এমআরসিপিতে বিশ্বসেরা বাংলাদেশি চিকিৎসক
নম্বরের কথা চিন্তা করে পড়াশোনা করিনি: ডা. জেসি হক

মেডিভয়েস রিপোর্ট: মেম্বারশিপ অব দ্য রয়েল কলেজস অব ফিজিশিয়ান্স অব দ্য ইউনাইটেড কিংডম (এমআরসিপি) পরীক্ষায় এবার অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন বাংলাদেশের তরুণ চিকিৎসক মাহমুদুল হক জেসি (ডা. জেসি হক)।
পরীক্ষায় এক হাজার নম্বরের মধ্যে ৯০৬ নম্বর পেয়ে সারা বিশ্বের সব প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে শীর্ষস্থান দখল করেছেন তিনি। চিকিৎসকদের মর্যাদাকর এ পরীক্ষার মোট ৯৯৯ নম্বরের মধ্যে পাস মার্ক ৪৫৪।
ডা. জেসি হকের ঈর্ষণীয় সাফল্যে চিকিৎসক মহলে বইছে প্রশংসার বন্যা।
নম্বরের কথা চিন্তা করে পড়াশোনা করিনি
নিজের অভাবনীয় সাফল্যের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে ডা. জেসি হক বলেন, ‘এই পর্যন্ত যতটুকু প্রমাণ পেয়েছি, এবার অক্টোবর ২০২০ ডায়েটে আমার নম্বর ৯০৬। এছাড়া এটাই সম্ভবত এই অক্টোবর ডায়েটে ওয়ার্ল্ডের সবচেয়ে বেশি নম্বর। ভারত থেকে একজন ৮৫৫ পেয়েছেন, তাঁকে অভিনন্দন। বাংলাদেশ থেকে ২-৩ জন ৮০০ নম্বর অতিক্রম করেছেন। তাদেরকেও অভিনন্দন, কারণ ৮০০ ছোঁয়াটাও একটা বিশাল ব্যাপার। তবে এর আগের ডায়েটগুলোতে নম্বর সম্পর্কে আমার ধারণা নেই। তবে এই ডায়েট সম্ভবত আমারটাই ওয়ার্ল্ড হাইয়েস্ট। কিন্তু একটি কথা বলে রাখতে চাই, নম্বর যেটাই হোক সেটা বিষয় না। কারণ আমি কখনোই নম্বরের কথা চিন্তা করে পড়াশোনা করিনি। সবাই দোয়া করবেন।’
ডা. জেসি হকের বেড়ে ওঠা
ডা. মাহমুদুল হক জেসির বাড়ি ঢাকার কেরাণীগঞ্জের আমিরাবাগ এলাকায়। ২০০৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে প্রথমে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েটে) ভর্তি হন মাহমুদুল হক জেসি। মেধাক্রম ৫৬তম হয়ে থ্রিপল-ইতে সুযোগ পান তিনি। সেখানেও রাখেন মেধার স্বাক্ষর। পাঁচ বিষয়ের পরীক্ষায় চারটিতেই তিনি এ প্লাস (সিজিপিএ ৪.০০) পেয়েছিলেন। কিন্তু যান্ত্রিক পড়াশোনায় মন না টেকায় আট মাসের মাথায় চুকান বুয়েটের পাঠ।
পরে তিনি মানুষের শরীর নিয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। মাত্র দুই মাসের প্রস্তুতিতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় সারা দেশের মেধা তালিকায় ২৯তম হন জেসি হক। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ডিএমসি) থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন করেন।
ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করে দেশবরেণ্য মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আজিজুল কাহহারের চেম্বারে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দেন ডিএমসি কে-৬৬ ব্যাচের এ শিক্ষার্থী।
সেখান থেকেই মূলত মেডিসিনের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়। ২০১৯ সালের মে মাসে এমআরসিপি পার্ট-১ পরীক্ষায় অংশ নেন। এরই মাঝে তিনি ৩৯তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে শরীয়তপুরের জাজিরায় মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন।
পাঠ্য বই ছাড়াও পড়েছেন অসংখ্য বই
পাঠ্যবইয়ের বাইরেও এ পর্যন্ত মেডিকেল সংশ্লিষ্ট প্রচুর বই পড়েছেন ডা. জেসি হক। বাসায় অন্তত আট লাখ টাকার বই থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মেডিকেল লাইফের প্রথম থেকেই আমি সব কিছু বুঝে পড়ার চেষ্টা করতাম। আমি বিশ্বাস করতাম, সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। আর মানুষকে সুস্থ করার দায়িত্ব হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ দায়িত্ব। আর এটি সব থেকে কঠিন। এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে কোনো ত্রুটি রাখা চলবে না, নিজের শতভাগ ঢেলে দিতে হবে। কিন্তু প্রথম বর্ষ থেকে গাইটনের ফিজিওলজি বই ছাড়া অন্য কোনো বই খুব একটা ভালো লাগেনি। তাই আমি নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানে গিয়ে সারাদিন মেডিকেলের বই খুঁজতাম, কোনো সহজ এবং বোধগম্য বই পাওয়ার আশায়? একদিন সকালে আমি আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজের লাইব্রেরিতে বই খুঁজছিলাম। হঠাৎই আমার হাতে আসে হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের কার্ডিওলজির একটা বই। নাম ছিল Pathophysiology of Heart Disease. এর লেখক হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের কার্ডিওলজির প্রধান Leonard S. Lilly. বইটিতে এত সুন্দর করে হৃৎপিণ্ডের রোগগুলোর ব্যাখ্যা ছিল যেটা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পরে জানতে পারি, ওই বইটি আমাদের লাইব্রেরিতে দান করেছিলেন শিশু সার্জারি বিভাগের শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ডা. আবদুল হানিফ টাবলু স্যার। আর বইটি স্যারকে দিয়েছিলেন নাহরিন হুসনা আহমেদ, যিনি আমেরিকাতে থাকেন এবং কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশে এসে ঢাকা মেডিকেলে প্রশিক্ষণরত চিকিৎসকদের আল্টাসনোগ্রাফির উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। তখন আমার ধারণা হয়, হৃৎপিণ্ড ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের উপর নিশ্চয়ই এ রকম আরও সুন্দর সুন্দর বই আছে।’
এর পর থেকে নিউ মার্কেটে পরশ পাবলিশার্সে প্রতিটা বিষয়ের উপর যত বই পেয়েছেন তার সবই কিনেছেন তিনি। ডা. জেসি বলেন, ‘তখন আমার সেকেন্ড প্রফ আসন্ন, কিন্তু জানার নেশা আমাকে এমনভাবে পেয়ে বসে যে আমি দুই মাস কলেজেই আসিনি, শুধু এই বইগুলো পড়েছি। ফলে প্রফের প্রস্তুতি নিতে পারিনি, সেকেন্ড প্রফটাও সময় মতো দেওয়া হয়নি। হার্ভার্ডের লেখকেরা কি কি বই লিখেছেন এগুলো ইন্টারনেট থেকে সার্চ দিয়ে বের করতাম এবং Amazon থেকে পরশ পাবলিশার্সের মালিকের মাধ্যমে ওই বইগুলো কিনে আনতাম।’
একটি বিষয় বোঝার পেছনে খরচ লক্ষ টাকা
ডা. জেসি হক বলেন, ‘একটা বিষয় বোঝার পেছনে কখনো কখনো আমার লক্ষ টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এতে আমি কিছুই মনে করতাম না। কারণ জ্ঞান অর্জনটাই আমার কাছে মুখ্য বিষয় ছিল। কোনো কিছুর সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা আমার কাছে নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। একদিন আমার আব্বু একটা কাজে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে বের হয়েছিলেন। কিন্তু হতাৎ আমি তাকে ফোন দিয়ে বললাম, আমার কিছু বই কিনতে হবে, যার জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। ঠিক ওই মুহূর্তে আমার আব্বু তার প্রয়োজনীয় কাজটি না করে পুরো টাকাটাই আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন।’
চিকিৎসক হওয়ার প্রেরণা বাবা-মা
তিনি বলেন, ‘মেডিকেল জীবনে সহকর্মীদের কাছ থেকে হয়ত মানসিক সাপোর্ট কম পেয়েছি, কখনো হয়ত বিভিন্ন অপ্রত্যাশিত ঘটনায় মানসিকভাবে ভেঙে পরেছি, কিন্তু একটি দিনের জন্যও জ্ঞান অর্জন বন্ধ করিনি। কারণ আমার সব চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিল আমার বাবা-মা। মেডিকেল লাইফে যখনই খারাপ লাগতো তখনই মা-বাবার কথা মনে করতাম। শুধু ভাবতাম, দুইজন মানুষ কতটুকু নিবেদিত হলে লক্ষ লক্ষ টাকা আমার বই কিনার পেছনে খরচ করতে পারেন। কাজেই শুধুমাত্র মা-বাবার জন্য হলেও আমাকে ভালো ডাক্তার হতে হবে।’
পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে পিছিয়ে পড়ছি আমরা
ডা. জেসি হক মনে করেন, ডিএমসির ছাত্রছাত্রীদের যোগ্যতা ও মেধা পৃথিবীর যে কোনো দেশের ছেলেমেয়েদের চাইতে বেশি। কিন্তু শুধু পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে পিছিয়ে পড়ছে তারা। এজন্য বাইরের দেশের মেডিকেল শিক্ষা শেষে তারা অনেক আপগ্রেডেড হয়ে বের হয়ে আসে, অন্যদিকে মেধা থাকা সত্ত্বেও সিস্টেমের কারণে এ দেশের মেডিকেল শিক্ষার্থীদের দিন দিন অবনতি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘আমেরিকায় যেখানে এমডি ডিগ্রি দিয়েই হয়ে যায়, সেখানে আমাদের ডিগ্রি নেওয়া যেন আর শেষ হয় না। পৃথিবীর সেরা পেশেন্ট স্টাফ আমাদের আছে, কিন্তু যথাযথ জ্ঞানের প্রয়োগ আর নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকার কারণে এই বিশাল সুযোগের সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারি না।’