
ছৈয়দ আহমদ তানশীর উদ্দীন
নার্স ও পুষ্টিবিদ,
বিএসসি ইন নার্সিং (চবি), এমপিএইচ ইন নিউট্রিশন (ইবি)।
১২ মে, ২০২৫ ১২:৩৪ পিএম
নার্সিং পেশাকে গুরুত্বদান অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে

আজ ১২ই মে, আন্তর্জাতিক নার্স দিবস। এবারে প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে: ‘Our Nurses, Our Future: Care for nurses strengthens economies’, যা বাংলায় হচ্ছে ‘আমাদের নার্স, আমাদের ভবিষ্যৎ: নার্সিং পেশার উন্নতি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি।’ একটি দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করতে সুস্থ নার্সিং জনবলের গুরুত্ব অপরিসীম। গেল ২০২৪ সালের নার্স দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ের ধারাবাহিকতা এবারের থিম। ২০২৪ সালের থিমে নার্সিংয়ে কৌশলগত বিনিয়োগ কীভাবে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা বয়ে আনতে পারে তার উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছিল। এবারের আন্তর্জাতিক নার্স দিবসের প্রতিপাদ্যে নার্সদের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নার্সরা স্বাস্থ্যসেবার কেন্দ্রে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বেডসাইড পরিচর্যার মাধ্যমে জাতীয় জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়ে ব্যাখ্যা করে আন্তর্জাতিক কাউন্সিল অব নার্সেসের (আইসিএন) প্রেসিডেন্ট ড. পামেলা সিপ্রিয়ানো বলেন, ‘যেহেতু নার্সরা স্বাস্থ্যসেবার মূল কেন্দ্রে অবস্থান করে, তাই আমরা নার্সদের স্বাস্থ্য ও ভালো থাকার গুরুত্ব তুলে ধরেছি। নার্সরা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় (যেমন শারীরিক, মানসিক, আবেগীয় ও নৈতিক)। আমাদের এই চ্যালেঞ্জগুলো এমনভাবে মোকাবিলা করা অপরিহার্য যা তাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সহায়ক হয়। এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে চিহ্নিত সমস্যাগুলোর কার্যকর সমাধান সামনে আনা যাবে, যা নার্সদের দৈনন্দিন কাজ ও স্বাস্থ্য উন্নয়নে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই বিষয়টি নিয়ে নার্সিং অ্যাসোসিয়েশন ও সংস্থাগুলো 'পরিবর্তনের সনদ' (Charter for Change) আখ্যা দিয়ে নার্সিং পেশা ও ভবিষ্যৎ টেকসই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য নার্সিং পেশায় বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছে।’
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের উন্নয়নের পথে বড় সমস্যা রয়েছে, যেগুলোর দিকে আমরা ঠিকমতো নজর দিচ্ছি না। কথায় কথায় বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ গড়ে তুলি। তার সাথে একটি নার্সিং কলেজ করলে কেমন হয়? বিদেশে অনেক নার্সের চাহিদা রয়েছে, কিন্তু আমরা দক্ষ নার্স তৈরি করতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সমস্যার পেছনে আছে আমাদের ব্যবস্থার দুর্বলতা, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনের প্রতি অনীহা।’
অভিজ্ঞতার আলোকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের নার্সিং খাত নিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের নার্স তৈরি করা সম্ভব, যার উদাহরণ গ্রামীণ ক্যালিডোনিয়ান নার্সিং কলেজ। এই কলেজ থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করেছেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বিভিন্ন উন্নত দেশ বাংলাদেশ থেকে নার্স নিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে নানামুখী চ্যালেঞ্জের কারণে বাস্তব ক্ষেত্রে আমরা এই বিপুল চাহিদার সুযোগ নিতে পারছি না। এর প্রধান কারণ হলো নার্সিং শিক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে চলমান নীতিগত ও কাঠামোগত বাধা।’
দেশে ও বিশ্ববাজারে নার্স ও মিডওয়াইফের বিপুল চাহিদা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, বর্তমানে প্রায় ২৯ কোটি নার্স এবং দুই কোটি ২০ লাখ মিডওয়াইফ সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে আড়াই লাখ এবং বিশ্বে ৬০ লাখ নার্সের প্রয়োজন হবে।১
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, চিকিৎসক ও নার্সের অনুপাত হতে হবে ১:৩। অর্থাৎ একজন চিকিৎসকের সঙ্গে অন্তত তিনজন নার্স থাকতে হবে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) নিবন্ধিত চিকিৎসক রয়েছেন এক লাখ ৩৪ হাজার ৫৬৮ জন। সেই অনুযায়ী দেশে নার্স প্রয়োজন চার লাখ তিন হাজার ১০৪ জন। তবে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি কর্মরত নার্স এক লাখ এক হাজার ১৬৯ জন, যা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। বর্তমানে দেশে ৬৭টি সরকারি ও ৩৭২টি বেসরকারি নার্সিং প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিবছর ৩৫ হাজার ৮৬৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। পড়ালেখা শেষে প্রতিবছর বের হয় প্রায় ২৫ হাজার নার্স। তবে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, বার্ধক্য ও স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা বাড়ার কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রায় চার কোটি ৫০ লাখ নার্স ও ৩১ লাখ মিডওয়াইফের ঘাটতি হতে পারে। আরও একটি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এই ঘাটতির সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে নিম্ন ও নিম্নমধ্য আয়ের দেশগুলোর ওপর।
এই চাহিদা পূরণের জন্য অনেক দেশ ইতোমধ্যেই বিদেশি নার্স নিয়োগের দিকে ঝুঁকছে। যেমন, ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত নার্সের সংখ্যা ছিল ৩১ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯০। ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে সাত লাখ ৪৮ হাজার, জার্মানিতে ১০ লাখ চার হাজার, জাপানে ১৭ লাখ ৩৪ হাজার এবং ২০২৩ সালে সৌদি আরবে দুই লাখ ৩৫ হাজার ৪৬১ জন নিবন্ধিত নার্স কাজ করেছেন। বাংলাদেশে নিবন্ধিত নার্সের সংখ্যা মাত্র এক লাখ এক হাজার ১৬৯ জন। এই উপাত্তগুলো প্রমাণ করে দেশে এবং বৈশ্বিক বাজারে নার্সিং পেশার বিশাল চাহিদা রয়েছে।২
এই চাহিদাকে মাথায় রেখে কিছু দেশ অনেক আগেই কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে বিশ্ববাজারে নার্স রপ্তানি করে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি দেশ হলো ভারত ও ফিলিপাইন। ভারত থেকে প্রায় ছয় লাখ ৪০ হাজার নার্স বর্তমানে বিদেশে কাজ করছেন, যাদের অধিকাংশই মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত। বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে যেমন—সৌদি আরব, কুয়েত, লিবিয়ায় নার্স রপ্তানি চলছে। অনুমান করা হচ্ছে, আগামী ছয় থেকে সাত বছরে এই চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হতে পারে। ফিলিপাইন নার্স রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম প্রধান দেশ। ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার ফিলিপিনো নার্স বিদেশে কাজ করছিলেন। শুধু ২০২৩ সালেই আন্তর্জাতিক বাজারে নতুনভাবে নিযুক্ত হন ১৩ হাজার ২২৩ জন ফিলিপিনো নার্স। এই নার্সদের প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) তাঁদের দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে নার্সদের পাঠানো রেমিট্যান্স বছরে প্রায় আট বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা সে দেশের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় এক–চতুর্থাংশ এবং জিডিপির প্রায় ১০ ভাগের এক ভাগ।৩
নার্সরা জাতীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখে
নার্সরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে অর্থনীতিতে অবদান রাখেন, যার ফলে একটি স্বাস্থ্যকর এবং উৎপাদনমুখী কর্মীবাহিনী তৈরি হয়। তারা স্বাস্থ্যসেবা সম্পদকে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করে, প্রতিরোধমূলক সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি খরচ কমায় এবং স্বাস্থ্যসেবা উদ্ভাবন ও গবেষণার অগ্রভাগে থাকে। নার্সদের উপর বিনিয়োগ রোগীর সেবার মান উন্নত করে, নার্সদের কাজের সন্তুষ্টি বাড়ায় এবং আরও স্থিতিস্থাপক ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে।
নার্সরা যেভাবে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে
অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ অবদান:
ক) রোগীর স্বাস্থ্যের উন্নতি
খ) খরচ সাশ্রয়ী সেবা প্রদান
গ) উদ্ভাবন ও গবেষণায় নেতৃত্ব
অর্থনীতিতে পরোক্ষ অবদান:
ক) সুস্থ কর্মক্ষম জনসংখ্যা
খ) সংকটে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
গ) শিক্ষা ও নেতৃত্বে নার্সদের ভূমিকা
ঘ) সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায় অগ্রণী ভূমিকা
ঙ) কর্মসংস্থান সৃষ্টি
চ) স্বাস্থ্য খরচ হ্রাস
ছ) উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি
সুপারিশসমূহ
১. দক্ষ জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ
২. আধুনিক সরঞ্জামে বিনিয়োগ
৩. নিরাপদ ও বৈষম্যহীন কর্মপরিবেশ
৪. আধুনিক নার্সিং শিক্ষা
৫. নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত ও সাংগঠনিক সংস্কার
৬. প্রিভেন্টিভ কেয়ার ও স্বাস্থ্যসেবা সহজপ্রাপ্যতা
৭. ন্যায্য বেতন কাঠামো ও কর্মঘণ্টা
পরিশেষে, অধ্যাপক ইউনূস এবং আইসিএন প্রেসিডেন্ট যে সমস্যাগুলোর কথা বলেছেন, তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এখনই সময় নার্সিং শিক্ষায় কাঠামোগত সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক মান অর্জনের মাধ্যমে দক্ষ নার্স তৈরিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর। এতে করে বিদেশি শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান দৃঢ় করা সম্ভব, এবং দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে।
সূত্র:
১. ডব্লিউএইচও প্রতিবেদন, ২০২০
২. সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারি স্বাস্থ্য সংস্থা ও পরিসংখ্যান ব্যুরো
৩. রয়টার্স ও ইকোনমিক টাইমস
টিআই/এনএআর/