ডা. ইমরান কায়েস
ক্লিনিক্যাল ফেলো,
পশ্চিম মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, যুক্তরাজ্য
২১ ডিসেম্বর, ২০২০ ১১:৩৩ এএম
মেডিকেল শিক্ষা
‘সাবজেক্টিভ সিস্টেমের সত্তর ভাগই কাজে লাগে না’
আমার ফ্রেন্ড লিস্ট ভর্তি ডাক্তার। বেশিরভাগই জুনিয়র।
জিনিসটা আমি ভালো মতন টের পাই, বিসিএস মৌসুম কিংবা বিএসএমএমইউর এমএস, এমডি, ডিপ্লোমা—এমনসব পোস্ট গ্রাজুয়েশন ভর্তি পরীক্ষা বা এফসিপিএস পরীক্ষার সময়।
এসব জটিল, কঠিন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার আনন্দ খবর নিউজ ফিডে আসা শুরু হয়।
পরীক্ষাগুলো কতটা কঠিন সে বিষয়ে আপনাদের একটা ধারণা দিই। আমার জেনারেল সার্জারি এফসিপিএস পার্ট ওয়ান পরীক্ষার সময় প্রায় চার থেকে পাঁচ মাস দিনে পনেরো থেকে ষোল ঘণ্টা করে পড়েছি!
পরীক্ষা হতো টানা তিনদিন। তিন দিনে তিন পেপার। সব পেপারেই আপনাকে একশতে সত্তরের উপর পেতে হবে। এবং সে সব প্রশ্নের কোনো মা-বাপ নাই। মেডিকেলের যে কোনো বইয়ের যে কোনো কর্নার থেকে হুট করে একটা লাইন তুলে দেওয়া হতে পারে!
আমাদের সময়ে জেনারেল সার্জারিতে পরীক্ষা দিতো হাজার খানেক ছেলে-মেয়ে, পাস করতো ত্রিশ চল্লিশ জন!
আমার তখন এক ধরনের জেদ চেপে গিয়েছিল। একবারে পাস করতে হবে, এমন একটা অদ্ভুত খেয়াল।
দিন-রাত এক করে পড়ে, বই-পত্র মুখস্ত করে ফেললাম। দিনে পড়ি, আর রাতে ঘুমানোর আগে প্রশ্ন সলভ করি।
সুতরাং যারা এই পরীক্ষাগুলোতে চান্স পাচ্ছে আমি জানি কত কঠিন পড়ালেখার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে।
দিন-রাত এক করে লেখাপড়া করা সমস্ত ডাক্তারদের অভিনন্দন।
মুশকিল কি জানেন। এই ইংল্যন্ড এসে বুঝেছি, আমরা আসলে আমাদের পলিসি মেকিংয়ে একদমই স্মার্ট না। আমাদের কোথাও কোনো সূক্ষ্ণ ক্যালকুলেশন নাই। কি লাগে কতটুকু লাগে জানা নাই।
একটা বই বাচ্চাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলি মুখস্ত করে ফেলো বাপধন! আমাদের দেশে লেখাপড়া মানে দুম করে সব কিছু মুখস্ত করে ফেলা। ইনফর্মেশন দিয়ে মাথা ভাড়ি করে ফেলা।
যা আমরা পড়ি—আমি আমার কথা বলি, আমি যা কিছু পড়েছি তার সত্তর ভাগই আসলে কাজ লাগে না।
আমার লন্ডন হাসপাতালে সমস্ত রোগের জন্য গাইড লাইন বানানো আছে। এবং সে সব গাইড লাইন প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। আপডেটেড হয়। আপনি হাসপাতালের ওয়েব সাইটে ঢুকলেই লেটেস্ট গাইড লাইন পেয়ে যাবেন এবং আপনাকে সে অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। এই গাইড লাইনের বাইরে যাবার বিন্দুমাত্র সুযোগ আপনার নাই!
আর এই গাইড লাইন কেউ কোনায় বসে মাথা ঝুকে ঝুকে মুখস্ত করে ফেলেন না! এখানে কেউ কোনো সংজ্ঞা পড়েন না। মানে আলসার কি, পাব্লিক হেলথের সংজ্ঞা কি, এবসেস কাকে বলে—এইসব এলেবেলে মুখস্ত বিদ্যাকে কেউ এখানে জ্ঞান হিসেবে মনে করে না।
আমাদের দেশে কেউ কোনো সংজ্ঞার একটা শব্দ এলোমেলো করে ফেললে তাকে প্রফেসররা ছিড়ে খেয়ে ফেলে! তাদের চোখ কপালে উঠে আসে, কোথাকার গর্ধভ এই সামান্য সংজ্ঞাটা পারছে না!
আমাদের দেশের মেডিকেলের ছেলে-মেয়েদের সময় এবং মস্তিষ্কের একটা বড় অংশ খরচ হয় এইসব এলোমেলো সংজ্ঞা মুখস্ত করে।
আমরা পরীক্ষার উপর মহা গুরুত্ব দিয়ে বসে আছি। পরীক্ষা নেয়ার ধরনটাও এত সেকেলে যে চিন্তাই করা যায় না! এত সাবজেক্টিভ একটা সিস্টেম যে রীতিমতো ভয়ঙ্কর।
ট্রেনিং সিস্টেম নাই ঠিক, নাই সরাসরি সুপারভিশন, নাই একটা ছেলেকে ম্যাচিউর্ড করে আনার সিস্টেম। আপনি তারে সংজ্ঞা ধরে ফেল করিয়ে দিচ্ছেন, এই আধুনিক সময়ে এসে ডাক্তার ডানে দাড়ালো বামে দাড়ালো এসব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে পড়ে আছেন তাহলে কিভাবে হবে।
কোন কিছু নিয়েই একটা গাইড লাইন ঠিক ঠাক মতন দাড় করতে পারছি না আমরা, তাহলে কি করে হবে।
ভুল সিস্টেমের কারণে, সত্যিকারের প্ল্যানিং আর ব্যবস্থাপনার অভাবে জুনিয়র ডাক্তারদেরকে নানা জায়গায় হেনস্থা হতে হচ্ছে অনবরত।
মেডিকেল সেক্টর বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তো ব্যক্তিকেন্দ্রিক হলে হবে না। দেশের সব জায়গায় সব রোগেরতো একইভাবে চিকিৎসা হতে হবে। ভালো ডাক্তার, খারাপ ডাক্তার এই আইডিয়াই তো থাকার কথা না।
এইখানে মানে লন্ডনে আপনারা কোন লিজেন্ড পাবেন না। এইখানে কোন ওস্তাদ নাই, হাতে জশ এই সব এলেবেলে ভাবনা নাই। এখানে রোগের চিকিৎসা হয় প্রটোকল ধরে, মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম মিটিংয়ের স্বিদ্ধান্ত অনুযায়ী।
ব্যক্তিগত সুনাম, দুর্নামের কোন সুযোগ নাই। অহেতুক স্টার হওয়া নাই। অহেতুক বিপদে পড়াও নাই।
বই-পত্র মুখস্ত করার বাইরে গিয়ে একটা সেন্সেটিভ, জবাবদিহিমূলক, কঠিন সুপারভাইজড ট্রেইনিং সিস্টেমসহ স্বচ্ছ স্মার্ট স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমরা কবে মনোযোগ দিবো কে জানে!