ডা. মো. সাখাওয়াত আলম
সহোযোগী অধ্যাপক, শিশু কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
২৮ নভেম্বর, ২০২২ ০৫:০২ পিএম
শিশুদের জন্মগত হৃদরোগ: চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ জরুরি
জন্মগতভাবে শিশুদের হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। এই নিয়ে দেশে তেমন কোনো গবেষণা না হওয়ায় রোগটিতে আক্রান্তের হার সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। জেনেটিকসহ বেশ কিছু কারণে শিশুদের জন্মগত হৃদরোগ হয়।
শিশুদের হৃদরোগ
কিছু কিছু শিশু জন্মগতভাবেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। উন্নত বিশ্বে এই সংখ্যা প্রতি হাজারে ছয় থেকে আট জন। তবে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের গবেষণা হয়নি বললেই চলে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) একটা গবেষণা হয়েছিল, সেখানে দেখা গেছে, প্রতি হাজারে ২৫ জন শিশু জন্মগতভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। সারাদেশে শিশুদের জন্মগত হৃদরোগের হার কত? সেটা দেখার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) শিশু হৃদরোগ বিভাগের একটি গবেষণা চলমান রয়েছে। এর মাধ্যমে শুধু হাসপাতাল ভিত্তিক নয়, সারা বাংলাদেশে শিশুদের জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা কতটুকু তা জানা যাবে।
আক্রান্তের হার বৃদ্ধির কারণ
হৃদরোগে আক্রান্তের হার ক্রমাগত বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মায়েদের জীবন-যাপন পদ্ধতি। যেমন-গর্ভাবস্থায় কিংবা তার আগে থেকে যদি কোনো মায়ের ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে তার সন্তানের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি থাকে। আবার কিছু কিছু সিনড্রোমিক অসুখ রয়েছে, যেমন: ডাউন সিনড্রোম, পেটাও সিনড্রোম, ডাইজস্ট সিনড্রোম অথবা উইলিয়াম সিনড্রোম। এই ধরনের জেনেটিক রোগের কারণে সাধারণত শিশু হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে। আবার দেখা যায় যে, মায়েদের এক ধরণের রোবেলা সিনড্রোম থাকে। গর্ভাবস্থায় কোনো মায়ের রোবেলা সিনড্রোম হলে, তাদের বাচ্চাদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, এক্ষেত্রে হয়তো কোনো মাল্টিপল ফ্যাক্টর জড়িত ছিল, তাই হয়তো শিশুটি হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
জন্মগত হৃদরোগের প্রকারভেদ
শিশুদের জন্মগত হৃদরোগ দুই ধরনের। যেমন-সিম্পল কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ (সিম্পল জন্মগত হৃদরোগ) এবং কমপ্লেক্স কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ (জটিল জন্মগত হৃদরোগ)। যেসব শিশু কমপ্লেক্স কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজে ভুগে, তাদের ক্ষেত্রে জন্মের পরপরই লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। যেমন: শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া, কান্না করলে চেহরা নীল হয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্টের সময় হাতের তলা ও পায়ের তলা নীল বর্ণের হয়ে যায়। তবে সিম্পল কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজের ক্ষেত্রে জন্মের পরপরই লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। পরে হয়তো অন্য কোনো কারণে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিষয়টি ধরা পড়ে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
হার্টের যে চারটি চেম্বার থাকে, এরমধ্যে উপরে দুটি চেম্বারকে অলিন্দ্য এবং নিচের দুটি চেম্বারকে নিলয় বলা হয়। অলিন্দ্যের মাঝখানে একটি পর্দা থাকে, এই পর্দার মধ্যে যদি ছিদ্র থাকে, তাহলে লক্ষণগুলো একটু দেরিতে প্রকাশ পায়। আবার একইভাবে নিলয়ের মাঝখানে যে পর্দা থাকে, তার মধ্যে যদি ছিদ্র থাকে, তাহলে লক্ষণগুলো একটু দ্রুত প্রকাশ পায়। দেখা যায় যে, বাচ্চা যখন খেতে যাচ্ছে, তখন সে পুরোপুরি শক্তি দিয়ে টেনে খেতে পারছে না। অল্প একটু খাচ্ছে, আবার ছেড়ে দিচ্ছে এবং অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এ ধরণের লক্ষণগুলো শুরুর দিকে থাকতে পারে।
শনাক্ত করার উপায়
আগে শুধু এক্স-রে, ইসিজি এই দুটি পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুদের হৃদরোগ শনাক্ত করা যেত। এরপরে আসছে ইকোকার্ডিওগ্রাফি, যেটা দিয়ে সাধারণত শিশুদের জন্মের পরের হৃদরোগ শনাক্ত করা যায়। এক্স-রের মাধ্যমে হার্টের গঠনগত পরিবর্তনগুলো ধরা পড়ে। যেমন: হার্ট অনেক সময় এগ শেফ (ডিমের মতো) বা বুট শেফ (জুতার মতো) আকার ধারণ করতে পারে, এটা এক্স-রে করলে ধরা পড়ে। আবার অনেক সময় হার্ট বুকের তুলনায় অনেক বড় দেখা যায়। এসব লক্ষণ দেখলে আমরা বুঝতে পারি যে, তার জন্মগত হৃদরোগ রয়েছে। সুনির্দিষ্টভাবে এ রোগটা ধরার জন্য ইকোকার্ডিওগ্রাফি এখন সব জায়গায় অহরহ পাওয়া যায়। এর মাধ্যমে জন্মের আগে ও পরে হৃদরোগ শনাক্ত করা যায়।
চিকিৎসা
দেশে শিশু হৃদরোগের চিকিৎসা এখনো পর্যন্ত ঢাকা নির্ভর। বিএসএমএমইউ, সিএমএইচ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও ইব্রাহিম কার্ডিয়াক সেন্টারে শিশু হৃদরোগের বেশ ভালো চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে অন্যান্য শহরগুলোতেও এ রোগের চিকিৎসার বিস্তৃত হচ্ছে।
শিশু হৃদরোগের চিকিৎসাকে তিনভাবে ভাগ করা যায়। যেমন: মেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা, যাকে আমরা মেডিকেল ট্রিটমেন্ট বলি। ইন্টারভেনশন প্রক্রিয়া। এটা আবার দুই ধরনের। একটি হচ্ছে ওপেন হার্ট সার্জারি, অন্যটি হচ্ছে সার্জারি ছাড়াই বিভিন্ন ডিভাইসের মাধ্যমে হার্টের ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দেওয়া। কমপ্লেক্স কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজের (হার্টের ছিদ্রগুলো যখন বড় থাকে) ক্ষেত্রে তখন ওপেন হার্ট সার্জারির প্রয়োজন পড়ে।
সিম্পল কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজের (হার্টের ছিদ্রগুলো যখন ছোট থাকে) ক্ষেত্রে মেডিকেল ট্রিটমেন্ট অথবা ডিভাইসের মাধ্যমে হার্টের ছিদ্রগুলো বন্ধ করে দিয়ে চিকিৎসা করা যায়। এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন ধরে মেডিসিন নিতে থাকলে ছোট ছোট ছিদ্রগুলো স্বাভাবিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
প্রতিরোধে করণীয়
চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ সব ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি জাতীয়ভাবে চিন্তা করি, তাহলে এটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি প্রসূতি মায়ের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারি কিংবা এটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, তাহলে দেখা যাবে হৃদরোগের প্রবণতাটা অনেকটাই কমে গেছে। এ ছাড়া শিশুর জন্মের আগে যদি এমন কোনো জটিলতর এনোমালি স্কানে ধরা পড়ে যে, সে জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে আসছে, তাহলে আমরা ওই প্রেগনেন্সিটাকে ডিসকন্টিনিউ করার জন্য বলতে পারি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে একটি মেয়ে যখন বাচ্চা ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন হয়, তখনই যদি আমরা তাকে রোবেলা টিকা দিতে পারি, তাহলে গর্ভকালীন সময়ে তার রোবেলা সিনড্রোম হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়।