১৪ এপ্রিল, ২০২৩ ০১:৫৫ পিএম

এমআরসিপি পরীক্ষায় ডা. নাঈমা তাসনিমের বিশ্ব রেকর্ডের গল্প

এমআরসিপি পরীক্ষায় ডা. নাঈমা তাসনিমের বিশ্ব রেকর্ডের গল্প
ডা. নাঈমা তাসনিম বলেন, কেউ যদি একজন ভালো ক্লিনিশিয়ান হতে চায়, তাহলে অবশ্যই এমআরসিপি করা উচিত।

মেডিভয়েস রিপোর্ট: যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজের এমআরসিপি পরীক্ষায় ১৭২ নাম্বারে ১৭২ পেয়ে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়েছেন বাংলাদেশি চিকিৎসক নাঈমা তাসনিম। তিনিই প্রথম বাংলাদেশি চিকিৎসক হিসেবে এ পরীক্ষায় রেকর্ডসংখ্যক মার্ক পেয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন ও ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন চিকিৎসক সমাজসহ অসংখ্য মানুষ। দেশের গর্ব এ নারী চিকিৎসক তাঁর অভাবনীয় সাফল্য ও কৃতিত্বের কথা তুলে ধরেছেন মেডিভয়েসের সঙ্গে আলাপকালে।

মেডিভয়েস: আপনার অনুভূতি কি?

ডা. নাঈমা তাসনিম: ৬ এপ্রিল ইফতারের আগে ঘুম থেকে উঠে শুনি যে, আজকে রেজাল্ট দেওয়া হবে। ইফতার করার পরে আমি বাচ্চাকে খাওয়াচ্ছিলাম, হঠাৎ করে আমার স্বামী এসে বলছেন, আমাদের পরিবারে একজন নতুন কনসালট্যান্ট হয়ে গেছে। আমি তখন খুবই এক্সাইটেড ছিলাম। বিশেষ করে কত মার্ক পেয়েছি এটা জানার জন্য খুবই উদগ্রীব ছিলাম। আমার স্বামী শুধু পাস করেছি এটুকু বলেছেন। 

এরপরে অনলাইনে ঢুকে দেখি ১৭২! প্রথমে কিছুটা অবাক ছিলাম যে এটাতো টোটাল নাম্বার ১৭২, আমার মার্কটা আসলে কোথায়! এরপরে আমি আবারও পুরোটা চেক করলাম, পরে দেখি যে সত্যিই আমি বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলছি! কনফার্ম হওয়ার পর তারাতাড়ি আব্বু-আম্মুকে ফোন করে বললাম। এরপরে আমার মেন্টরকে বললাম। শুরুতে আর তেমন কাউকে বলার সুযোগ পাইনি। কিছুক্ষণ পরে আমার স্বামীকে কেউ একজন মেডিভয়েসের পোস্টারটা পাঠায়। এরপরে দেখি আমার ফেইসবুকে সবাই এটা দিয়ে উইশ করা শুরু করছে। সত্যি বলতে এ অনুভূতি বলে বুঝানো যাবে না। এইরকম একটা মার্ক আমি পাবো, এটি কখনো চিন্তাও করিনি। এক অন্যরকম অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।  

মেডিভয়েস: কোন অনুপ্রেরণায় এ পর্যন্ত আসা?

ডা. নাঈমা তাসনিম: অনুপ্রেরণার কথা বলতে গেলে শুরুতেই আব্বুর কথা বলতে হয়। তিনি বুয়েটের অধ্যাপক এবং ওনার পেশায় উনি খুবই বিখ্যাত। সব সময় মনে হতো, যেন আব্বুর মতো কিছু একটা করতে পারি। আম্মুও সর্বদা অনুপ্রেরণা দিয়ে বলতেন যে, শুধু এমবিবিএস পাশ করলেই হবে না; একজন ভালো চিকিৎসক হতে হবে একই সঙ্গে অবশ্যই একটা ভালো পোস্ট গ্রাজুয়েশন করতে হবে। স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই অনুপ্রেরণা যোগাতেন। বিশেষ করে শাশুড়ি সবসময়ই বলতেন, নামের পেছনে যত পারো ডিগ্রি যোগ করো, তখন থেকেই মনে হতো যে, আমার কিছু একটা করতেই হবে।

মেডিভয়েস: আপনার এই পুরো জার্নির অভিজ্ঞতা কেমন?

ডা. নাঈমা তাসনিম: পিসেস শুরু করেছিলাম ২০১৯ সালে, কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত পরীক্ষা একবার খারাপ হয়, আরেকবার কোভিডের জন্য বাতিল হয়। এ জন্য পরবর্তীতে অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। ছোট বাচ্চা নিয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে যাওয়া, রোগী দেখা, সবকিছু মিলিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। তারপরও আলহামদুলিল্লাহ অবশেষে এটা শেষ করতে পেরেছি। 

মেডিভয়েস: আপনার পরীক্ষার প্রস্তুতি ও কৌশল সম্পর্কে জানতে চাই।

ডা. নাঈমা তাসনিম: পিসেস পুরোটাই বেড সাইড রোগী দেখা ও ক্লিনিক্যিাল ভিত্তিক। এখানে পড়ার তেমন কিছু নাই, তারপরও টুকটাক কিছু বই পড়তে হয়। ক্লিনিক্যাল পার্টের ক্ষেত্রে রোগী দেখার বিকল্প কিছু নেই। আমাদের প্রচুর দেখতে হয়েছে, আমি কমপক্ষে এক হাজারেরও বেশি রোগী দেখেছি, যা গর্ব করে বলতে পারি। পুরো ঢাকা শহরের সব পাবলিক হাসপাতালের লোকজন আমাকে চিনতেন।

পিসেসের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে কমিউনিকেশন, যেটা আমাদের দেশের থেকে সর্ম্পূর্ণ আলাদা। যুক্তরাজ্যের রয়েল কলেজে পরীক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় রোগী ঠিকভাবে দেখা হচ্ছে কিনা। এটার জন্য আমাকে ইন্টারন্যাশনাল কিছু কোর্স করতে হয়েছে, অনলাইনেও কিছু কোর্স করতে হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের মেন্টর যারা ইতোমধ্যে ভারত কিংবা যুক্তরাজ্য থেকে পিসেস পরীক্ষায় পাশ করে আসছে, তাদের সাহায্যের মাধ্যমেও আমি এই পার্টটা (কমিউনিকেশন) সম্পূর্ণ করি।

মেডিভয়েস: পরিবার, সন্তান ও চাকরি সবমিলিয়ে কিভাবে পড়েছেন?

ডা. নাঈমা তাসনিম: পরিবারকে আমার খুব একটা মেইন্টেইন করা লাগেনি। কারণ, আমার দুটো পরিবারই অসম্ভব রকমের সহায়ক ছিল। বাবা-মা তো সব সময়ই সাপোর্টিভ হয়, কিন্তু আমি আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কথা বলবো, তারা আমাকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছে। বাবার বাসার আশেপোশে অনেকগুলো হাসপাতালগুলো থাকায় কাজ করতে সহজ হয়েছে। সর্বশেষ দুই মাসে শ্বশুর বাড়িতে দুইবার গেছি মনে হয়, কিন্তু এসব নিয়ে তারা কখনো কোনো অভিযোগ করেনি। তাদের কথা ছিল যে, তুমি শুধু পরীক্ষা টা দাও। তবে আমার জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং পার্ট ছিল আমার বাচ্চাটা। ওর জন্মের পর থেকে কখনো ওকে রেখে বেশিক্ষণ বাসার বাইরে থাকা হয়নি। তাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ওকে বাসায় রেখে বাইরে থাকাটা ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং।

মেডিভয়েস: আপনার পড়াশোনায় কাদের ভূমিকা বেশি ছিল? 

ডা. নাঈমা তাসনিম: আমার ইউনিটের বর্তমান সিএ এবং আমার মেন্টর ডা. সিয়াম মোয়াজ্জেম, অনেক সাপোর্ট করেছেন। প্রতিদিনই ওয়ার্ডের কাজের পরে উনি আমাকে রোগী দেখাতেন, কোনো পেমেন্ট এবং কোনো স্বার্থ ছাড়াই। একই সময়ে আরেকজনের কথা বলবো, তিনি হচ্ছেন অনিক ভাইয়া, যিনি অলরেডি যুক্তরাজ্যে চলে গেছেন। অনিক ভাইয়াও কোনো পেমেন্ট এবং কোনো স্বার্থ ছাড়াই আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। আরেকজন হচ্ছে আমার প্রথম মেন্টর ডা. মার্ক। যাকে অনেকেই চিনেন, খান আবুল কালাম আজাদের ছেলে। মার্ক ভাইয়ার প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ। কারণ, আমার জার্নিটা শুরুই হয়েছে ওনার হাত ধরে।

মেডিভয়েস: ভবিষ্যতে যারা এই পরীক্ষায় অংশ নিতে চায়, তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?

ডা. নাঈমা তাসনিম: বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে রয়েল কলেজের ফি অনেক বেশি। তারপরও আমি বলবো একটা উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কারণ, আমি এফসিপিএস ও এমআরসিপি দুটোই করছি পাশাপাশি। আমার মনে হয় এমআরসিপি ডিগ্রি নিতে গিয়ে আমাকে যে পরিমাণ রোগী দেখা লাগছে, তা খুবই কঠিন ছিল। তাই কেউ যদি একজন ভালো ক্লিনিশিয়ান হতে চায়, তাহলে অবশ্যই এমআরসিপি করা উচিত।

মেডিভয়েস: ডা. নাঈমা তাসনীম হয়ে ওঠার গল্পটা শুনতে চাই।

ডা. নাঈমা তাসনিম: আমি ছোটবেলা থেকেই গণিতে অনেক ভালো ছিলাম এবং পাশাপাশি ভালো ছবি আঁকতাম। আমি সার্ফ এক্সেলের রানার্সআপ ছিলাম। আব্বু সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কারণে পরিবারের ইচ্ছে ছিল আমাকে আর্কিটেক বানানোর। কিন্তু এখানে আমার বড় চাচার কথা বলতে হয়, উনি দিনাজপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। আমি একদিন ওনার বাসায় বেড়াতে যাই, রিকশায় উঠে বাসার ঠিকানা বলতেই রিকশাওয়ালা বলে উঠলো ‘ওহ বড় স্যারের’ বাড়িতে যাবেন, আগে বলবেন না। বিষয়টি আমাকে নাড়া দিয়েছিল। বাড়িতে এসে আব্বুকে বলতাম যে, তুমি এত বড় ইঞ্জিনিয়ার তোমাকে সব বড়লোকেরা চিনে, কিন্তু একজন চিকিৎসককে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সবাই চিনে। আমি এটা হতে চাই, কারণ সব ধরণের মানুষ আমাকে চিনবে। 

মেডিভয়েস: আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি?

ডা. নাঈমা তাসনিম: আমার এখন প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে এমসিপিএস, এফসিপিএস সম্পন্ন করা। আমি এখন এফসিপিএস পার্ট-২ ট্রেনিংয়ে আছি। এটা শেষ করে আমি ইংলান্ডে যাওয়ার চেষ্টা করবো।

মেডিভয়েস: ইংল্যান্ডে কেন যেতে চান?

ডা. নাঈমা তাসনিম: ইংলান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকেই এমআরসিপি টা দেওয়া। এর পেছনে দুইটা কারণ রয়েছে। প্রথমত, আমি বাইরের আলাদা একটা পরিবেশে কাজ করতে চাই, বাংলাদেশে অনেকদিন কাজ করলাম, বাইরের পরিবেশটাও একটু দেখি। আরেকটা হচ্ছে আমার বাচ্চাকে একটা ভালো পরিবেশ দেওয়া।

এসএস/এএইচ

 

মেডিভয়েসের জনপ্রিয় ভিডিও কন্টেন্টগুলো দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন MedivoiceBD ইউটিউব চ্যানেল। আপনার মতামত/লেখা পাঠান [email protected] এ।
  এই বিভাগের সর্বাধিক পঠিত