
অধ্যাপক ডা. নুজহাত চৌধুরী
রেটিনা বিশেষজ্ঞ, চক্ষু বিজ্ঞান বিভাগ, বিএসএমএমইউ
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০২:৪৮ পিএম
চোখের যেসব সমস্যায় অবহেলার পরিণতি অন্ধত্ব

প্রায় মানুষের চোখের সমস্যা বিদ্যমান। অনেকে আবার না জানার কারণে বঞ্চিত হচ্ছে সঠিক চিকিৎসা থেকে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি একটি ভোগান্তি সৃষ্টি হয়। এ থেকে উত্তরণে দরকার সচেতনতা। সেই সঙ্গে প্রয়োজন চোখের নিয়মিত চেকআপ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ। এতে চোখ যেমন সুরক্ষিত থাকবে, তেমনি বাঁচা যাবে অন্ধত্বের মতো ভয়াবহ পরিণতি থেকে।
চোখের যত্নে যে অভ্যাস জরুরি
চোখের যত্নে কিছু বিষয় অনুসরণ করলে চোখ ভালো রাখা সম্ভব। প্রথম কথা হলো, চোখে হাত দেওয়া যাবে না, কারণ চোখ একটি খোলা অঙ্গ। লিভার, কিডনি ইত্যাদি অঙ্গ আবৃত থাকায় সুরক্ষিত থাকে। আমাদের সমস্যা হলো, চোখ চুলকানো বা খচখচ করলে আমরা সাথে সাথে আমরা চোখে হাত দিয়ে দেই। চোখে চুলকানো বা ময়লা হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। এমন হলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এবং চিকিৎসা নিতে হবে। চোখে বারবার হাত দেওয়া যাবে না। এতে চোখে ভাইরাস বা জীবানু প্রবেশ করে। সেই সাথে চোখের চিকিৎসকের কাছে বছরে অন্তত একবার চেকআপে যাই। সংকটটি গুরুতর হওয়ার পর কেন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবো? ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন হলে চোখেও ক্ষতি হতে পারে। কখনো কখনো চোখের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ ইত্যাদি ধরা পড়ে। এ জন্য প্রতি বছরে চোখ রুটিন চেক আপন করানো প্রয়োজন।
রেটিনা পরিচিতি ও সুরক্ষায় করণীয়
রেটিনা হলো চোখের স্বচ্ছ নরম পর্দা, যার উপর আলো পড়লে আমরা দেখতে পাই। রেটিনা কি জিনিস সেটা অনেকেই জানেন না। পর্দা বলতে অনেকে চোখের ছানিকে বোঝেন। কিন্তু এটি ভুল ধারণা। লেন্সের পেছনের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশটি হলো রেটিনা। সতর্ক হওয়ার বিষয় হলো, রেটিনা প্রতিস্থাপন যোগ্য নয়। ছানি পড়লে আর্টিফিশিয়াল লেন্স দেওয়া যায় এবং কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা যায়। কিন্তু রেটিনা একবার নষ্ট হলে আর ভালো করা যায় না। আর রেটিনায় স্ট্রোকসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ হতে পারে। রেটিনা রোগের আরেকটি সমস্যা হলো সেটা শুরুর দিকে বোঝা যায় না। আর শেষ পর্যায়ে বোঝার কারণে পদপেক্ষ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
রেটিনা কখন পরীক্ষা করতে হবে
চোখ সুস্থ মনে হলেও বছরে একবার রুটিন পরীক্ষা অপরিহার্য। আর যাদের ডায়াটিসসহ অসংক্রামক বিভিন্ন রোগ রয়েছে, তাদের ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী চেকআপ হওয়া প্রয়োজন। কারণ এ রোগগুলো রেটিনার জটিল কিছু সমস্যা তৈরি করে। আর যেসব শিশু ২০০০ হাজার গ্রামের নিচে ও ৩৫ সপ্তাহের আগে জন্মেছে, তারা যখন নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) থাকে, তখন তাদের উপর অনেক ঝড় বয়ে যায়। তাদেরকে ২০-৩০ দিনের মধ্যে অন্তত একবার চোখ পরীক্ষা করা দরকার।
এ ছাড়া শিশুদের চোখ দিয়ে পানি পড়লে, অন্যদের চেয়ে চোখটা বড় মনে হলে অথবা মণিটা বড় হয়ে যাচ্ছে মনে হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
সেই সঙ্গে শিশুর চোখে সাদা কিছু পরিলক্ষিত হলে বুঝতে হবে, এটা বিপজ্জনক ও গুরুতর সমস্যার লক্ষণ। এসব সমস্যায় শুরুতেই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি ছিল ..., এ রকম সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
এ ছাড়াও কিছু বিষয়ে আমাদের সচেতন হওয়া দরকার, যেমন—শিশুর চোখ ট্যারা হলে কেউ বলেন, লক্ষ্মী ট্যারা। এর বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। শিশুর চোখ ট্যারা বা বাঁকা মনে হলেই কোনো রকম সময় ক্ষেপণ ছাড়া চিকিৎসা করাতে হবে। এ জাতীয় সমস্যা ৬-৮ বছরের মধ্যে সমাধান করা জরুরি, না হলে বিলম্বে চিকিৎসায় হয় তো চোখটা সোজা করা সম্ভব, কিন্তু দৃষ্টি স্বাভাবিক পর্যায়ে ফেরানো যাবে না। এটা অলস চোখ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে ওই শিশু পরিণত বয়সে বিসিএস ক্যাডার হতে সমস্যা হবে, উড়োজাহাজ ও গাড়ি চালাতে সমস্যা হবে। চিকিৎসক হলেও সার্জারিতে ক্যারিয়ার গড়তে পারবে না। এটি শিশুর ভবিষ্যতের জন্য খুব জরুরি। সুতরাং শিশু, বয়স্ক কিংবা সুস্থ-অসুস্থ—সবারই বছরে একবার চোখ পরীক্ষা করা জরুরি।
চোখের পরীক্ষা কোথায় করাবো
চোখের পরীক্ষার বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে খুব খরচ করে করবার প্রয়োজন নেই। আরেকটি কথা পরিষ্কার করে বলে রাখি, চোখের পরীক্ষা করার জন্য বিদেশ যাওয়ারও দরকার নেই। সরকারিভাবে সুলভ মূল্যে চোখের ভালো চিকিৎসা এবং পরীক্ষা হচ্ছে। যেমন-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নামমাত্র মূল্যে চোখের পরীক্ষা করা যায়, যেসব পরীক্ষাগুলো বাহিরে করতে হাজার হাজার টাকা লাগে। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটও আছে, সেখানে নিখরচায় করতে পারছেন। বাংলাদেশে চোখের সব ধরনের চিকিৎসা আছে। কর্নিয়া প্রতিস্থাপন, রেটিনার বড় বড় সার্জারিসহ চোখের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে।
ডায়াবেটিস রোগীদের চোখের যত্নে আলাদা সতর্কতা
ডায়াবেটিস চোখের ক্ষুদ্র রক্ত নালিকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। নালীর গঠন দুর্বল করে দেয়। আর ডায়াবেটিস শরীরের সব অঙ্গকেই ক্ষতি করতে সক্ষম। চোখ একটি ভাসকুলার অঙ্গ। এখানে অনেক রক্ত নালিকা আছে, বিশেষ করে রোখের রেটিনা।
চোখের রেটিনাকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ডায়াবেটিস। চোখ, কিডনি ও বিভিন্ন নার্ভের ক্ষতি সাধন করে ডায়াবেটিস। এসব অঙ্গের সমস্যা হাতে হাত ধরে আসে। কিডনিতে সমস্যা হলে বুঝবেন, আপনার চোখেও সমস্যা হতে পারে। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগীর চোখের যত্নে প্রয়োজন সচেতনতা।
চোখের যেসব সমস্যা ডায়াবেটিস ডেকে আনে
চোখের কোনো সমস্যা দেখা না গেলেও ডায়াবেটিস নীরবে চোখের সমস্যা করে। যখন বুঝতে পারবেন, তখন দেখবেন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এজন্য রুটিন চেকআপে যাওয়া প্রয়োজন। ডাক্তার যা বলবেন, সেই অনুযায়ী চিকিৎসা চলতে হবে। শুধু চোখের মঙ্গলের জন্য নয়, সারা শরীরের মঙ্গলের জন্য ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হাঁটা, ওজন কমানো, কায়িক পরিশ্রম করা ও চিনি জাতীয় খাবার গ্রহণ না করা ইত্যাদি শুধু ডায়াবেটিসের জন্য নয়, সকল অঙ্গের জন্য মঙ্গলের। ডায়াবেটিস চোখের স্থায়ী ক্ষতি করে দিতে পারে। ডায়াবেটিসের কারণে চোখ চুলকায় এবং চোখে অস্বস্তিসহ নানা রোগ হয়।
স্মার্ট ফোনে শিশুদের যেসব ক্ষতি
কম্পিউটার, মোবাইল, ল্যাপটপ ও টেলিভিশন ইত্যাদি ডিভাইস চোখের ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে। শুধু শিশুদের নয়, বয়স্কদেরও ক্ষতি করতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এই ক্ষতিটা মারাত্মক আকার ধারণ করছে। এটা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে। সারাক্ষণ স্মার্ট দেখলে দূরে তাকানোর সক্ষমতা কমে যেতে পারে, তখন তাদেরকে দূরে দেখানোর জন্য চশমার প্রয়োজন হয়। শিশুরা স্মার্ট ফোন বেশি চালালে তাড়াতাড়ি তাদের চোখে সমস্যা দেখা দেয়। তাদের চোখ লাল হয়ে যায়, চোখ দিয়ে পানি পড়ে। চোখের পাতা ভারি হয়ে থাকে। গোসলের পর চোখ লাল হয়ে যায়। সারাক্ষণ শিশুরা অস্বস্তিতে থাকে। মাথা ব্যথা হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। এই ধরনের বাচ্চারা পড়াশোনায়ও ভালো করতে পারে না। সামাজিক হয়ে উঠতে পারে না এবং সৃজনশীল কোনো কাজ করতে পারে না। স্মার্টফোন শুধু চোখ নয়, শিশুকে শারীরিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এসএএইচ/এমইউ
-
১৮ অক্টোবর, ২০২৩
-
২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩