্তারদেরও) যে সম্মান দিয়েছে ও মূল্যায়ন করেছে তা আমার নিজের দেশেও কোন ডাক্তারের কাছ থেকে পাইনি।

প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা আমাকে Top priority-তে রেখেছে এবং আজ  অবধি কেউ আমার কাছ থেকে একটি ডলার ফী নেয়নি। যাহোক, সাথে সাথে স্ক্যানে ধরা পড়লো আমার পেলভিসে, স্যাক্রামের পিছনে এবং Para-aortic & mediastinal lymph nodes-এ নতুন মেটস দেখা দিয়েছে যা এই তীব্র ব্যথা তৈরী করছে। 16 sessions radiation দেবার পর আবার কেমো শুরু হলো যা এখনও চলছে। FOLFIRI চলছে তবে এটা বোধহয় বদলানোর সময় হয়ে এসেছে। আগের মেটসগুলো stable থাকলেও আমার নিজের সন্দেহ হবার কারণে অনকোলজিস্টকে অনুরোধ করেছিলাম Brain scan করবার জন্য যদিও কোন উপসর্গ ছিল না তবুও স্ক্যানে lesion পাওয়া গেল Pontomedulary junction-এ যা MRI করে নিশ্চিত হওয়া গেল এবং সাথে চলে আসলো Base of the skull 3rd cervical vertebrae-তে নতুন মেটস।

যদিও ব্রেইনেরটা স্টেবল আছে কিন্তু হেড-নেক ও ব্যাকে তীব্র ব্যথার জন্য যেখানে Hydromorphone 32mg daily and 4mg every two hours breakthrough dose সাথে Panadiene Forte দিয়ে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। সেখানে কেমো পরিবর্তন করবার একটা যুক্তি থেকেই যায়। এমাসের শেষে আবার স্ক্যান রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। দেখা যাক কি হয়। 

সার্বিকভাবে ২০১৮ সালের মে মাসের পর থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বলতে গেলে আমি অনেকটাই স্টেবল ছিলাম। শারীরিক অবস্থা এমন ছিল কেউ দেখে বলতে পারতো না যে, আমি প্যালিয়েটিভ কেয়ারের অধীনে একজন ক্যান্সার রোগী। এখন ওজন আগের থেকে কিছুটা হারিয়েছি। যখন সুস্থ্য ছিলাম তখন ছিলাম ৭০-৭২ কেজি। অপারেশনের ও প্রথম কেমোর পর চলে এলাম ৫৬ কেজি। কেমো শেষ করার একমাস পর আবার ৬৫-৬৭ কেজি। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে রেডিয়েশনের পর আবার ৫৬ কেজি এবং এখন ৫৮ কেজি।

রেডিয়েশনের পর ভীষণ পায়খানা হতো। দিনে ২৫-৩০ বার সাথে লোকাল এনাল ইরিটেশন। সে যে কী কষ্ট তা ভাষায় প্রকাশ করবার মত নয়। তবে FOLFIRI Chemotherapy অনেকটাই সহণীয় আমার জন্য। কোন anorexia develop করেনি। রেডিয়েশন শেষ হবার পর প্রায় দুইমাস লেগেছে আমার bowel movement ঠিক হতে। তবে আমার আবার bowel obstruction -এর ঝুঁকি অনেক বেশী নানান adhesion-এর জন্য। বহুবার হয়েছে কিন্তু আল্লাহর রহমতে conservative treatment নিয়েই ভাল হয়েছে।

ডায়েট খুব মেনে চলি। নরম খাবার এবং less fibre and low residual diet খাই। আমার জন্য আবার যেকোনও রকম abdominal operation খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সেজন্য খুব সচেতন থাকতে হয়। তবে বিগত মাস দুই ধরে বেশ বুঝতে পারছি যে, শরীর আর আগের মত নেই। রিকভারীর হার কমে যাচ্ছে। আর কত! তিনবছর তো পার করছি! তার উপর নতুন মেটস দেখা দিচ্ছে। তবুও হারতে রাজী নই। মারা তো যাবোই এবং সবাই যাবে, তাতে কি? যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন হাসিমুখ নিয়েই থাকতে চাই। ক্যান্সারের কষ্টের কাছে নতি স্বীকার করতে রাজী নই। এর মধ্যেও চেষ্টা করি অন্য ক্যান্সার রোগীদের সহযোগীতা করতে। তা সে এখানে কিংবা বাংলাদেশে। নিজেকে উপস্থাপন করি সবার কাছে।

কখনও কখনও এমন অবস্থা হয় যে, বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনা। ফোনে বা ভিডিও কলে যোগাযোগ করি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশেই কয়েকজন ক্লোন ক্যান্সারের রোগীর সাথে দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি যারা দেশে অথবা পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যতটুকু পারি তাদেরকে আমার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সঠিক গাইডলাইনের মধ্যে রাখবার চেষ্টা করি। চেষ্টা করি মানসিক সাপোর্ট দেবার যেটা একটা ক্যান্সার রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশী দরকার। সময় আমার শেষ হয়ে আসছে দ্রুত, সবারই শেষ হচ্ছে, তবুও যাবার আগে যতটুকু পারি দিয়ে যাই।

গত দুইদিনে বাংলাদেশে দুইজন ডাক্তারের ক্লোন ক্যান্সারে মৃত্যুর খবর পেলাম। খুব খারাপ লাগলো শুনে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা পৃথিবীতে এর স্বপক্ষে একটা সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার। এ এমন এক নীরব মরণঘাতী রোগ যে, যখন ধরা পড়ে তখন অনেকক্ষেত্রেই আর কিছু করার থাকে না। অথচ সময়মত ধরা পড়লে এর সম্পূর্ণ চিকিৎসা সম্ভব। আমার মত একটি রোগীর শরীরে এই রোগ এ পর্যায়ে আসতে কমপক্ষে ৩-৪ বছর সময় লেগেছে। অথচ একজন ডাক্তার হয়েও আমি বা আর যে দুইজন বাংলাদেশে মারা গেছেন আমরা কেউ টের পাইনি!

যদি সারা দেশে সঠিকভাবে সরকারী বা বেসরকারী উদ্যোগে স্ক্রীনিং-এর ব্যবস্থা নেয়া যায় তবে অনেক অনাকাংখিত মৃত্যুহার এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই তিনবছরে বাংলাদেশের চিকিৎসা সম্পর্কে যা ধারণা পেয়েছি তা আমাকে সত্যি হতাশ করেছে। এই Total Peritonectomy with HIPEC চিকিৎসা ব্যবস্থা বাংলাদেশে নেই! অথচ এই ব্যবস্থাটাই advanced abdominal cancer-এর রোগীদের মধ্যে ২৫-৩০% রোগীদের জীবনকে নিশ্চিত করছে।

অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ এখন দ্রুত এগিয়ে চলেছে। অনেক সেক্টরে বাংলাদেশের উন্নয়ন চোখে পড়বার মত। অথচ এই কোভিডের সময়েই বাংলাদেশের কিছু দুর্বল দিক বিশেষ করে চিকিৎসা বিষয়ক চোখে পড়বার মত হয়েছে। এসব বিষয়ে দৃষ্টি দেবার এখন প্রয়োজন পড়েছে। তার থেকেও বেশী প্রয়োজন এখন সাশ্রয়ী খরচে মানসম্পন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

আমি আবারও আহ্বান করছি, বাংলাদেশের কেউ যদি ক্লোন ক্যান্সার বিষয়ে আমার সাথে কিছু শেয়ার করতে চান বা কোন মতামতের প্রয়োজন পড়ে বা যে কোন ধরণের সাপোর্ট যা আমি দিতে পারবো তবে নির্দ্বিধায় আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করবো। আমার সাথে যোগাযোগের সব ডিটেইলস ফেইসবুকেই আছে। তারপরেও আমার কন্ট্যাক্ট ডিটেইলস নিচে দিলাম।

Dr. Sabir Manzoor Khan
8 St Monica Way
Blair Athol, NSW 2560
Australia.
Mobile: +61 432 347 703
Email: [email protected]

 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
বিএসএমএমইউ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গবেষণা

গ্রামে স্বাস্থ্যসেবা গিতে গিয়ে ১৮ সমস্যার মুখোমুখি চিকিৎসকরা

  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত