
ডা. মো. তরিকুল হাসান
রেসিডেন্ট, নিউরোলজি বিভাগ,
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
২৫ অক্টোবর, ২০২২ ০২:৩১ পিএম
বিদ্যালয় পরিদর্শন!

আজ কাশীনাথপুর আর কে উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিদর্শন হইবে৷ বিদ্যালয়ের সম্মুখের অংশ তাই পরিপাটি করিয়া সাজানো হইয়াছে। বিশাল মাঠের কোথাও এক টুকরো কাগজ বা ময়লা খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।
সবাই তটস্থ। গুঞ্জন রহিয়াছে, পরিদর্শক মহোদয় অতীব কড়া! ইতোপূর্বে কোথায় যেন এক বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়া সমুদয় অর্থ মঞ্জুরি স্থগিত করিয়া আসিয়াছেন।
এদিকে গণিতের শিক্ষক আবদুল কাইয়ুমের হইয়াছে মহা সর্বনাশ! তাঁহার নতুন সাদা পাঞ্জাবিখানা নতুন লুঙ্গির সঙ্গে ধৌত করা হইয়াছিল। লুঙ্গিখানা হইতে লালবর্ণ বাহির হইয়া সাদা পাঞ্জাবিখানাও লাল হইয়া গিয়াছে! তাহার বাকী পাঞ্জাবিগুলা বড়ই মলিন ও রিপুযুক্ত।
হতাশায় তাঁহার চোখে জল চলিয়া আসে! এখন উপায়?
হেড মাস্টার জনাব বিনয় কান্তি পাল, বিএবিএড (গোল্ড মেডেলিস্ট) খুব রাশভারী লোক। একমাত্র তাহার কাছে অতিরিক্ত পাঞ্জাবি থাকিতে পারে। বাকি শিক্ষকদের অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। কিন্তু তাঁহার কাছে যাইতে মাস্টার মশাইয়ের বড় ভয় করে। তাহার দিব্যচোখে ধরা পড়িতেছে পাঞ্জাবি ধার চাহিবামাত্র হেড মাস্টার মশাই তাহার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া তিরস্কার করিবেন।
চারদিকে নৈরাশ্যের ঝলকানি! এখন উপায়?
পুরনো একটা মলিন পাঞ্জাবি পরিলেন তিনি। উহার কলারে নীল সুতা দিয়া রিপু করা হইয়াছে। যে কাহারো দৃষ্টিতে সাদা পাঞ্জাবিতে নীল রিপু সহজেই চোখে পড়ে। যাহাই হোক আর কি করা। উহাই গাত্রে ধারণ করিয়া উদাস মনে তিনি হাটিতে লাগিলেন।
হেমন্তের সুন্দর সকাল। পাকা ধানের ক্ষেতে যত্রতত্র শিশির ঝরিয়া সকালের রৌদ্রে অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য ফুটাইয়া তুলিয়াছে। ধান ক্ষেতের মাঝখান দিয়া কাচা মাটির পথ চলিয়া গিয়াছে। ইহারই এক প্রান্তে সুপ্রাচীন কাশীনাথপুর আর কে উচ্চ বিদ্যালয়। কত মানীগুনী মানুষের পদধূলি ইহাতে পড়িয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই! দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস একবার এই মাঠে জনসভা করিয়া গিয়াছেন। লোকমুখে সেই গল্প এখনো পুরানা হয় নাই!
এই গৌরবময় ইতিহাস বা প্রকৃতির সৌন্দর্য কোনোটাই গণিতের শিক্ষক আবদুল কাইয়ুমের মনে আজ দাগ কাটিতে পারিতেছে না। কেবলই নিজের পাঞ্জাবির সাদা জমিনে নীল রিপুর কারুকার্যের এক দুঃখময় ত্রুটিতে তাঁহার মন পড়িয়া থাকে। তাঁহার মনে পড়ে গত বৎসর বার্ষিকীতে বাংলার শিক্ষক কত সুন্দর করিয়া আবৃত্তি করিয়া ছিলেন -
হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
তখন উহা শুনিয়া কত ভালো লাগিয়াছিল। মনে হইয়াছিল দারিদ্র্যের মধ্যে একটা আভিজাত্য রহিয়াছে। একটা বিপ্লবী ভাব রহিয়াছে। অথচ, আজ তাঁহার মন ছোট হইয়া এতটুকু হইয়া রহিয়াছে! হায়! সাদা পাঞ্জাবির জমিনে নীল রিপুর কারুকার্যের এক দুঃখময় ত্রুটি!
মলিন বসনে বিদ্যালয় আঙিনায় প্রবেশ করিতেই হেড মাস্টার মশাইয়ের মুখোমুখি হইয়া গেল। হেড মাস্টার মশাই ধমকাইয়া উঠিলেন।
-'কাইয়ুম সাহেব, পাংচুয়ালিটা আপনাকে এখনো শিখাতে পারলাম না। আজো সতেরো মিনিট লেট করেছেন। তাড়াতাড়ি ক্লাসে ঢুকুন!'
ক্লাসরুমটা আজ বেশ পরিচ্ছন্ন দেখাইতেছে। ব্ল্যাকবোর্ডের এক পাশে বড় করিয়া লেখা রহিয়াছে- সপ্তম শ্রেণি, মোট ছাত্র-৭৪ জন। উপস্থিত-৬৮ জন।
লেখাটা দেখিয়া মাস্টার মশাই কিঞ্চিৎ অবাক হইলেন আবার কৃতজ্ঞও হইলেন। নিশ্চয়ই হেড মাস্টার মহাশয় খুব ভোরে বিদ্যালয়ে আসিয়া এইসব গোছাইয়া রাখিয়াছেন।
বেলা গড়াইতেই পরিদর্শক মহোদয় উপস্থিত হইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি সপ্তম শ্রেণির শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত হইলেন! তাহাকে দেখিয়া মাস্টার মশাই বেশ অবাক হইলেন। নিতান্ত অল্প বয়েসী এক ছোকরা! তাহার কাঠিন্যের ব্যাপারে যাহা শোনা গিয়াছিল, দেখা গেল- তাহা প্রায় সবই অমূলক। ছাত্র-ছাত্রীদিগকে মামুলি দুই একটা প্রশ্ন করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন।
হঠাৎ মাস্টার মশাইয়ের দিকে তাকাইয়া পরিদর্শক মহোদয় একটু গম্ভীর হইয়া গেলেন। সাদা পাঞ্জাবির জমিনে নীল রিপুর কারুকার্যের এই দুঃখময় ত্রুটি তাঁহার নজরে পড়িয়া গেল! মাস্টার মশাইয়ের লজ্জার কোনো সীমা-পরিসীমা রহিল না। মাথা নিচু করিয়া তিনি মাটিতে মিশিয়া গেলেন।
মাস্টার মশাইয়ের কাঁধে হাতের আলতো ছোঁয়া দিয়ে খুব আস্তে করে পরিদর্শক মহোদয় বলিলেন, 'স্যার আমার প্যান্টের এই ছেড়া অংশের দিকে চোখ দিলে আপনার বিব্রতভাব একটু কমবে বোধ হয়!'